মহামারি রোধে আশা জাগানো ভারতে কেন মৃত্যুর বিশ্বরেকর্ড?
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছেন সাগর কিশোর নাহারশিতিভার, ভ্যানের পেছনে অক্সিজেনের সিলিন্ডার সঙ্গে নিয়ে শুয়ে আছেন তার বাবা। কোভিড আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে তিনটি আলাদা শহরের হাসপাতাল, এমনকি মহারাষ্ট্র থেকে তেলেঙ্গানা পর্যন্ত ঘুরেও কোনো হাসপাতালে জায়গা পাননি। সব হাসপাতালই রোগীতে ভর্তি।
কিন্তু, তাই বলে বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে নারাজ নাহারশিতিভার। মাস্কের বদলে গোলাপি ব্যান্ডেনা মুখে বাঁধা তার, স্থানীয় এক টিভি চ্যানেলকে জানালেন, ২৪ ঘন্টা ধরে ভ্যান চালাচ্ছেন। বাবার দিকে ভীতসন্তস্ত্র ভাবে তাকিয়ে তিনি বললেন, "বাবার অক্সিজেন শেষ হয়ে আসছে!"
বুধবার দিল্লী থেকে ৮০০ মাইল দূরের একটি হাসপাতালে দেখা গেল করোনায় মৃত রোগীরা মেঝেতে পড়ে আছে। স্বজনেরা তাদের লাশ নিতে ভিড় করলেও প্রবেশপথ পার হতে পারেননি।
ভারতের পশ্চিম প্রান্তের রাজ্য গুজরাটে মার্কিন গণমাধ্যম এনপিআর'-এর প্রতিবেদক দেখেন স্বজনের মৃতদেহের উপর পড়ে আহাজারি করছেন এক ব্যক্তি। জানা যায়, মৃত ব্যক্তি ক্যান্সারের রোগী ও একই সাথে করোনা আক্রান্তও ছিলেন। হাসপাতালে প্রচন্ড ভিড় থাকায় তিনিও সেবা পাননি। এর জন্যে কে দায়ী তা নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে।
হুট করেই করোনাভাইরাসের প্রকোপ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় ভারতজুড়ে ভেঙে পড়েছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। দেশটির প্রায় সর্বত্র হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দেখা যাচ্ছে বীভৎস দৃশ্য। বৃহস্পতিবার ভারতে একদিনে নতুন করে করোনাক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ১৫ হাজার জন। মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এটিই কোনো দেশে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আগামী দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলাও ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন ভারতীয়রা। লুট ঠেকাতে অক্সিজেন ট্যাঙ্কার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিশি পাহারায়, কালোবাজারে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ক্রয়-বিক্রয় বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহস্পতিবার হরিয়ানায় হাসপাতালের গুদাম থেকে ভ্যাকসিন চুরি গিয়েছে, যদিও চোর পরে তা ক্ষমা চেয়ে ফেরত দিয়ে যায়।
হাসপাতালে গিয়ে আর কোনো লাভ নেই মনে করে লোকজন বাড়িতেই অক্সিজেন মজুত করে রাখছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঢুকলেই দেখা যাচ্ছে হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন, ভ্যাকসিনের জন্য ভারতীয়দের আকুতি। এমনকি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্তও একজন সাংবাদিক তার অক্সিজেন লেভেল কমতে থাকা নিয়ে লাইভ টুইট করেছেন। ডাক্তাররাও নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জানাচ্ছেন, এরকম বিপর্যয় আর কোনদিন দেখেননি তারা।
হঠাৎ সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ কি?
