প্রতিবাদের ভাষা মিম
ওয়াল স্ট্রিট দখল করো Occupy Wall Street (OWS)
ওয়াল স্ট্রিট দখল করো আন্দোলন আর মিম সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ গত এক যুগ ধরে মিলেমিশে বিকশিত হয়েছে।
নিউ ইয়র্ক তখন ছিল ডাচ কলোনি। তারা শহরের নাম পাল্টে দিল- নিউ আমস্টারডাম। কিন্তু নিরাপত্তার আশঙ্কা রয়েই যায়। ব্রিটিশরা আক্রমণ করতে পারে, ইন্ডিয়ানরা লুটপাট করতে পারে আর জলদস্যু তো আছেই। প্রতিরক্ষার জন্য ডাচ গভর্নরের নির্দেশে ১৬৫২ সালে বড় কাঠের তক্তা দিয়ে নয় ফুট উঁচু এবং ২৩৪০ ফুট দীর্ঘ কাঠের দেয়াল নির্মাণ করা হলো, খরচ ৫০০০ গিল্ডার। শ্রমিকরা সবাই ছিল ক্রীতদাস। দেয়ালের কারণে রাস্তাটির নাম হয়ে গেল ওয়াল স্ট্রিট। ১৭১১ সালে এটি হয়ে উঠল নিউ ইয়র্ক সিটির দাস ব্যবসায়ের বৈধ বাজার। এ কালে কর্পোরেট শোষণেরও প্রতীক ওয়াল স্ট্রিট। নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনটি হচ্ছে ১১ নম্বর ওয়াল স্ট্রিট। বলা অবশ্যক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল নামের বিখ্যাত পত্রিকাটির অফিস এখানে নয়, ১২১১ আমেরিকা অ্যাভিনিউতে। স্টক, বন্ড, হেজ ফান্ড, ব্যাঙ্ক, সিকিউরিটিজ সবকিছু মিলিয়ে আমেরিকার ধনতন্ত্রবাদের প্রতীকী পরিচয় ওয়াল স্ট্রিট। ১৯২৯-এর ২৪ অক্টোবর ব্ল্যাক থার্স্টডেতে ওয়াল স্ট্রিটে ধ্বসই পৃথিবীতে মহামন্দার সূত্রপাত করে।
খুবই সাদামাটা একটি মিম অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনকে সংগঠিত করেছে: 'আমরাই ৯৯%' কিংবা 'উই আর নাইনটি নাইন পাসেন্ট'। এই কথা বুঝিয়ে দেয় আয় বৈষম্যের ভয়ঙ্কর একটি চিত্র। ১ ভাগ মানুষের হাতে তাবৎ সম্পদ আর ৯৯ ভাগ মানুষ বেঁচে থাকার তীব্র লড়াই করে যাচ্ছে। এই মানুষেরাই আয় বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাতে ওয়াল স্ট্রিট্রের একটি পার্ক দখল করল ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১; ধীরে ধীরে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে লাগল তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আন্দোলনকারীদের দাবি সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য দূর করতে হবে, কর্পোরেশনের লোভ দূর্নীতি ও সরকারের উপর অন্যায় প্রভাব খাটানো বন্ধ করতে হবে।
১৫ নভেম্বর প্রতিবাদকারীদের পুলিশ বল প্রয়োগ করে পার্ক থেকে বের করে দেয়।
তারা যা চেয়েছে তা মোটেও অযৌক্তিক নয়-রাজনীতি কর্পোরেট প্রভাব কেনো থাকবে? বেকারত্ব কেন কমবে না? তরুণরা ভালো চাকরি কেনো পাবে না? স্টুডেন্ট লোনের বোঝা কেনো তুলে নেওয়া হবে না? সুতরাং সরকারকে বাধ্য করতে তারা 'এ মিলিয়ন মার্চ অন দ্য স্ট্রিট' আয়োজন করে।
ওয়াল স্ট্রিটের পার্কে দখলদার
অবস্থানকালীন সময়টা ভালো কাটাবার জন্য আন্দোলনকারীরা ৫৫৫৪টি গ্রন্থের একটি অস্থায়ী লাইব্রেরি স্থাপন করে, পার্ক এলাকায় ইন্টারনেট সংযোজন দেওয়া হয়। এবং আন্দোলনটি বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা প্রকাশ করে 'দ্য অকুপাইড ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল' প্রথম দিন ৭০০০০ কপি ছাপা হয়। অকুপ্রিন্ট নামে জার্নাল, দ্য অকুপাই গেজেট, টাইডাল অকুপাই থিওরি, অকুপাই স্ট্যাটেজি ম্যাগাজিনও তারা প্রকাশ করে। তাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়, অনেকগুলো মামলা ম্যাজিস্ট্রেট খারিজ করে দেন। তবে পুলিশকে আক্রমণ ও আহত করার অভিযোগে কারো কারো স্বল্প মেয়াদের কারাদন্ড হয়। তবে ঘন্টায় ১৫ ডলার ন্যুনতম মজুরির দাবিটি আরো জোরদার হয়। অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় মিম।
