নারীর জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে মিয়ানমারের অভ্যুত্থান
মিয়ানমারে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তারা গত ১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক সরকারের পতন ঘটান। অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে সেনা শাসকরা এখন বেঁছে নিয়েছেন নির্মম দমননীতি। রাজপথে নামলেই নির্বিচার গুলিতে মৃত্যু বা গ্রেপ্তারের পর অজ্ঞাত কারাগারে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে নাগরিকদের। এসব ঘটনা দেশটির গণতন্ত্রের দিকে পথচলা রুদ্ধ করেছে, দেশটিজুড়ে আইনের শাসন দূর হয়ে দেখা যাচ্ছে অরাজক কালাকানুনের নৃশংস আবহ। তবে মিয়ানমারের নারীদের ওপর বিশেষ করে পড়েছে বিধ্বংসী প্রভাব।
অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারী- স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি ও তার নেতৃত্বাধীন এনএলডি সরকার। দারিদ্র্য কবলিত দেশটিতে গত এক দশকে নারীরা যতটুকু অগ্রগতির মুখ দেখেছিলেন, বন্দীশালার সীমানায় সু চি'র অন্তর্ধান- সেই সব অর্জন- যেমন; নারী ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব ও অধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি মুছে ফেলবে নিঃসন্দেহে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অতীতের কোনো অপরাধের জন্য জবাবদিহিতার মুখোমুখি হয়নি। বর্তমান অপরাধগুলোর জন্যেও তারা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে কৈফিয়তের পরোয়া করে না। অসীম এই ক্ষমতার অধিকারী সেনা প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান- আর সেটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। মিয়ানমারের সেনারা লিঙ্গ বৈষম্যে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। লিঙ্গ ভেদে নারী নির্যাতনেও অতীতে তাদের ভূমিকা ছিল ধিক্কারজনক। একসময় তাদের অধীনে পুরুষতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নারী নির্যাতনের কলঙ্কিত নাম ছিল মিয়ানমার।
সেনাদের তথাকথিত ভোটচুরি রক্ষার এই বানোয়াট বিপ্লবের আগে, মিয়ানমারের নারীদের সামনে উন্নতির ক্ষীণ আশার আলো দেখা দিয়েছিল। আনকোরা নতুন ও আধা-গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আলোআঁধারি ঘেরা গলিপথ পাড়ি দিয়ে গড়ে উঠছিল নারী পেশাজীবী ও নাগরিক সমাজের কাঠামো। তখনই গড়ে ওঠে অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীদের নাগরিক সংগঠন- জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি লীগ নেটওয়ার্ক এবং ওম্যান'স লীগ অব বার্মা'র মতো বড় সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অধুনা শিক্ষিত নারীদের সংঘবদ্ধ করে এবং প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও কুসংস্কারের কারণে সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার মতো বিশাল চ্যালেঞ্জ হাতে নেয়। নারী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কর্মশালা আয়োজন, তৃণমূল পর্যায়ে নারীকে ঘিরে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গী বদলানোর পরামর্শ সহযোগিতা এবং নির্বাচনে নারীদের প্রার্থী হতে উৎসাহ যোগানোর মতো কর্মসূচি চালিয়ে যায় এসব সংগঠন।
কর্মসূচিগুলো ব্যাপৃত ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যেও। পার্লামেন্টে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত শোয়ে শোয়ে সিন লাত- এর মতো নারী আইনপ্রণেতারা সেখানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন। তিনি নারীদের নাগরিক সংগঠনগুলিকে ইতোপূর্বে শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেখাশোনা করতেন এমন অনেক দায়িত্ব পালনের সুযোগ করে দেন। এক কথায়, নারী অধিকার প্রবক্তারা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে নারী অধিকার এবং ক্ষমতায়নে বেশকিছু নতুন ধারণা ও কৌশলের বীজ রোপণ করেন।
