রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুরাবস্থাকে যেভাবে এড়িয়েছে চীন
২০ শতকের শেষ দশকে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে এক বিস্ময়কর বদল আনে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন। লৌহ যবনিকার অবসানের পর পূর্ব ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রগুলোকে উন্নতির স্বার্থে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুতগতির করতে হবে, পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের সিংহভাগ এমনটাই মনে করতেন। তাদের ধারণাও ছিল, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির বদলে বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে বাজারমূল্যের আকস্মিক নীতি পরিবর্তন আর্থিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে।
চীন কিন্তু এসব উপদেশ শোনেনি, যদি শুনত, তাহলে ৯০ দশকের রাশিয়ার মতোই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত এক দেশে পরিণত হতো- এমনটিই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঐতিহাসিক ইসাবেলা ওয়েবার। তার নতুন একটি সাড়া জাগানো গ্রন্থ "হাউ চায়না এসকেপড শক থেরাপি: দ্য মার্কেট রিফর্ম ডিবেট"-এ তিনি নিজ বক্তব্যের স্বপক্ষে বেশকিছু প্রমাণও তুলে ধরেছেন।
সেখানে ইসাবেলা বলেছেন, পশ্চিমা উপদেশ না শুনে তার পরিবর্তে চীন ধীরে ধীরে পুঁজিবাদী বাজারে রূপান্তরিত হওয়ার উদ্যোগ নেয়। রাজনৈতিক আদর্শ সমাজতন্ত্র রেখে, ধনতন্ত্রের পথে সতর্ক এই যাত্রা পরবর্তীকালে 'খরস্রোতা নদীতে পা দিয়ে পাথর অনুভব করে করে পাড়ি দেওয়ার' নীতি হিসেবে পরিচিতি পায়।
অবশ্য নীতিটি প্রণয়নের আগে চীনের সমাজতন্ত্রী শাসকগোষ্ঠী সঠিক পন্থা নিয়ে পাঁচ বছর ধরে বিতর্ক করেছে। রাজনৈতিক ঐতিহাসিক ওয়েবার ঘটনাবলীর বিস্ময়কর ব্যাখ্যা নিজ লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরে জানাচ্ছেন, ইতিহাসের মোড় একটু ব্যতিক্রম হলেই, আজকের চীনও ভিন্ন হতো। আসলে ওই সময়ে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে তিয়েনমেন স্কয়ারে বিপ্লব এবং শেষমেষ তা শক্তিপ্রয়োগ করে রক্তাক্ত উপায়ে দমন করার ঘটনা- চীনকে বুঝেশুনে পুঁজিবাদের পথে পা রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
বইয়ে লেখা এসব ঘটনা নিয়ে ওয়েবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ব্লুমবার্গের আন্ড্রু ব্রাউন, চীনের ওই সময়ের সেই স্মরণীয় ঘটনাবলী এবং কীভাবে তা চীনকে আজকের দুনিয়ার অংশ করে তুলেছে- তা নিয়েই লেখিকার সঙ্গে আলাপ করেন।
আন্ড্রু ব্রাউন: নিজ গ্রন্থে আপনি বলেছেন, পশ্চিমা অর্থনীতিবিদদের দ্রুত রূপান্তরের পরামর্শ আমলে না নেওয়ার কারণেই চীন আজকে অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। মূলত, এই অভিজ্ঞতার কারণেই কী চীন তার স্থানীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণরূপে পশ্চিমা বাণিজ্যিক উদ্যোগের জন্য উন্মুক্ত করে না? এক্ষেত্রে পশ্চিমা চাপকে উপেক্ষা করার শক্তিও কী সেখান থেকেই আসছে?