এই আন্দোলন নিয়ে বহুল প্রচারিত ১০টি মিম :
আমেরিকা'স তাহরির মোমেন্ট
১. মিশরের তাহরির স্কোয়ার আন্দোলনের প্রতিফলন ঘটল: 'আমেরিকা'স তাহরির মোমেন্ট'-এ। কানাডার ভোগবাদ বিরোধী ম্যাগাজিন অ্যাডবাস্টার ১৩ জুলাই ২০১১ লিখেছে: আমরা চাই ১৭ সেপ্টেম্বর ২০,০০০ মানুষের একটি বন্যা লোয়ার মানহাটানে (ওয়াল স্ট্রিট এলাকা) ঢুকে পড়বে। তাবু গড়বে, রান্না ঘর বানাবে শান্তিপূর্ণ ব্যারিকেড দিয়ে কয়েক মাস ধরে ওয়াল স্ট্রিট এলাকা দখল করে রাখবে। একবার তা হাসিল করতে পারলে অসংখ্য স্বরে একটি দাবি পুনঃপুণ উচ্চারিত হতে থাকবে।
২. দ্য ব্যালেরিনা অ্যান্ড দ্য বুল: প্রতিবাদকারীরা পার্কে ঢুকে পড়ল। ১৭ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখল আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত স্টার স্প্যাঙ্গলড ব্যানার গাইতে গাইতে তারা পার্কে প্রবেশ করল। ব্রডওয়ের ৭১০০ পাউন্ড ওজনের বুল বা ষাড় ভাষ্কর্যের উপর একজন নৃত্যরত ব্যালে শিল্পীর মিম ভাইরাল হলো- এ ছবি এই বার্তা দিল যে চাইলে অবিশ্বাস্য কিছু ঘটানো সম্ভব।
৩. ক্রিস নামে 'কম বেতন পাওয়া কিন্তু বেশি কাজ করা' একজন তার মতো হাজার মানুষের কথা এক বাক্যে লিখে ২৩ আগস্ট ২০১১ একটি পোস্ট দিলেন, We are 99% ' আমরাই শতকরা ৯৯ ভাগ; আর এটাই হয়ে গেল আন্দোলননের প্রধান স্লোগান।
৪. কেইলি ডেডরিক নামের ২৪ বছর বয়সী এক নারী আন্দোলনের সময় নিউ ইয়র্ক পুলিশের ইন্সপেক্টর বোলোনিয়ার পেপার স্প্রের শিকার হন। এই ছবিটিই মিম হিসেবে ভাইরাল হয়ে যায়। সে সময় অপর একজন প্রতিবাদকারী রবার্ট গ্রড এসে তার শুশ্রূষা করে। পার্কেই তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে। ২০১২ তে তাদের একটি কন্যাসন্তান হয়। বরার্ট ২০১৭-র জুলাই মাসে কুর্দিশ মিলিশিয়াদের পক্ষে সিরিয়ায় কাজ করার সময় নিহত হয়। সন্তানসহ কেইলি ও রবার্টের ছবিই এখন অনেক কথা বলে।
৫. ২০০৮ সালের আইকনিক ছবি HOPE–এর শিল্পী শেপার্ড ফ্রেইরি অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের জন্য বেশ ক'টি পোস্টার এঁকে দিয়েছেন। এগুলোই প্রতিবাদী মিম হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে।
৬. 'হ্যাঙ্গিং ব্যাঙ্কার' সবচেয়ে স্মরণীয় মিমগুলোর একটি। একজন স্ট্রিট আর্টিস্ট ওয়াল স্ট্রিট ব্যাঙ্কারের করুণ পরিণতির ছবি নির্মাণ করেছেন। নিচে লেখা আছে: তাকে পর্যাপ্ত দড়ি দিন, সে নিজেই নিজেকে ঝোলাবে।
৭. ডেভিস পেপার স্প্রে ইনসিডেন্ট: অকারনেই নির্বিকারভাবে পুলিশ লেফটেন্যান্ট জন পাইক পুরো এক ক্যান পেপার স্প্রে ছড়াল ওয়াল স্ট্রিটের আন্দোলনকারীদের ওপর। আন্দোলনকারীরা শন্তিপূর্ণভাবে জড় হয়ে বসেছিল। তার পেপার স্প্রে মারার ভিডিও ভাইরাল হয়, এ পুলিশ পরে চাকরি হারায়।
৮. লেফ্টেন্যান্ট জন পাইককে নিয়ে আর একটি মিম: অ্যান এন্ডলেস স্ট্রিট।
৯. পুলিশ ব্রুটালিটি কালারিং বুক: ৪৮ পৃষ্ঠার বই। পুলিশি নির্মমতার ছবি। বইয়ের প্রচ্ছদটিই অন্যতম সেরা মিম।
১০. ব্যাট সিগন্যাল: ওয়াল স্ট্রিটের পার্ক থেকে পুলিশ শক্তি খাটিয়ে আন্দোলনকারীদের উচ্ছেদের পর, শিল্পী মার্ক রিড ৩৭৫ পার্ল স্ট্রিটে আসার বার্তা দিচ্ছেন ব্যাটম্যানের প্রতীক ব্যবহার করে।
একইরকম সিসেম স্ট্রিট থেকেও দাবি ওঠে: ১ ভাগ দানব পৃথিবীর ৯৯ ভাগ কুকিস খেয়ে ফেলছে। সুতরাং সিসেম স্ট্রিট দখল কর।