এই মুহূর্তে লেখচিত্রে ভারতের করোনা সংক্রমণের দিকে তাকালে দেখা যাবে, নতুন সংক্রমণের মাত্রা বক্ররেখায় নয়, বরং খাড়া দেওয়ালের মত সোজা উর্ধ্বরেখায় চলে গিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতেই সর্বনিম্ন সংক্রমণ রেকর্ড করার পরই আবার সর্বোচ্চ করোনা আক্রান্তের বিশ্বরেকর্ড গড়লো ভারত।
মহামারিবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা কে শ্রীনাথ রেড্ডি বলেন, "আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থেকে ধরে নীতিনির্ধারকরা পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলেন যে ভারতে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ আসবে না। দুর্ভাগ্যবশত, তাদের এ বিশ্বাসের কারণেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছে, সীমিত পর্যায়ে্র নামে ভ্রমণ, স্থানীয় নির্বাচন, ধর্মীয় উৎসবে জড়ো হওয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান ইত্যাদি শুরু করে দেওয়ার ফলেই ব্যাপক হারে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে ভাইরাসের নতুন নতুন ধরনের দ্বারা তা দ্রুত গতি পেয়েছে।"
গত মাসে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ভারতে করোনাভাইরাসের মোট ৭৭১ টি ধরন পেয়েছে। এর মধ্যে লন্ডন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের 'ডাবল মিউট্যান্ট' ধরনও রয়েছে। ভারতীয় গবেষকরা জানিয়েছেন, এই ভ্যারিয়ান্টের দুটি মিউটেশন দ্বারা সংক্রমণ অনেক বাড়তে পারে কিনা তা তারা পরীক্ষা করে দেখছেন।
দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া ব্যক্তিরাও আবার অসুস্থ হয়ে পড়ছেন এমন খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারের পর জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন ৮৮ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও। দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অসুস্থ হয়ে তাকে তিন সপ্তাহ হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। তবে এখন তিনি সুস্থ আছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা নিয়ে আসলেই এতটা সন্দেহ করার কারণ নেই। ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষদের মধ্য থেকে কতজন কোন ধরন দ্বারা আবার আক্রান্ত হয়েছেন-তা এখনও স্পষ্ট নয়। ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা মোট ১৪০ কোটি জনসংখ্যার জন্য ১৩ কোটি ২০ লাখ ভ্যাকসিনের ডোজ ইঞ্জেকশন দিতে পেরেছেন এপর্যন্ত।
তার মানে দাঁড়ায় এই যে, ১০% এরও কম মানুষ এক ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন এবং ২% এরও কম মানুষ দুই ডোজ পেয়েছেন। মঙ্গলবার ভারত সরকারের প্রদত্ত ডেটা অনুযায়ী, মাত্র ০ দশমিক ৩ বা ০ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এই মুহূর্তে ভারত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ভারত বায়োটেকের অন্য একটি ভ্যাকসিন জনগণকে দিচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গণিতবিদ ক্রিস্টিনা প্যাগেল কাজ করছেন ভাইরাসের ভ্যারিয়ান্ট অনুসন্ধান নিয়ে। তিনি বলেন, এই স্ট্রেইন [B1617] সবচেয়ে খারাপ এবং ভারতের জন্যেও দুঃসংবাদ। তবে বিভিন্ন দেশে মানুষ আসা-যাওয়া বন্ধের ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা নিলে হয়তো এটি সব দেশে ছড়ানো বন্ধ করা যাবে। আমাদের এখনই প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে হবে।'
এ সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্র ভারতের উপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন আমেরিকানদের ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলেও ভারত ভ্রমণ করতে নিষেধ করেছে।
একটি নির্মম বিশ্ব রেকর্ড:
সিডিসির সূত্র অনুযায়ী, গেল বৃহস্পতিবার ভারতের দৈনিক কোভিড পরিসংখ্যান ঘোষণা করা হলে দেখা যায়- তা গত ৮ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে একদিনে সর্বোচ্চ আক্রান্তের যে বিশ্ব রেকর্ড হয়েছিল, ভারত ৩১৩,৩১০ জন শনাক্ত নিয়ে সে সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবুও ভারতে টেস্টিং কিটের স্বল্পতা রয়েছে, তাই বর্তমান আক্রান্তের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরো বেশিও হতে পারে।
গত ২৪ ঘন্টায় ২,১০৪ মৃত্যু নিয়ে ভারতে একদিনে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাটাও আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু, প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হতে পারে পারে, কারণ বহু ভারতীয় হাসপাতালের বাইরেই মারা গেছেন। মর্গগুলোতে স্তুপীকৃত হচ্ছে লাশ, এমনকি শ্মশানগুলোও লাশ দাহ করে কুলোতে পারছে না।