ইসাবেলা ওয়েবার: প্রথমত এটা চীন বনাম পশ্চিমা দুনিয়ার বিরোধের ঘটনা নয়, বরং দুটি ভিন্ন বাজার ব্যবস্থা; উন্মুক্ত এবং অনেকাংশে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রণয়ন ঘিরে মতভেদ। চীনের জন্য কোনটি ভালো হবে- তা নিয়ে চীনা এবং পশ্চিমা অর্থনীতিবিদেরা দুই দলে ভাগ হয়েছিলেন, তারা দুটি ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নিয়ে যুক্তি দিয়েছেন। তাদেরই অনেকে রাতারাতি উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা এবং আকস্মিকভাবে বাজারে রাষ্ট্রের প্রভাবকে শূন্যে নামিয়ে আনার পরামর্শ দেন। অন্যরা করছিলেন সীমিত মাত্রায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক পুঁজিবাদ চালু করার প্রায়োগিক সুপারিশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অর্থনীতিকে যুদ্ধ শেষে পুনর্গঠনের অভিজ্ঞতা থেকেই বেশিরভাগ সময়ে সংস্কারপন্থী অর্থনীতিবিদেরা অনুপ্রাণিত হন। কোভিড-১৯ মহামারি হানা দেওয়ার পর আজকে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারও একইভাবে সাধারণ অর্থনীতি থেকে যুদ্ধকালীন সময়ের মতো অর্থনীতি প্রণয়নে তৎপর হয়েছে সরকারি ব্যয় অনেকগুণে বাড়িয়ে।
ব্রাউন: গণচীনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মৃত্যুর পুর ক্ষমতায় আসেন দেং জিয়াওপিং। তিনি এসেই আকস্মিক কিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যদিও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তার সংস্কার চেষ্টায় দুর্নীতি বাড়ে, মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং তার ফলেই জন্ম নেয় তিয়েনমেন স্কয়ারের গণবিক্ষোভ। এই আন্দোলনটি চীনা সমাজতন্ত্রী দলকে প্রায় ক্ষমতাচ্যুত করার মতো পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। সেই প্রেক্ষাপট থেকেই কী আমরা আজকে চীনের নিওলিবারেলিজম বা অর্থনীতি পূর্ণ উন্মুক্তকরণের ব্যবস্থার বিরোধিতা ব্যাখ্যা করতে পারি?
ওয়েবার: ১৯৮০'র দশকের শেষদিকে কৃষি সংস্কারের কারণে চীনে উৎপাদনশীলতার এক জোয়ার আসে। কিন্তু, এই ব্যবস্থায় সকলেই লাভবান হবে না এমন সত্যটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং সেকারণেই আরও বাজারিকরণের বিরুদ্ধে বিরোধিতা জন্ম নেয়। একারণেই, আকস্মিকভাবে মুল্য উদারীকরণের ধারণাটি জিয়াওপিংকে প্রভাবিত করে। তিনি টেলিভিশনে এ সংক্রান্ত ঘোষণাটি দেওয়ার পরপরই দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা; ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিপুল চাপ সৃষ্টিসহ অতি-মুনাফার লোভে অনেকেই মজুতদারিও শুরু করে। দেং জিয়াওপিং বাজার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি থাকলেও, তিনি সে জন্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি নিতে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি জানতেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে তা শেষমেষ সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র ব্যবস্থা পতনের কারণ হবে। তাই বৈপ্লবিক মুল্য উদারীকরণের চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু, তাই বলে ১৯৮৮ সালের পর চীনে 'নিওলিবারেল' সংস্কার একেবারেই হয়নি তা বলা যাবে না। বরং ১৯৯০-এর দশক থেকে ২০০০ এর দশকের শুরুর দিকে চীনে সবচেয়ে নিওলিবারেল যুগ লক্ষ্য করা গেছে। তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে উদারীকরণ হলেও সম্পূর্ণ কাঠামোকে ঢেলে সাজানোর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।
ব্রাউন: বিকল্প কোনো পথ কী ছিল? চীন কী পোল্যান্ডের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরও বেশি মুক্তবাজার এবং গণতন্ত্রকে গ্রহণ করতে পারতো না?
