একদিকে কর কমানোর চাপ, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ানোর দাবি
দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের চাহিদা মেটাতে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। শুল্ক-কর আরও কমানোর সুপারিশ করছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো, মহামারির এই সময়ে বাড়তি চাপ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আহরণে ব্যর্থ হওয়ায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে কঠিন সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ব্যবসা সম্প্রসারণে শুল্ক-কর কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে রাজস্ব বোর্ডকে। পরবর্তী অর্থবছরের জন্য ৩.৮৩ লাখ কোটি টাকা সংগ্রহের জন্য সম্ভাব্য প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করতে হবে, এই অসাধ্য সাধনে এবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১.৩৫ লাখ কোটি টাকা বেশি সংগ্রহ করতে হবে এনবিআরকে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের ৩.৩০ লাখ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব নয় জানিয়ে গত বছরের মার্চে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি লিখে জানান এনবিআরের চেয়ারম্যান। গতকাল প্রকাশিত জুলাই-ফেব্রুয়ারির রাজস্ব সংগ্রহের তথ্যে তার পুর্বাভাসেরই প্রতিফলন ঘটে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার থেকে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এ অবস্থার মধ্যেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বাড়তি বরাদ্দ চাহিদা মেটাতে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৩.৮৩ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ৫.৯৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে অর্থমন্ত্রণালয়।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থবিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তাদের প্রাক্কলন অনুযায়ী ট্যাক্স ও নন-ট্যাক্স মিলিয়ে চলতি অর্থবছর ২.৫০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। তাই বাজেটের আকার সংশোধন করে ৫.৩৮ লাখ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "রাজস্ব আদায়ে সরকার সবসময়ই ব্যর্থ হয়েছে। তবে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছর রাজস্ব আদায়ে ১০-১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। কিন্তু বাজেটে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩০-৪০ শতাংশের মতো, যা একেবারেই বাস্তবসম্মত না।"
অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় চালু হলেও আমদানি-রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি এখনও ফেরেনি। টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর বিভিন্ন খাতের উৎপাদন, বিপণন কার্যক্রম প্রাক-মহামারি পর্যায়ে পৌঁছালেও গত এক সপ্তাহ ধরে দেশে করোনার সংক্রমণ বাড়তে থাকায় তাদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আগামী বাজেট নিয়ে রাজস্ব বোর্ডের চলমান প্রাক-বাজেট বৈঠকগুলোতে শুল্ক-কর আরও কমানোর সুপারিশ করছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো।
তৈরি পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা কর ০.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেছেন। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ আগামী পাঁচ বছরের জন্য পোশাক খাতের বিদ্যমান করপোরেট ট্যাক্স ১২ শতাংশ ও গ্রিন ফ্যাক্টরির করপোরেট ট্যাক্স ১০ শতাংশ অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানিয়েছে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) হার বিদ্যমান ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা এবং টার্নওভার ট্যাক্সের সীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১.২০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করেছে।
এনবিআরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট সভায় কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি অর্থবছর দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে যে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তা আরও এক বছর অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
১০ মার্চ সিপিডির সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেছেন, 'রাজস্ব আদায়ে আমরা এখনও প্রতিবেশি দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছি। তাই আদায় বাড়ানোর জন্য সকল ধরনের কর আদায়ে ডিজিটাল পদ্ধতি চালুর চেষ্টা করছি।'
তবে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে জমি অধিগ্রহণ ও গাড়ি কেনা বন্ধ রাখা, ভ্রমণ ব্যয় ও প্রশিক্ষণ ব্যয় কমানো এবং উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করায় বাজেট ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৬ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করছেন তিনি।
মন্ত্রণালয়গুলোর অতিরিক্ত বরাদ্দের আবেদন
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রায় ৫.৯৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট আউটলাইন তৈরি করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দসীমা নির্ধারণ করে তা জানিয়ে দিয়েছে অর্থবিভাগ।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ বিভিন্নখাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ চেয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়।
বাড়তি বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে অর্থসচিব মো. আব্দুর রউফ তালুকদারকে চিঠি পাঠাতে শুরু করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়ায় এবং আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় আগামী অর্থবছর রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন আশা করতে পারছেন না অর্থমন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থবিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চলতি অর্থবছর রাজস্ব আয় কম হলেও কোভিডের কারণে ব্যয়ও কমেছে। চলতি অর্থবছরে মহামারির কারণে স্থগিত রাখা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়নের জন্য বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি বরাদ্দ চাওয়া হচ্ছে।"
তিনি জানান, শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। আমরা এখন পর্যন্ত ৩৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে সভা করেছি। এর মধ্যে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিভিশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের বরাদ্দ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোভিডের কারণে চলতি অর্থবছর অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে ছিল। সেগুলো সম্পন্ন করতে মন্ত্রণালয়গুলো অধিক বরাদ্দ চাইতে পারে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়ার মতো রাজস্ব সরকার আদায় করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ঘাটতি অর্থায়ন করে সরকারকে ব্যয় করতে হবে। কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে হলে বাড়তি ব্যয়েরও বিকল্প নেই।
কোভিড-১৯ মহামারিতে থমকে থাকা গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, পল্লী সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে আগামী অর্থবছরের জন্য অর্থবিভাগ নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার 'আমার গ্রাম, আমার শহর' স্লোগান বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রতিটি গ্রামে শহরের মতো নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে আগামী অর্থবছরের বাজেটের ৫০০০ কোটি টাকাসহ বরাদ্দ সীমার অতিরিক্ত ১৩,৯২৭ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছেন স্থানীয় সরকার সচিব।
চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দের পরিমাণ ৮৩৩২ কোটি টাকা বাড়ানোর অনুরোধ করেছে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিভিশন।
অতিরিক্ত ১২৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
৭২৫০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ অর্থমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অতিরিক্ত ২০৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এছাড়া, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের বর্তমান বরাদ্দ থেকে বাড়তি ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে।
এবিষয়ে এপর্যন্ত ৩৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে বৈঠকে বসেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।