মঙ্গলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, "করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ একটা ঝড়ের মতো এসেছে।"
দুর্যোগ প্রতিরোধে মোদির কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, তারা ১ মে থেকে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাইকে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করবে। কিন্তু এ মাসের শুরুতেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে শত শত ক্লিনিকে টিকার ডোজ ফুরিয়ে গেছে বলে জানা যায়। জনসাধারণ প্রতিষেধক নিতে এসে 'সরবরাহের অভাব টিকাদান বন্ধ' লেখা দেখে হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
গর্বের সঙ্গে নিজেদের বিশ্বের শীর্ষ ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে দাবি করা ভারতের ভাগ্যে যেন এটি এক অপ্রত্যাশিত মোড়। তবে চলমান ভ্যাকসিন স্বল্পতার মধ্যেই ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সিইও এক টুইট বার্তায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন ভ্যাকসিনের কাঁচামাল রপ্তানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে। সেরাম ইনস্টিটিউট নিজেরা ভ্যাকসিন বানালেও এর কাঁচামাল তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করতো। সোমবারই ভারত সরকার সেরাম-এর ভ্যাকসিন উৎপাদন বাড়াতে ৬১ কোটি ডলার তহবিল অনুমোদন দিয়েছে।
তবে ভারতের বিরোধী দলগুলোর দাবি, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে মোদি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কয়েক সপ্তাহ আগেই তিনি পশ্চিমবঙ্গে বিশাল নির্বাচনী র্যালি করেছেন। বৃহস্পতিবারই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ'র অন্তত তিনটি র্যালি ছিল, যদিও তাতে লোকসংখ্যা ছিল ৫০০ এর মধ্যে।
এছাড়াও, ভারতীয় কর্মকর্তারা এ মাসে অনুষ্ঠিত 'কুম্ভ মেলা' স্থগিত রাখতে রাজি হননি। কুম্ভ মেলা বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি জনসমাগমপূর্ণ ধর্মীয় মেলা যা গঙ্গার তীরে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে হাজার হাজার ভক্ত জড়ো হয় এবং এরপর অন্তত একজন ধর্মীয় নেতার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। গত সপ্তাহান্তে মোদি টুইট বার্তায় জানান, কুম্ভ মেলার বাকি অংশ 'প্রতীকী' ভাবে অনুষ্ঠিত হবে।
মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে মোদি আরো একটি জাতীয় লকডাউনের সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, একেবারে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দেয়া হবে। তিনি জনগণকে লকডাউন এড়িয়েই যতটা সম্ভব সুরক্ষিত থাকতে এবং 'মাইক্রো কন্টেইমেন্ট জোন' এ নজর দিতে বলেন।
উদাহরণস্বরূপ, যে ভবনে করোনা পজিটিভ মানুষ পাওয়া যাবে তা সীলগালা করে দেয়া হবে, কেউ বেরোতে বা ঢুকতে পারবে না।
ভারতের দুটি বড় শহর, দিল্লী ও মুম্বাইয়ে ইতিমধ্যেই স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউন দিয়ে দেয়া হয়েছে। ফ্রন্টলাইন কর্মীরা ছাড়া বাকি সবাইকে বাসায় থেকেই কাজ করতে বলা হয়েছে। বাইরে ঘোরাফেরা বা জগিং করতে গেলেও জরিমানা করা হবে বলা জানানো হয়।
২০২০ সালে মার্চে যখন ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল, মোদি তখনই বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাতীয় লকডাউন ঘোষণা করেন। সেসময় চার ঘন্টার নোটিশে এটি কার্যকর করা হয়। তখন ভারতের অর্থনীতি কমে যায় ২৪ শতাংশ এবং অভিবাসী শ্রমিকরা না খেতে পেয়ে পথে বসেছিল।
এ সপ্তাহে দিল্লিতে নতুন বিধিনিষেধের মধ্য দিয়েই শহরের মূল বাস স্টেশনে দেখা যায় অভিবাসী শ্রমিকদের ভিড়। শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে অনাহার থেকে বাঁচতে চাইছেন তারা। আর সেখানে সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছিল না বললেই চলে।
আবারও, যদি দক্ষিণ ভারতের সাগর কিশোর নাহারশিতিভারের কাছে ফিরে যাই, তিনি তখন নিজের বাবাকে বাঁচানোর যুদ্ধে রত। কিন্তু, তিনি জানেন না কতক্ষণ এভাবে চলবে। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে নিজের আকুতি জানালেন তিনি, "যদি আমার বাবাকে হাসপাতালে জায়গা না দিতে পারেন, অন্তত তাকে একটা ইনজেকশন দেয়ার মত ডাক্তার এনে দিন। তাকে না ভুগিয়ে শান্তিতে মৃত্যু দিন অন্তত!"
- সূত্র: এনপিআর
- অনুবাদ: খুশনূর বাশার জয়া