টিসিবির গাড়ি থেকে পচা পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য ক্রেতারা!
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সারা দেশে গ্রাহকদের সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো মানের পণ্য দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও টিসিবির গাড়ি থেকে নিম্নমানের পঁচা পেঁয়াজ কিনতে বাধ্য হচ্ছে গ্রাহকরা। গ্রাহকদের অভিযোগ এ পেঁয়াজ না নিলে অন্য কিছু বিক্রি করছে না তাদের কাছে। ডিলাররা বলছেন তাদেরকে গুদাম থেকেই পচা পেঁয়াজ দেওয়া হয় এবং বাধ্য হয়ে গ্রাহকদের কাছে সেগুলো বিক্রি করছেন।
তবে টিসিবি বলছে ডিলারদেরকে পচা পেঁয়াজ বেছে আলাদা করে বিক্রি করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে এমনকি পচা পেঁয়াজ থাকলে এর সাথে অতিরিক্ত পেঁয়াজও ডিলারদেরকে দেওয়া হয় যাতে পচা নষ্ট পিঁয়াজগুলো গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করা না হয়।
রাজধানীর ফার্মগেট, শাহবাগ, হাতিরপুল, প্রেসক্লাবসহ বেশ কয়েকটি স্থানে টিসিবির পণ্য বিক্রির স্থান ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশ স্থানের ট্রাকেই প্যাকেজের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। যে প্যাকেজগুলোর সাথে পেঁয়াজ বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। গ্রাহকদের কাছে পেঁয়াজ ও ছোলার চাহিদা কম থাকায় কোথাও কোথাও পেঁয়াজ কিংবা ছোলা বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হচ্ছে। তবে ২/১ টি ট্রাকে আলাদা আলাদা বিক্রি করতেও দেখা যায়।
ফার্মগেটের টিসিবি এর পণ্য বিক্রির ট্রাক থেকে পেঁয়াজ, তেল, ডাল কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন ফরিদা আক্তার। কিছুদূর গিয়ে লক্ষ্য করেন তার পেঁয়াজের অধিকাংশই পচা। এটা লক্ষ্য করে বিক্রেতার কাছ থেকে পরিবর্তন করে নেন। এবারে ভালো পেঁয়াজ দিয়েছে কিনা পরখ করার জন্য ব্যাগটি খুলে একটি করে পেঁয়াজ দেখছিলেন আর পচাগুলো আলাদা করেছিলেন। তিনি দেখলেন তার ৬০% পেঁয়াজই পঁচা।
ফরিদা আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'আমার তেল আর ডাল দরকার ছিল কিন্তু ওরা পেঁ য়াজ না নেওয়ায় কিছুই দিচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ৫ কেজি পেঁয়াজ নিয়েছি কিন্তু দেখি অধিকাংশই পচা। একবার পরিবর্তন করে নিলাম এর পরেও যদি এত পচা হয়'!
শুধু ফরিদা আক্তারই নন, টিসিবির পণ্য কিনতে গিয়ে সারাদেশই এ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে নিয়মিত। একদিকে প্যাকেজের বিড়ম্বনা অন্যদিকে পচা পণ্য।
খাবার অযোগ্য পচা পেঁয়াজ না কিনলে ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে না সয়াবিন তেল, চিনি, ছোলা, খেজুরসহ টিসিবির অন্যান্য পণ্য। ফলে বাধ্য হয়েই ক্রেতাদেরকে পচা ও খাবার অযোগ্য পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে।
এদিকে টিসিবির পণ্য বিক্রির অন্যতম শর্ত হলো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়-বিক্রয় করা কিন্তু তা মানছে না অধিকাংশই। এসব নিয়ে প্রশাসনেরও তেমন কোনো তদারকি নেই।
টিসিবির পণ্যের ক্রেতা আউয়াল হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'টিসিবির পণ্য একটু কম দামে পাওয়ার কারণে ১.৫/২ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কিনি। তেল, চিনি, ডাল নেওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে সাথে পেঁয়াজও নিতে হয়। মাঝে মাঝে ভালো পেঁয়াজ থাকে তবে এ রমজানের পেঁয়াজ হয় কালো দাগ পড়া না হয় পচা। উপরের অংশ ফেলে খেতে হয়'।
ক্রেতারা জানান, পচা পেঁয়াজ না কিনলে অন্য কোন পণ্য দেয়া হচ্ছে না। এক প্রকার বাধ্য হয়েই কিনতে হচ্ছে। আবার খেজুর মাঝে মাঝে খুব ভালোটা দেয় আবার কখনও খুবই নিম্নমানেরগুলো কিনতে হয়।