ওয়েবার: পোল্যান্ডের সঙ্গে চীনের তুলনা করতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে, সংস্কার যখন শুরু হয় তখন কিন্তু চীন খুব দরিদ্র একটি দেশ ছিল। ১৯৮০'র দশকে চীনের মাথাপিছু জিডিপি ছিল হাইতি বা সুদানের চাইতেও কম। শুধু মুক্তবাজার সম্পর্কিত সংস্কার নয়, দেশটিকে শিল্পায়ন এবং অন্যান্য অবকাঠামোর উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই অবস্থায় দেশটি রাতারাতি সংকার করে রাশিয়ার মতো অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়লে- কল্পনার অতীত সঙ্কট দেখা দিত। এমন সঙ্কটের মাত্রাও আজকের দিনে বসে অনুমান করা কঠিন। যেমন ধরুন রাশিয়াতে সোভিয়েত ব্যবস্থা ভাঙ্গনের পর মানব উন্নয়নের প্রতিটি সূচক সাংঘাতিকভাবে নিচে নেমে আসে। রাশিয়ায় এসব সুচক কিন্তু চীনের চাইতেও বহুগুণ শক্তিশালী অবস্থানে ছিল।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, গণতন্ত্র সব সময় পরিবর্তনের পথে থাকা অর্থনীতির স্থিতিশীল ফল অর্জনে সহায়ক হয় না। সমাজতন্ত্র পতনের পর আচমকা গণতন্ত্রায়ন এবং মুক্ত অর্থনীতির 'শক থেরাপি'র পথ ধরা রাশিয়াসহ বেশ কিছু দেশেই এই নজির দেখা গেছে।
ব্রাউন: শেষপর্যন্ত চীন যে পন্থা অবলম্বন করলো তাতে রাষ্ট্রকে অর্থনীতির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে রাখা হলো। পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে চীনের এই 'রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজিবাদী' ব্যবস্থার ভিন্নতার কারণেই কী আজ আমরা উভয়পক্ষের মধ্যে একটা সংঘাত লক্ষ্য করছি?
ওয়েবার: 'রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজিবাদ' বা অর্থনীতিতে সরকারের সক্রিয় অংশহণের কারণেই সমস্যার সুত্রপাত দাবি করা এই তত্ত্বটির ব্যাপারে আমি সন্দিহান, কারণ অন্য অনেক দেশেই অর্থনীতিতে সরকারের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণেই আছে। অন্যান্য রাষ্ট্রেও শিল্প নীতিসহ নানান ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের গভীর সম্পৃক্ততা ছিল।
চীনের সাথে পশ্চিমের আজকের বিরোধের জায়গাটি অন্য জায়গায়। যতদিন চীন পশ্চিমে মূল কার্যালয় থাকা কোম্পানির জন্য পণ্য উৎপাদনের বিশাল কারখানা ছিল ততোদিন সম্পর্কে চিড় ধরেনি, কিন্তু চীন যখন নিজস্ব কোম্পানির প্রযুক্তিগত পণ্য নিয়ে তাদের সঙ্গে বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছে, তখনই সম্পর্কে তিক্ততা বেড়েছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় চীন অনেক পিছিয়ে থাকায় এখাতে ছিল রাষ্ট্রীয় সমর্থনেরও প্রয়োজন।
ব্রাউন: আঞ্চলিক পর্যায়ে মুক্তবাজার চর্চার পরীক্ষাগুলোই চীনের প্রথম দিককার সফলতার বড় উৎস। কিন্তু এখন ব্যবস্থাটি অনেক বেশি সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমুল পর্যায়ে নিয়ন্ত্রিত, এটি কী একটি সমস্যা?
ওয়েবার: নতুন দৃষ্টান্তগুলো স্থায়ী ও স্থিতিশীল রুপ নেওয়ার আগে ১৯৮০'র দশক উন্মুক্তকরণের এক অসামান্য সময় ছিল- একথা প্রথমেই স্বীকার করে নিতে হয়। আজ আমরা যুক্তরাষ্ট্রেও একইভাবে প্রচলিত অর্থনীতির প্রায় সকল দিক নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলে বিতর্ক দেখতে পাচ্ছি। এই বিতর্ক চিরকাল চলবে না, এক সময় একটি নতুন ব্যবস্থা সংহতি লাভ করবে এবং আমরাও হয়তো (চীনের মতো) নতুন ও আরো দৃঢ় একটি ব্যবস্থা লাভ করব।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