‘মহামারিতে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কম, বরাদ্দকৃত অর্থেরও যথাযথ ব্যয় হয়নি’
করোনা মহামারি সংকটের সময় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার যে আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা যায়নি।
সেকারণে সরকারি ব্যয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের বাধা দূর করতে প্রশাসনিক নজরদারি জোরদার এবং বড় পরিসরে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উপর জোর দিয়েছে এসডিজি বাস্তবায়নের নাগরিক প্লাটফর্ম।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, মহামারিতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন না হলে এই মানুষগুলোর সংকট আরও বাড়বে। তাদের জীবনে পুষ্টিহীনতা, দৈন্যতা, অভাবগ্রস্থতা ও ঋণগ্রস্থতা বাড়বে।
এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্তরের স্টেকহোল্ডারদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
আগামী বাজেটে এই শ্রেণীর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে অর্থ বরাদ্দের পরামর্শও দিয়েছে দেশের অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা।
রোববার অনলাইনে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম 'জাতীয় বাজেট ২০২১-২২: পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কী থাকছে' শীর্ষক এ ওয়েবিনারে এসব বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরে।
সংবাদ সম্মেলনে মূলপ্রবন্ধ তুলে ধরেন সিটিজেন প্লাটফর্ম ফর এসডিজি, বাংলাদেশের কনভেনর ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের কোর গ্রুপের সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আলোচনায় অংশ নেন সিটিজেন প্লাটফর্মের অন্যান্য সদস্য ড. মুশতাক রাজা চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায় সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শাহীন আনাম, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম।
মূল বক্তব্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "সরকার পিছিয়ে পড়া বা গরিব মানুষের জন্য আর্থিক সহায়তায় শুধু কম দিয়েছে তা নয়, যে টাকা দেওয়া হয়েছে তাও সঠিকভাবে খরচ করতে পারেনি,"
উন্মুক্ত উৎসের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, "বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণে সরকার ২,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এটার ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।"
"প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৫০ লাখ গরিব মানুষকে ২৫০০ টাকা করে নগদ অর্থ দেওয়ার কথা থাকলেও ৩৫ লাখের বেশি মানুষকে দেওয়া হয়নি। করোনায় সরকার যেসব আর্থিক বরাদ্দ দিয়েছে, তাতে পুরনো কর্মসূচি যুক্ত করে স্পিটো করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "গতবছর করোনার সংক্রমণের সময় আমরা বলেছিলাম, আমাদের টাকা-পায়সা নাই, খরচ করব কী? এখন টাকার লভ্যতা সমস্যা নয়, টাকা খরচ করার দক্ষতা ও যোগ্যতা এখন অনেক বড় চিন্তার বিষয়।"
ভোক্তার ব্যয়, বিনিয়োগ, সরকারি ব্যয় ও নেট রপ্তানি-এ চারটি বিষয়ের উপর জোর দিয়ে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ নজর এবং এমএমএই পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির জোর দেন দেবপ্রিয়।
প্রবন্ধে ফিসক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এবং বাজেট ঘাটতির বিষয়ে কর-জিডিপি অনুপাত, সরকারি ব্যয়ের অনুপাতে পতনের বিষয়ে তুলে ধরে প্রতিবছর কর-জিডিপি অনুপাত ০.৫-১ শতাংশ করে বাড়িয়ে আগামী ৫ বছরে ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে জোর দেওয়া হয়।
দেবপ্রিয় বলেন, "২০২১ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৫০ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়, মোট বরাদ্দের মধ্যে এডিপি বাস্তবায়ন হয় ৪২ শতাংশ। আগামী বাজেটে নতুন কোনো কর আরোপ বা করের ক্ষেত্রে কোনো বৃদ্ধি নয় বরং প্রশাসনিক দক্ষতার মাধ্যমে কর বাড়াতে হবে। শ্রমঘন শিল্পকে কর সুবিধা দিতে হবে।"
রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রবন্ধে বলা হয়, উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের হার বৃদ্ধি, শেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা মেগা প্রকল্প ছাড়া অন্যান্য বরাদ্দ বন্ধ, সরাসরি নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা জিডিপির ০.৫ শতাংশ। সার্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু, আগামী ৫ বছরের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির ৪.৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "করোনার কারণে আয়, সম্পদ ও ভোগ বৈষম্য বেড়েছে। গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ, কিন্তু মানুষের আয় কমেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আরও প্রান্তিকতর হয়েছে। এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশের জন্য সুনির্দিষ্ট সহায়তা প্রয়োজন।"
পাশাপাশি ঘরবন্দী শিশুশদের ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিশু বাজেট প্রণয়ন এবং কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্ত্য সুরক্ষার জন্য আগামী বাজেটে বরাদ্দ রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের জন্য জরুরি অক্সিজেন সরবরাহ, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরের জন্য বরাদ্দ, টিকা সংগ্রহ করে প্রত্যেক যোগ্য নাগরিককে দেওয়া, সামাজিক সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, গবেষণায় বরাদ্দ, আগামী দুই বছরের মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ দ্বিগুণ করা ও সরকারি হাসপাতালে সেবার পরিসর বাড়ানোর পরামর্শ দেন ড. মুশতাক রাজা চৌধুরী।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপর জোর দেওয়া এবং আগামী বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানান মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শাহীন আনাম। পাশপাশি শিশু বাজেট প্রণয়নের উপরও জোর দিন তিনি।
শিক্ষা খাতকে অবেহেলিত খাত উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় শিক্ষার জন্য প্রণোদনা ঘোষণার কথা বলেন রাশেদা কে চৌধুরী।
তিনি বলেন, "আগে থেকেই শিক্ষায় বৈষম্য ছিল, করোনার সময় তা তীব্রতর হয়েছে। শিশু শ্রম ও বাল্য বিবাহ বাড়ছে।"