ডিলার সামসুল আলমের প্রতিনিধি হিসেবে ফার্মগেটে বিক্রি করা ট্রাকের প্রতিনিধি মো. জামাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের পচা পেঁয়াজ দিলে তো সেটাই বিক্রি করতে হবে। আমরাও তো কিনে বিক্রি করি। আবার এ পেঁয়াজ একদিন রেখেও বিক্রি করা সম্ভব না তাই অন্য পণ্যের সাথে যেই দিনের পণ্য ঐ দিনই বিক্রি করে ফেলি'।
হাতিরপুল কাঁচাবাজারের টিসিবির ট্রাক থেকে নিয়মিত পণ্য ক্রয় করা ডালিম হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এখানে প্যাকেজের বাহিরে কাউকে পণ্য দেয় না। ২ লিটার তেলের সাথে ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনতে হয়। এখান থেকে ৩ কেজি পেঁয়াজ টিকে (ভালো থাকে)'।
ডিলার সিনথিয়া জেনারেল স্টোর এর প্রতিনিধি হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা কাইউম টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের আগের দিন টিসিবিকে টাকা জমা দিতে হয় দেন পরের দিন ট্রাকে পণ্য দেয়। তারা কি কি দিবে তারাই জানে। একথা বাহিরে বলাও নিষেধ'।
'পেঁয়াজগুলো আমদানি করা ও গুদামে থাকার ফলে কিছু নষ্ট হয়ে যায়। তবে আমরা পচাগুলো ফেলে দেই। এরপরেও ২/১ টা ভিতরে থেকে যেতে পারে। আমরা প্যাকেজ ছাড়াও আলাদা আলাদা বিক্রি করি'।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার এক ডিলার বলেন, 'টিসিবির পণ্য নিতেও আমাদের বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। গুদাম থেকেই আমাদের পচা পেঁয়াজ দেওয়া হয়। এখন যে লাভ হয় সেখানে যদি পেঁয়াজ বিক্রি করতে না পারি তাহলে এ ব্যবসায় আমার লাভ কি? এরপরেও মাঝে মাঝে অনেককে আলাদা কিছু নিতে চাইলে দেওয়া হয়'।
ঢাকার ৩৪৪/সি, তেজগাঁও গুদামের গুদাম কর্মকর্তা মোঃ সাইদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্যাকেজে টিসিবির পণ্য বিক্রি করার কোনো নির্দেশনা নেই তবে পেঁয়াজ ও ছোলার চাহিদা কম থাকায় ডিলাররা প্যাকেজে বিক্রি করছেন। তবে কোনো ক্রেতা আলাদাভাবে নিতে চাইলে বিক্রয়কারীরা দিতে বাধ্য'।
'পেঁয়াজ বাহির থেকে আসে বলে কিছু কালো হয়ে যায় এবং অনেকে বড় পেঁয়াজ পছন্দ করে না বলে মনে করে পেঁয়াজ নষ্ট, তবে কালো হলেই পেঁয়াজ নষ্ট হয় না। আর নষ্ট পেঁয়াজ বিক্রি না করার জন্য অফিশিয়ালি নির্দেশনা দেওয়া আছে'।
চট্টগ্রামের বন্দরটিলায় টিসিবি আঞ্চলিক কার্যালয়ের গুদাম কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'পেঁয়াজ যেহেতু একটি পচনশীল পণ্য সেহেতু কিছু পেঁয়াজ পচা হতে পারে। অনেক সময় দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতে হয় এর কারনে কিছু নষ্ট হয়ে যায়। আবার পেঁয়াজের মধ্যে কিছু আছে নতুন আবার কিছু আগের মজুদ করা। তবে ডিলারের এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই যে এতো কেজি পেঁয়াজ নিতেই হবে'।
টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির টিবিএসকে বলেন, 'প্রতিদিন ঢাকাতে ১০০ টিসহ সারাদেশে প্রায় ৫০০ টি ট্রাকে প্রায় ৩০০০ ডিলারের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হয়। টিসিবির অফিশিয়ালিভাবে প্যাকেজ আকারে কোনো পণ্য বিক্রির নির্দেশনা নেই'।
মানবিক দিক বিবেচনা করে পেঁয়াজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অন্য পণ্য বিক্রিতে বাঁধা দেওয়া হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'পচনশীল পণ্য হলে আমরা একটু বিবেচনা করি ডিলারদের যেন তারা প্রতিদিনের পণ্য বিক্রি করে ফেলতে পারেন। তবে অ ন্য ক্ষেত্রে প্যাকেজ কিংবা বাধ্যতামূলকভাবে একটার সাথে আর একটা নিতেই হবে এমন বিষয়ে অভিযোগ আসলে আমরা সাথে সাথে ব্যবস্থা নেই'।
যদি বস্তার মধ্যে পচা পেঁয়াজ থাকে সেখানে মোট পরিমাণের সাথে আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'রবিবারও এক ট্রাকে ৩৬০০ কেজি পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা ডিলারকে ১৮ হাজার টাকা কমিশন দিয়েছি। এছাড়া গুদামে রাখার কারণে বস্তায় পচা পেঁয়াজ থাকলে আমরা বেশি দেই। এরপরেও ভোক্তাদের পচা পেঁয়াজ দেওয়ার কথা না। আমরাই তাদেরকে পচা পেঁয়াজ ফেলে দেওয়ার জন্য বলে দেই'।