বছরে সোয়া ৪৪৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বগুড়া থেকে
এক বছরে মালয়েশিয়ায় বগুড়া থেকে পুঁইশাক, করলা, পালংশাকের বীজ রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১ হাজার ৬০ মার্কিন ডলার । নতুনভাবে সে মাত্রায় আরও যোগ হচ্ছে টমেটো ও শসার বীজের। বেড়েছে বাজারও। এবার বীজ যাবে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রে।
চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি বলছে, শুধু বীজ-ই নয়, বগুড়া থেকে গত বছরে ১৪ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই আয়ের পরিমাণ ৪৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬ টাকা।
২০১৯ সালে বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে ৭ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩২ মার্কিন ডলার আয় হয়েছিল। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই আয়ের পরিমাণ ৬০৭ কোটি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার ৮৮ টাকা। এই হিসেবে ২০১৯ সাল থেকে ২০২০ সালে ১৬২ কোটি ৩১ লাখ ৭৫ হাজার ৮২ টাকার কম পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যদিও ২০১৮ সালে বগুড়া থেকে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৪ হাজার ২৬০ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। আর ২০১৭ সালে বিদেশে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৫ লাখ মার্কিন ডলার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী লেনদেন কিছুটা স্থবির হওয়ার যাওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রপ্তানি তালিকায় রয়েছে সেচপাম্প, রাইস ব্র্যান অয়েল, পাটজাত সুতা ও পাটের তৈরি ব্যাগ, বস্তা এবং ধান মাড়াই যন্ত্র। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হচ্ছে সিনথেটিক হেয়ার গুডস। রাশিয়ায় রপ্তানি করা হচ্ছে জুট ক্যাডিস, মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সবজির বীজ।
বগুড়ায় উৎপাদিত আলু প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে দেশের বাহিরে যাচ্ছে। সাত বছর ধরে বাঁধাকপিও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ানের বাজারে দেখা মিলছে। ক্রমাগত দেশের বাইরে যাচ্ছে বগুড়ার মিষ্টি কুমড়াও। এই যাত্রায় নতুন যুক্ত হচ্ছে যাচ্ছে কচুর মুখী। বগুড়া থেকে জালি টুপি, আলু, বাঁধাকপি, লাউও বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
বগুড়া থেকে এসব কৃষি পণ্যের বেশির ভাগই রপ্তানি হয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান মাশওয়া গ্রুপের মাধ্যমে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক আরিফ আজাত প্রিন্স বলেন, 'বগুড়ায় প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়। কিন্তু কৃষকরা প্রান্তিক পর্যায়ে ভালো দাম পায় না। এ কারণে ওখানকার সবজি দেশের বাইরে নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তাছাড়া দেশের বাইরে এর চাহিদাও ভালো'।
শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মুজাহিদ সরকার জানান, এ মৌসুমে বগুড়া থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন আলু বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। সাথে অন্যান্য সবজিও আছে। এছাড়া রয়েছে শেরপুর ও কাহালু উপজেলার গ্রামীণ নারীদের তৈরি নানা ধরনের হস্তশিল্প পণ্য। এই পণ্য রপ্তানি হচ্ছে জার্মান, সুইডেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, ইতালি, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
তবে এসব পণ্য বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তালিকায় নেই। এ হিসেবে রপ্তানি আয় আরও বেশি হওয়ার কথা। এর বাইরে বগুড়ার শোভা অ্যাডভান্সড টেকনোলজি লিমিটেডও বিদেশে ডিজিটাল স্কেল সরবরাহ করে।করোনার কারণে এবার কোনো পণ্য রপ্তানি করা না গেলেও অনেকগুলো অর্ডার রয়েছে তাদের।
সেচপাম্প তৈরি করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করে বেশ সুনাম রয়েছে বগুড়ার। বগুড়ার রপ্তানিকারকরা বলছে, সেচপাম্প তৈরির জন্য বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ছোট বড় হাজারখানেক ফাউন্ড্রি কারখানা। এসব কারখানা ঘিরে শহরের গোহাইল ও স্টেশন সড়কে তৈরি হয়েছে কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবসার বড় বাজার। যেখানে কাজ করছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ। পুরোনো লোহা বাদে অন্যান্য কাঁচামাল আনতে হবে চীন ও মালয়েশিয়া থেকে। সেচপাম্প রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে বগুড়ার পণ্যের যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে।
বর্তমানে কিছু রপ্তানিকারক বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি থেকে সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছেন। অনেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ চেম্বার থেকেও সার্টিফিকেট অব অরিজিন নিয়ে পণ্য রপ্তানি করছেন। এখন ভারত, মালয়েশিয়া ছাড়াও বগুড়ার পণ্য যাচ্ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে কয়েকজন ব্যবসায়ী সার্টিফিকেট অব অরিজিনের মাধ্যমে ভারত ও অন্যান্য দেশের বাজারে পণ্য রপ্তানি করে সাত কোটি মার্কিন ডলারের উপরে। এবার ৫ কোটি ২৬ লাখ ২১ হাজার ৯৪ ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ধানের কুঁড়া থেকে তৈরি তেল বা রাইস ব্র্যান অয়েল।
এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বগুড়ার শেরপুরের মজুমদার প্রোডাক্টস। গত বছরে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৬ হাজার ৯৭৪ মার্কিন ডলারের রাইস ব্র্যান তেল রপ্তানি করেছে তারা।
মজুমদার প্রোডাক্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) চিত্ত মজুমদার জানান, প্রায় আট বছর আগে থেকেই তারা ভারতে রাইস ব্র্যান তেল রপ্তানি করছেন। নতুন করে জাপানে এই তেলের চাহিদা বেড়েছে। তবে কিছু জটিলতার কারণে জাপানে রপ্তানি এখনো শুরু হয়। কিন্তু ভারতে রাইস ব্র্যান তেলের চাহিদা আগের চেয়ে কয়েকগুণ হয়েছে।
এবার বগুড়া থেকে রপ্তানি আয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তামিম অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। রাইস ব্র্যান তেল ভারতে রপ্তানি করে তারা আয় করেছে ১ কোটি ১১ লাখ ২৯ হাজার ৭৬৪ মার্কিন ডলার। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান আলী বলেন, 'বর্তমানে দেশে কাঁচামালের (ধানের কুঁড়া) ব্যাপক সংকট। আমাদের উৎপাদিত তেলের গুণগত মান ভালো হওয়ার কারণে ভারত ও জাপানে এর ব্যাপক চাহিদা। অস্ট্রেলিয়ায়ও নতুন বাজার সৃষ্টি হতে পারে'।
বগুড়ায় তৈরি পাটের সুতা, সুতলি ও ব্যাগের বড় বাজার ভারতে। হাসান জুট মিলস, বগুড়া জুট মিলস লিমিটেড, মা ট্রেডার্সের মাধ্যমে পাটজাত এসব পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
মা ট্রেডার্সের পরিচালক মতিউর রহমান বলেন, 'দেশের বাহিরে বগুড়ার তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা। বিশেষ করে ভারতে অনেক বেশি। কিন্তু করোনার কারণে অনেক পণ্য আটকে আছে। আর দেশে পাটের দাম বেশি হওয়ার কারণে এখন পণ্য তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে আমাদের কাছে পাটের তৈরি পণ্যের ১০ লাখ বস্তা চেয়েছে ভারতে। তুরষ্কও নতুনভাবে যুক্ত হচ্ছে আমাদের সাথে।'
সারাদেশে প্রতি বছর প্রায় এক থেকে দেড় লাখ সেচপাম্প লাগে। বগুড়ার ফাউন্ড্রি কারখানাগুলো সেচপাম্প তৈরিতে বেশ দক্ষ। দেশীয় কারিগরের তৈরি এসব পণ্য রপ্তানির বড় বাজার ভারত। এর সাথে রয়েছে কৃষি যন্ত্রাংশও। প্রতিটি পাম্পের রপ্তানিমূল্য গড়ে ১৫ মার্কিন ডলার।
গত বছর সেন্টিফিউগাল পাম্প ও যন্ত্রাংশ ভারতে রপ্তানি করেছে রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ও মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিং। রনি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল মতিন সরকার বলেন, 'কম সুদে ঋণ ও আমাদের জন্য আলাদাভাবে বিসিক তৈরি করলে বগুড়ায় এই শিল্পের আরও উন্নতি হবে'।
বিভিন্ন সবজির বীজ রপ্তানি করে বগুড়া সুনাম কুড়িয়েছে বলে দাবি করলেন এআর এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. আব্দুল ওয়াহিদ। তিনি বলেন, 'বগুড়া থেকে গত বছর ১ হাজার ৬০ মার্কিন ডলারের বীজ রপ্তানি করা হয়েছে। চলতি বছর নতুন বাজার খুলবে। এর মধ্যে ইতালি ও যুক্তরাষ্ট্রে বীজ পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে'।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, 'দেশের মধ্যে অনেক কারণে আশাজাগানিয়া জায়গা বগুড়া। বগুড়ায় তৈরি অনেক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। বগুড়ায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের অনেক বড় ক্ষেত্র হতে পারে। সেক্ষত্রে বগুড়া বিমানবন্দর তৈরি হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বিকশিত হবে। এতে তৈরি হবে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। ঘুচবে আরও বেকারত্ব'।