সত্যি বলতে কী- এসবের সুফল মেলাও শুরু করেছিল। তারই প্রতিফলন দেখা যায় রাজনৈতিক নেতৃত্বমূলক অবস্থানে নারীর শতকরা হার বৃদ্ধিতে। ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পার্লামেন্টের সকল পর্যায়ের সরকারি পদে ১৭ শতাংশ বিজয় লাভ করেন নারীরাই। ২০১৫ সালের নির্বাচনী ফলাফলের চাইতে যা ৪ শতাংশ বেশি। আর ২০১১ সালের তুলনায় এর পরিমাণ ১২ শতাংশ বেশি। অং সান সু চি নারী অধিকার বা ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের কট্টর সমর্থক না হলেও- তিনি ছিলেন নারী ক্ষমতায়নের প্রেরণার উৎস। তিনিই ছিলেন মিয়ানমারের প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান। ২০১৮ সালে মিয়ানমার লিঙ্গ বৈষম্যের বৈশ্বিক সারণী তালিকায় ১৪৮তম স্থান লাভ করেছিল, ২০১৯ সালে সেখান থেকে উন্নতি হয়ে ১১৮তম স্থান লাভ করে দেশটি। একথা সত্য, নারীর অগ্রগতি ছিল ধীরগতির এবং কিঞ্চিৎমাত্র, কিন্তু তা হচ্ছিল ধারাবাহিকভাবে। বিশেষ করে, পূর্ববর্তী সেনা জান্তা সরকারের সময়ে যেভাবে রাষ্ট্র ও সমাজে যৌন পরিচয়ের ভিত্তিতে বঞ্চণার আবহ তৈরি করা হয়েছিলে- গণতন্ত্রের এক দশকে আসে সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য উত্তরণ।
অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে এই অগ্রগতি আর আশা করা যায় না। কারণ, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার জন্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক পরিবর্তন দরকার তা বিরুপ মনোভাবের সেনা শাসনের অধীনে ঘটার সুযোগ একেবারেই নেই। এর সবচেয়ে বড় কারণ; মিয়ানমারের সেনা জান্তা হলো একটি পুরুষতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রতিনিধি, যাদের সবচেয়ে ভালো দৃষ্টিকোণেও নারীর পরিচয় শুধু সুরক্ষা পাওয়ার যোগ্য কোনো সামাজিক সত্তা। আর তাদের প্রচলিত বা সবচেয়ে বাজে দৃষ্টিকোণে নারী হলো; সিদ্ধান্ত গ্রহণের অযোগ্য। তেমন ক্ষমতা নারীর পাওয়া উচিৎ বলেও বিশ্বাস করে না সেনা শাসকেরা।
লিঙ্গ নিয়ে বিরুপ এই মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে অভ্যুত্থানের পর গঠিত ক্রিড়ানক সরকার গঠনের দিকে তাকালেই। সেখানে জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসহ আঞ্চলিক ও তৃণমূল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অপসারণ করে সেনাবাহিনী। অপসারিত সরকারের সাবেক এসব কর্মকর্তাদের জায়গায় আসা নতুন বহালদের প্রায় সকলেই পুরুষ। সর্বোচ্চ পর্যায়ের উদাহরণই দেওয়া যাক; অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী দ্বারা দেশ পরিচালনায় গঠিত ১৬ সদস্যের স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলে একজন সদস্য ডাও আয়ে নু সেইন বাদে বাকি সকলেই হচ্ছেন পুরুষ। এই ডাও আয়ে নু সেইনকে আবার নারী প্রতিনিধিত্বের জন্য স্থান দেওয়া হয়েছে এমনটি ভাবার কারণ নেই। কারণ, আরাকান ন্যাশনাল পার্টির এই সদস্য আগে থেকেই ছিলেন অং সান সু চি'র রাজনৈতিক দল এনএলডি'র কট্টর ও প্রকাশ্য সমালোচক।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে আরেক হাস্যকর ও উদ্ভট কাজ করে সেনা জান্তা। তারা স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের সদস্যদের স্ত্রীদের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেয় এবং সেটি বিশেষভাবে তুলে ধরে। সত্যিকার অর্থেই এটি ছিল রাজনৈতিক জীবনে নারীর প্রকৃত অংশগ্রহণে যে শূন্যতা তারা তৈরি করেছে- সেটি ঢাকার চেষ্টা মাত্র।
অর্ধ-শতাব্দী ধরে সেনা শাসনই ছিল মিয়ানমারে স্বাভাবিক ঘটনা। ব্যতিক্রম ছিল গণতন্ত্রের এক দশক। বজ্রমুষ্ঠিতে অতীতের সেনা শাসনকালে অর্থাৎ, ১৯৬২-২০১১ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে সমাজে ক্ষমতার আসন থেকে নারীরা হয়েছে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও তাদের অর্জন নিরুৎসাহিত করা হয়। সেই সেনা সরকার আবার ফিরে এসেছে। নারীর দুর্ভোগও তাই চরমে উঠবে আগামী দিনগুলোয়। সামান্যতম অর্জনগুলোও এই শাসন ব্যবস্থার অধীনে তাদের জন্য হয়ে উঠবে অলীক কল্পনার শামিল।
- সূত্র: ফরেন পলিসি থেকে সংক্ষেপিত
- লেখকদ্বয়: মিশেল ওনেল্লো- আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী এবং গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টারের জ্যেষ্ঠ আইনি পরামর্শক।
- আকিলা রাধাকৃষণান: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী গ্লোবাল জাস্টিস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। সংস্থাটি লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে, পাশাপাশি যৌন সহিংসতার ন্যায়বিচার ও গর্ভধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেও কাজ করে।