আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোতে
কোভিড পরিস্থিতিতে বাস্তবায়ন কাজের গতি কমলেও আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত 'ফাস্ট ট্র্যাক' প্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দের তুলনায় আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে ৩১.৮১%। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের মূল বরাদ্দ থেকে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোতে বরাদ্দ বাড়ছে ৮.২২ %।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বরাদ্দের চেয়ে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ছে পদ্মা সেতু, দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং পায়রা বন্দরের দুই প্রকল্পে।
অন্য দিকে চলতি অর্থবছরের তুলনায় বরাদ্দ কমছে পদ্মা রেল সংযোগ এবং মেট্রোরেল উত্তরা থেকে থেকে মতিঝিল প্রকল্পে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্তকর্তারা জানান, আগামী অর্থবছরের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে পরিকল্পনা কমিশন। ইতোমধ্যে আগামী অর্থবছরের ২,২৫০০০ কোটি টাকার এডিপির সিলিং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেছে। পরিকল্পনা কমিশন এ সিলিংয়ের অর্থ বন্টনের কাজ করছে, যা চূড়ান্ত হবে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায়।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের সদস্য ও পরিকল্পনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ জয়নুল বারী টিবিএসকে জানান, সাধারণত সরকারের অগ্রাধিকার প্রাপ্ত প্রকল্প হওয়ায় ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে না।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, কোভিড ও লকডাউন পরিস্থিতিতে ধীরগতিতে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চললেও আগামী অর্থবছরে কাজের গতি বাড়বে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা রয়ে গেছে।
একই কারণে চলতি অর্থবছরে মূল এডিপিতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বাস্তবায়ন কাজে ধীর গতি থাকায় অর্থ ব্যয়ও কমনো হয়। ফলে অর্থবছরের মাঝপথে এডিপি সংশোধন করে বেশিরভাগ প্রকল্পেরই বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তবে চাহিদা বেশি থাকায় পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের বরাদ্দ বেড়েছে। আবার বরাদ্দ অপরিবর্তীত ছিল মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পে।
সূত্র জানায়, আগামী এডিপিতে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প ছাড়া এডিপিভুক্ত সাত ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ৩৯০২৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এ বরাদ্দ ছিল ৩৬০৬০ কোটি টাকা। যা সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ২৯৬০৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
আগামী অর্থবছরের পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে সেতু বিভাগ। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাকি ১৫ শতাংশ কাজ শেষ করতে ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বাস্তবায়ন কাজ চালিয়ে যেতে বেশ কিছু কৌশলও নিয়েছে সেতু বিভাগ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরিচালক শফিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বাস্তবায়ন কাজ চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে। তারপরও করোনা পরিস্থিতিতে পদ্মা সেতুর কাজ ধীরগতিতে চলছে। এখনও ২০% চাইনিজ বিশেষজ্ঞ প্রকল্প এলাকায় নেই। তারপরও নির্ধারিত ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কর্মকৌশল নেওয়া হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, কোভিড পরিস্থিতিতেও সেতুর কাজ অব্যাহত রাখা এবং কার্যক্রম কাঙ্খিত মাত্রায় বৃদ্ধি করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে সেতু কাজে নিয়োজিত দেশী-বিদেশী পরামর্শক এবং চীনের টেকনিশিয়ানদের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক রয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় পুরো সেতু প্রকল্প এলাকায় লকডাউন করা হয়েছে।
এছাড়া উন্নত মানের বেড, অক্সিজেন সরবরাহসহ নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং সার্বক্ষণিক চারজন ডাক্তার, নার্স ও সহযোগী কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে। ফলে সব দেশী এবং অধিকাংশ বিদেশী প্রকৌশলী প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
মূল সেতুর ঠিকাদার প্রকল্পে এলাকায় প্রায় ২৫০০ জন শ্রমিকের থাকা-খাওয়াসহ সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।
সংশোধিত এডিপির তুলনায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়লেও কমছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলছেন, চলতি অর্থবছরে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে বাস্তবায়ন কাজে গতি ছিল, এ কারণে চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির চেয়ে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। বাস্তবায়ন কাজে গতি ধরে রাখা গেলেও আগামী অর্থবছরেও অর্থ ব্যয় বাড়বে। কিন্ত মধ্য মেয়াদী বাজেট কাঠামোর কারণে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে কিছুটা কম বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। তবে আগামী অর্থ বছরের সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
তিনি আরও জানান এ প্রকল্পে এখন প্রায় ৭০০ চীনা প্রকৌশলী ও দক্ষ কর্মী কাজ করছে। আরও বেশ কয়েক জন চীনা নাগরিকের কাজে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় বাংলাদেশে আসতে পারেনি। তবে কোভিড পরিস্থিতি উন্নত হলে কাজের গতি বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন জটিলতা দূর হয়ে আগামী অর্থবছরে দোহাজারী থেকে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মায়ানমার সীমানায় গুনদুম পযন্ত রেল লাইন নির্মাণ কাজে নতুন মাত্রা পাবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
এ প্রকল্পের পরিচালক মো. মফিজুর রহমান বলেন, ভূমি অধিগ্রহণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে ফলে আগামী অর্থবছরের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দের অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে।প্রায় ১০ বছর ধরে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যা থাকায় প্রকল্পটির কাজও চলছিল একেবারে ধীরগিতে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে দেড় হাজার কোটি বরাদ্দ থাকলেও পরে সংশোধিত এডিপিতে ৯৯০ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। আগামী অর্থবছরেও প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে এ প্রকল্পে।
চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের বরাদ্দ কমছে মেট্রোরেল-৬ প্রকল্পে। বরাদ্দ কমার কারণ জানতে চাইলে মোঃ আফতাবউদ্দিন তালুকদার বলেন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষের দিকে হওয়া চাহিদা কমছে।
তিনি আরও জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরে মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পদ্মা রেল চালুর প্রাথমিক লক্ষ্য থাকলেও কোভিড পরিস্থিতিতে এখনই বলা যাচ্ছে কবে এ রেল চলাচল শুরু হবে। বর্তমান কোভিডের কারণে বাস্তবায়ন কাজের গতি কিছুটা কমেছে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান এখন এ প্রকল্পে সাত হাজার জনবল কাজ করছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এসব জনবলের জন্য স্বাস্থ্য সেবা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছ। ১৪ বেডের দুটি হাসপাতাল রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। প্রয়োজনে বেডের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে। পরমাণু শক্তি কমিশন এ প্রকল্পে ১৮৪২৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় বাড়তি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে ৮২৫৯ কোটি টাকা ।
পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্র বন্দর হিসাবে নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার। এ বন্দরকে এখন সাধারণ নৌ-বন্দর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে পায়রা বন্দর নির্মাণের প্রকল্পের কিছুটা গুরুত্ব কমলেও আগামী অর্থবছরে পায়রা বন্দরের দুইট প্রকল্পে ২৪৭৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়।
বাস্তবায়ন কাজে গতি কম থাকলেও ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পভুক্ত মাতারবাড়ী ১২শ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্টে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে ৪২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় মাত্র ৪২%। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে ৪৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।