খরায় ফসলের ক্ষতি
সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় খাদ্যশস্যের মজুদ সবচেয়ে কম থাকায় দেশের অন্যতম প্রধান শস্য বোরোর ফলন ভালো হবে এমনটাই আশা সরকারের। বোরো ধান তোলার মৌসুমও এগিয়ে আসছে। কিন্তু দেশের কিছু অঞ্চলে তীব্র তাপদাহ ও খরার কারণে এ বছরের বোরোর ফলনের ব্যাপারে আশাবাদী নন অনেক কৃষক।
এছাড়া, প্রায় ছয়য় মাস ধরে বৃষ্টিপাতের অভাবে, বিশেষত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে সেচ মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অভাবে খরচ বেড়েছে, ক্ষতি পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে শঙ্কায় আছেন কৃষকরা।
তাপদাহ, তীব্র খরা এবং স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আংশকাজনকহারে নিচে নেমে যাওয়ায় আরও অতিরিক্ত খরচ যোগ হয়েছে। কোনো কোনো অঞ্চলে এবারের বোরো চাষের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায়নি। প্রচন্ড খরার কারণে কিছু অঞ্চলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দেড়গুণ-দুইগুণ পর্যন্ত বেশি খরচ করে সেচ দিতে হয়েছে।
বোরো চাষী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খরার কারণে অঞ্চলভেদে ২০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সেচ দিতে হয়েছে। এতে করে বোরোর উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু খরার প্রভাবে বাড়তি সেচ দিয়েও কৃষকরা বোরো ধানের স্বাভাবিক উৎপাদন ধরে রাখতে পারেননি। কৃষকদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বোরো ধানের উৎপাদন ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কম হয়েছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ির সরমংলার কৃষক মানুনুর রশিদ ৬ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেন। গত বছর বিঘাপ্রতি সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা সেচ খরচ হলেও এবারে খরচ হয়েছে ২২০০ টাকা। ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত সেচ খরচ বৃদ্ধির পরও ফলনও হয়েছে কম। প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ২৫ মন ফলনের আশা করলেও তিনি পেয়েছেন ১৯-২০ মন করে।
একই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার বর্গাচাষি আফজাল মিয়ার। গত বছরের তুলনায় এ মৌসুমে সেচের পেছনে ৫০ শতাংশ বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। কিন্তু ২৫-৩০ মন ফলনের আশা করলেও ধান কাটার পর দেখা গেছে তিনি ২০ মনের বেশি ধান পাননি।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ধানের কেজি প্রতি উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৯৬ পয়সা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৬ টাকা ১৯ পয়সা, চালের ৩৮ টাকা ৫৩ পয়সা; বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৫ টাকা ২৮ পয়সা, চালের ৩৭ টাকা ৭ পয়সা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের ধানের উৎপাদন ব্যয় ২৭ টাকা এবং চালের ৩৯ টাকা নির্ধারণ করেছে।
গত বছর অবশ্য বোরোর উৎপাদন খরচ ছিল ২৬ টাকার কম এবং চালের উৎপাদন খরচ ছিল ৩৫ টাকার কম।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সারাদেশে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। যেখানে দেশের ৩০ টিরও বেশি জেলার ধানের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিট শকের প্রভাবে ৬৩ হাজার জমির ধান আক্রান্ত হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় প্রায় ১ লাখ টন ফসলের ক্ষতির কথা বললেও এই পরিমাণ আরও বাড়ছে। অণ্যদিকে খড়ায় ১৫-২৫ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন কম হলে সেটা খাদ্যের মোট উৎপাদনে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি করবে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, খরা ও হিট শকের কারণে উৎপাদনে সামান্য প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে কোন ঘাটতি তৈরি হওয়ার শঙ্কা নেই।
জানা গেছে, শুধু ধান নয়, এবারে ধানের মতো পাটের আবাদও ক্ষতির মুখে পড়েছে। বৃষ্টি নির্ভর পাটের আবাদে এবার খরার কারণে সেলো মেশিনে সেচ দিতে হচ্ছে। বাড়তি সেচ দিয়েও পাটগুলো বাঁচানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
ফরিদপুরের পাটচাষীরা জানিয়েছেন, তীব্র তাপদাহ ও অনাবৃষ্টিতে চৌচির ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানের পাটক্ষেত। বৈশাখের তপ্ত রোদে শুকিয়ে যাচ্ছে পাটগাছ। এতে পাটের আবাদ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে কৃষকের মধ্যে।
অপরদিকে ধারাবাহিক তীব্র তাপদাহের কারণে নেমে গেছে পানির স্তর। পাটের জমিতে ঘন ঘন সেচ দেওয়ায় যেমন বাড়ছে উৎপাদন খরচ, তেমনি প্রচন্ড খরায় জমির আগাছা পরিষ্কার করতে পারছেন না কৃষকরা। এতে পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষীরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর জেলায় মোট পাট আবাদের লক্ষ্য ৮৬ হাজার ২'শ ৬ হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত চাষিরা ৮৩ হাজার ৪ শত ৫৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করেছেন। যা এখন শঙ্কার মধ্যে পড়েছে।
সালথা উপজেলার গত্রি ইউনিয়নের কৃষক নাসের হোসেন জানান, এমন খরা তারা আগে দেখেননি। বৃষ্টি না থাকায় ঘন ঘন সেচ দিতে হচ্ছে। এর পরও পাটগাছ বাড়ছে না। পাটগাছের বৃদ্ধি দ্রুত না হওয়ায় জমিতে আগাছার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে কিন্তু ফলন পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।
জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক ড. মোঃ হযরত আলী বলেন,"গত বর্ষার পর থেকেই ফরিদপুরে কোন বৃষ্টির দেখা নেই। জমি শুকনা থাকার পরও কৃষক জমিতে পাট লাগিয়েছেন। অনেকে তপ্ত রোদে পাটের জমিতে সেচ দিচ্ছেন। এতে কৃষকের খরচ প্রচুর পরিমানে বেড়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে অনেক ক্ষেতে পাট লাগানো হলেও সেই পাট গাছ আর বড় হবে না।"
