মহান মে দিবস: মহামারির মধ্যে ঝুঁকিতে শ্রম অধিকার
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/05/01/workers_1.jpg)
গত বছর দেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা নির্যাতনে ৭২৯ শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস), যা আগের বছর ছিল ১২০০। এক বছরে কর্মক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ প্রাণহানী কমার পাশাপাশি দুর্ঘটনায় আহতের সংখ্যা ৩৮% ও নির্যাতনের ঘটনা ৫৪% কমেছে।
করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে শ্রমবাজারের এই একটিমাত্র সূচকেই অগ্রগতি দেখা গেছে। অবশ্য লকডাউনে অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ থাকায় দুর্ঘটনা, প্রাণহানী ও নির্যাতন কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও শিল্প বন্ধ থাকায় আয় কমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থও হয়েছেন শ্রমিকেরাই।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সদ্যপ্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, একদিনের লকডাউনে বাংলাদেশে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের মজুরি বাবদ আয় কমে ৬৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৫৪২ কোটি টাকার বেশি। এ হিসাবে প্রথম দফার লকডাউনেই দিনমজুরদের আয় কমেছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
জিডিপির তুলনায় এ ক্ষতির পরিমাণ দেড় শতাংশের কম হলেও লকডাউনে প্রায় ৮৩ লাখের বেশি দিনমজুরের ৮৩.৩২ লাখ মাথাপিছু আয় কমেছে প্রায় ৪৩ হাজার টাকা করে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, লকডাউনের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় নির্মাণ, পরিবহন, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, গ্যারেজে নিয়োজিত কর্মীদের আয় একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে অসহায় দিনযাপন করছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের প্রায় পাঁচ কোটির বেশি কর্মী।
করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে প্রায় এক মাস ধরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে আবারো চলছে বিধিনিষেধ। এর ফলে খেটে খাওয়া মানুষের খাবার ব্যয় যোগানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ কঠোর বাস্তবতার মধ্যেই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে শ্রম অধিকার আদায়ের দিন মহান মে দিবস।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য সামনে রেখে বরাবর মে দিবস পালন করা হলেও এবারেই প্রথম পেটের ভাত যোগাড়ের বিষয়টিকে বড় করে দেখা হচ্ছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/05/01/sap_8635.jpg)
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, আয় কমে আসায় শ্রমিকদের একটা বড় অংশ নিজেদের ও পরিবারের খাবার ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। পুষ্টিকর খাবার বাদ দিয়ে অনেকেই কম দামি খাবার খাচ্ছেন। আবার অনেকেই এক বেলা উপোষ করছেন।
বিলসের প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৭২৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৩৪৮ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় পরিবহন খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় নির্মাণ খাতে। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬৭ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয় কৃষি খাতে।
২০১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ১২০০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। পরিবহন খাতে সর্বোাচ্চ ৫১৬ জন, নির্মাণ খাতে ১৩৪ জন ও কৃষি খাতে ১১৬ শ্রমিক মারা গিয়েছিল ওই বছর।
২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় ৪৩৩ জন শ্রমিক আহত হয়। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৬৯৫ জন। গত বছর ৫৯৬ জন শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৯ সালে নির্যাতনে ১২৯২ জন শ্রমিক হতাহত হন।
২০২০ সালে ৫৯৩টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ২৬৪টি ছিল তৈরি পোশাক খাতে। ২০১৯ সালে সবমিলিয়ে ৪৩৪টি শ্রমিক আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। এ হিসাবে গত বছর শ্রমিক অসন্তোষ বেড়েছে।
প্রতিবেদনটিতে আগামী দিনে নির্মাণ খাত, গৃহকর্ম, জাহাজ ভাঙা শিল্প, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বিভিন্ন ঝুঁকি উঠে এসেছে। সরকারের পাটকল ও কয়েকটি চিনি শিল্প-কারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হওয়ায় এ সঙ্কট বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, আবাসন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় ২০০ খাতের সব শ্রমিকই কাজ করেন দৈনিক ভিত্তিতে। এ খাতের অধিকাংশ শ্রমিকই এখন কর্মহীন। সরকারের সহায়তা না, সাধারণ মানুষের সাহায্য-সহযোগিতাই এ খাতের শ্রমিকদের অবলম্বন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গবেষণা চালিয়ে বিলস জানিয়েছে, লকডাউনের সময়ে মাত্র ৫% গৃহশ্রমিক কাজে যাচ্ছেন, ৩৫% ভাগ চাকুরিদাতা তাদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। লকডাউন উঠে গেলে অর্ধেক গৃহকর্মী কাজে যেতে পারবেন। আয় বন্ধ থাকায় ৫৫% গৃহকর্মী তাদের পরিবারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
আইএলও'র 'এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের পোশাক শ্রমিক ও কারখানার ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব' শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার আগের তুলনায় পরের মাসগুলোতে বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ পোশাক কারখানা অর্ধেক শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত হয়েছে। ২০ শতাংশ কারখানায় কাজ করেছেন ৩০-৩৯ শতাংশ শ্রমিক।
করোনায় বন্ধ হয়ে যাওয়া ১১৭টি পোশাক কারখানায় কর্মহীন হয়েছেন ৪৩ হাজার শ্রমিক।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2021/05/01/workers_pic.jpg)
করোনায় পেশা বদল করছে মানুষ
করোনা সংকটে পেশা বদলাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মহামারিতে কাজ হারিয়ে পথে বসেছে অনেক নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় কেউ কেউ গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রাজধানী ছেড়েছেন। আর যারা এখনো অর্থনৈতিক এই সংকট কাটিয়ে টিকে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন, তারা পুরনো পেশা বদলে নতুন পেশা বা ব্যবসা করছেন। ৪১ শতাংশ মানুষ নিম্ন দক্ষতার কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিআইজিডি ও পিপিআরসির যৌথ গবেষণা।
ছয় চিনিকল বন্ধে বেকার ও অসহায় ৬৫ হাজার
সরকারের ৬টি চিনি কল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে ৬০ হাজার আখ চাষি, ৫ হাজার শ্রমিক ও ২ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর চোখে-মুখে আঁধারের ছায়া নেমে এসেছে।
৬টি মিল এলাকায় ৬০ হাজারের বেশি আখ চাষি এবার আখ আবাদ করেছেন। তাদের আখের কি হবে সে বিষয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসেনি। ফলে আখ চাষিরাও রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধে বেকার ৫১ হাজার
বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্তে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক বেকার হয়েছেন। এছাড়া তালিকাভুক্ত বদলি ও দৈনিক ভিত্তিক কাজ করা প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিকের জীবনেও নেমে এসেছে অন্ধকার।