ট্রায়াল রানে চলছে পূর্বাঞ্চল রেলের নতুন ১০ ইঞ্জিন
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জন্য কোরিয়া থেকে আমদানি করা ১০টি ইঞ্জিন রেল বহরে যুক্ত করতে ফের ট্রায়াল রান শুরু করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য নিয়ে কন্টেইনারবাহী ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর আইসিডি রুটে গত রবিবার (২৫ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে ট্রায়াল রান।
এদিকে ইঞ্জিনগুলোর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটেম কোম্পানিকে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিকল্প প্রতিস্থাপন (অলটারনেটর রিপ্লেস) করে দিতে ৬০ দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে গত ২৫ এপ্রিল চিঠি দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমান প্রকল্প পরিচালক বলছেন, 'শুরুতে ইঞ্জিনের ত্রুটি নিয়ে যেভাবে আলোচনায় এসেছে বিষয়টি তেমন গুরুতর নয়। ইঞ্জিনগুলো বসিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নেই। তাই পুনরায় ট্রায়াল রান শেষে কিভাবে রেল বহরে ইঞ্জিন যুক্ত করা যায় সেই প্রক্রিয়া করা হচ্ছে'।
প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ হাসান মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যন্ডার্ডকে বলেন, 'চুক্তি অনুযায়ী টিএ-১২ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের কথা ছিলো। কিন্তু সরবরাহকৃত ইঞ্জিনে সংযোজন করা হয় টিএ-৯ মডেলের অলটারনেটর। এর ফলে হর্সপাওয়ার (গতি) ও ব্যাকআপ সিস্টেম ক্ষমতা কিছুটা কম। চুক্তি অনুযায়ী অলটারনেটর রিপ্লেস করে দেওয়ার জন্য গত ২৫ এপ্রিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হুন্দাই রোটমকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ৬০ দিনের মধ্যে অলটারনেটর রিপ্লেস না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় চুক্তিমুল্যের ৬৫% অর্থ এখনো ছাড় দেওয়া হয়নি'।
হাসান মনসুর আরো বলেন, 'ইঞ্জিনগুলো বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেগুলো শতভাগ চলাচল উপযোগী। অলটারনেটর রিপ্লেস না করলেও রেল বহরে যুক্ত করা যাবে। তবুও চুক্তি অনুযায়ী আমাদের যে মডেলের ইঞ্জিন সরবরাহ করার কথা ছিলো সেটি নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চলছে'।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল সূত্র জানায়, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মিটারগেজ লাইনে ট্রেন চলাচলের জন্য প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন ১০টি ইঞ্জিন কেনা হয়। কোরিয়ার হুন্দাই রোটেম কোম্পানির উৎপাদিত এসব ইঞ্জিন কোরিয়া থেকে গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দরে আসার পর সেগুলো পাহাড়তলী কারখানায় আনা হয় ২ সেপ্টেম্বর। ইঞ্জিনের প্রথম ট্রায়াল রান শুরু হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রাম থেকে লাকসাম ও ঢাকা রুটে যাত্রী এবং পণ্যবাহী ট্রেনে ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয় গত ১৭ নভেম্বর । এর মধ্যে গত ৭ অক্টোবর পাহাড়তলী ওয়ার্কশপে নতুন ইঞ্জিন পরিদর্শন করেছিলেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য লোকোমোটিভ, রিলিফ ক্রেন এবং লোকোমোটিভ সিমুলেটর সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় কেনা হয় এই ১০টি ইঞ্জিন। এর আগে এই প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন নূর আহম্মদ হোসেন। ট্রায়াল রান সম্পন্ন হওয়ার পরও কেন রেল বহরে যুক্ত হচ্ছেনা এমন প্রশ্নের জবাবে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি নুর আহম্মদ হোসেন জানিয়েছিলেন, ইঞ্জিনের জেনারেটরে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে। এছাড়া চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিন সরবরাহ করেনি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া রেল বহরে ইঞ্জিন যুক্ত করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
এর মধ্যে এই প্রকল্পের পরিচালক পদ থেকে নূর আহম্মদ হোসেনকে সরিয়ে মোহাম্মদ হাসান মনসুরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের পর ইঞ্জিনগুলো পুরনায় ট্রায়াল রান সম্পন্ন করে চলাচল উপযোগী কিনা তা দেখতে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে রেল কর্তৃপক্ষ। গত ২২ এপ্রিল গঠিত এই কমিটিতে আহবায়ক করা হয় রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মো: বোরহান উদ্দিনকে। এই কমিটির সদস্য করা হয় রেলের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (যান্ত্রিক) আব্দুল মতিন চৌধুরী এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) মোঃ আজিজুল হককে।
ইঞ্জিনগুলো বাংলাদেশ রেলওয়ের ফ্লিটে নিয়ে ব্যবহার করা যাবে কিনা সেগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে মতামত ও সুপারিশ প্রদানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১০ কর্মদিবসের মধ্যে মতামত ও সুপারিশ প্রদানের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
এর প্রেক্ষিতে ২৫ এপ্রিল থেকে সিজিপিওয়াই (চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) থেকে ঢাকা কমলাপুর আইসিডি রুটে ট্রায়াল রান শুরু হয়েছে। প্রতিদিন ১টি করে ইঞ্জিনের ট্রায়াল রান চলছে। এভাবে পর্যায়ক্রমে ১০টির ট্রায়াল রান চলবে।
টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী মো: বোরহান উদ্দিন বলেন, 'রেল কর্তৃপক্ষের সিন্ধান্ত অনুযায়ী পণ্যবাহী ট্রেনে ইঞ্জিনের ট্রায়াল রান চলছে। এই বিষয়ে তথ্য জানাতে রেল ভবন থেকে একটি ফর্ম দেওয়া হয়েছে। ট্রায়াল রান শেষে আমরা সেটি পূরণ করে পাঠাবো। এরপর কবে নাগাদ রেল বহরে ইঞ্জিন যুক্ত হবে সেটি ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের এখতিয়ার'।
সিজিপিওয়াই (চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড) এর প্রধান ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক বলেন, 'ট্রায়াল রানে দিনের প্রথম কন্টেইনারবাহী ট্রেন পরিচালনায় ব্যবহৃত হচ্ছে নতুন ইঞ্জিন। সিজিপিওয়াই থেকে ঢাকা কমলাপুর পৌঁছাতে সময় লাগছে প্রায় ১০ ঘন্টা। ঘন্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে চলছে ট্রেন'।
ট্রায়াল রানে কোন ত্রুটি আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল মালেক বলেন, 'ইঞ্জিনের হাওয়ায় মাঝে মধ্যে সমস্যা হচ্ছে বলে জানতে পেরেছি'।
রেল সূত্র জানায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ১০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন কেনার জন্য কোরিয়ার হুন্দাই রোটেন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩২৩ কোটি টাকা (৩৮ মিলিয়ন ডলার)। চুক্তিপত্র অনুযায়ী এরইমধ্যে ইঞ্জিন সরবরাহকারী কোম্পানিটিকে ২৫ শতাংশ অর্থ অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে। চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় ৬৫ শতাংশ অর্থ এখনো ছাড় দেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ।
ইঞ্জিনগুলোর জন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হুন্দাই পাঁচ বছরের ওয়ারেন্টি প্রদান করে। এর মধ্যে তিন বছর পুরো ইঞ্জিনের ওয়ারেন্টি এবং পরবর্তী দুই বছর সব ধরনের যন্ত্রাংশের (পার্টস) ওয়ারেন্টি।