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ ও ২৬ মার্চ ফরিদপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিলো ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, এপ্রিলে জেলায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত ১৬৪.৮০ মিলিমিটার হলেও এবছর এপ্রিলে তা ছিল মাত্র ১১ মিলিমিটার।
বোরো ধানের প্রচন্ড ক্ষতির পর এই খরা এবার আম, কাঠাল ও লিচুর মত মৌসুমি ফলগুলোরও ক্ষতি করছে। বোটা শুকিয়ে গিয়ে পরিপক্ক হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে গাছ থেকে ঝড়ে পড়ছে বলে জানা গেছে। রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা সহ বিভিন্ন এলাকার বাগানমালিক ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টি না হওয়ার কারনে এ পর্যন্ত ৫-৭ শতাংশ আম এবং লিচু ঝরে পরেছে।
চাপাইনবাবগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা ড. বিমল কুমার প্রামাণিক বলেন, গতবারের চেয়ে এবার ঝড়ে পরার পরিমান প্রায় দ্বিগুন। এর প্রভাব পড়বে সার্বিক উৎপাদনে।
ডিএই এর কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কৃষিবিদ কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, অপরিপক্ক অবস্থায় ফল ঝড়ে পরা ও ফলের আকার ছোট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যার খবর পাওয়া গেছে। পাট ও ভুট্টা উৎপাদনেও প্রভাব পড়ছে।
স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে ভূগর্ভস্থ পানির স্থর নিচে নেমে যাচ্ছে
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মার্চের শুরু থেকেই দেশের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু মার্চ ও এপ্রিল মাসে বিভিন্ন জেলায় স্বাভাবিক যে বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা তা হয়নি। ফলে অন্যদিকে সারাদেশে খরার কারণে বোরো ধানে বাড়তি সেচ দিতে হয়েচে। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে।
বাংলাদেশে এপ্রিল মাসে সাধারণত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা থাকে ৩১.২ থেকে ৩৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। তবে গত ২৫ এপ্রিল যশোরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১.২ ডিগ্রি ছিল, যা ৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১৪ সালের পর আর ৪১ ডিগ্রি অতিক্রম করেনি তাপমাত্রা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, মাসের গড় বৃষ্টিপাত ৫৪.৪ মিলিমিটার হলেও গত মার্চে স্বাভাবিকের চেয়ে ৮০ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে সারাদেশে। রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিভাগগুলোতে স্বাভাবিকের তুলনায় ৯৮-৯৯.৬ শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে ওই মাসে।
এদিকে এপ্রিলের অবস্থাও ভয়াবহ। এপ্রিলে সাধারণ গড় বৃষ্টিপাত ১৩০ মিলিমিটার হলেও মাস শেষে এর ধারে কাছেও পৌঁছাতে পারবে না। এফএফডব্লিউসির তথ্যানুসারে, ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৮ টি স্টেশনের মধ্যে ৭টি স্টেশনে কোনো বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়নি। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেক বৃষ্টিপাত হয়েছে শুধু ৭টি স্টেশনে। ২২টি স্টেশনে স্বাভাবিকের চেয়ে কমপক্ষে ৯০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত না হওয়ার কারণে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানির খরচ হয়েছে তা আর পূরণ হচ্ছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে বৃষ্টিপাত না থাকায় নদ-নদী অর্থৎ ভূ-উপরিভাগের পানিরও ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলে জানান বিভিন্ন জেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
টিবিএসের বগুড়া প্রতিনিধি জানান, নওগাঁ সদরের ভিমপুর গ্রামে ৬৫ ফিট নিচে নলকূপে পানি পাওয়া যেত। কিন্তু এখন ৯০ ফিটের বেশি গভীর থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। নওগাঁ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলি মাহমুদ আলম বলেন, এবারের খরায় নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চলের পানির স্তর ৬-৮ ফুট নিচে নেমে গেছে। এছাড়া গড়ে প্রতিবছর ৬-৮ ইঞ্চি করে নিচে নামছে পানির স্তর।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, তিস্তা, মনু ও গঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন নদীতে পানি প্রবাহ কম থাকায় তা সেচ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত নয়। ফলে সেচের জন্য ভূগর্ভস্ত পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের অনারারি নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসেন বলেন, গত ২০-৩০ বছরে বাংলাদেশে কনক্রিটের অবকাঠামো নির্মাণ বহুগুণে বেড়েছে যা তাপ ধরে রাখছে। যানবাহন, এসি ও ইলেক্ট্রনিকস এব ব্যবহার প্রচুর বেড়েছে, এগুলো প্রচুর তাপ নির্গমন করছে। পাশাপাশি বনভূমি কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এসব কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে।
তিনি বলেন, "নদীতে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাতাসে জলীয় বাস্পের পরিমাণ কম, একই সঙ্গে বৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় গাছের অভাব; এ বিষয়গুলো অনাবৃষ্টির জান্য দায়ী। নতুন করে দেখা গেছে বাংলাদেশে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ মিথেন কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে ৮০ গুণ বেশি, যা বায়ু মন্ডলকে উত্তপ্ত করে তুলছে।"
টিবিএসের ফরিদপুর, বগুড়া, রাজশাহী, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর ও কুমিল্লা প্রতিনিধি প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন।