‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যে বিশেষ ছাড়ের পরিকল্পনা
বিদেশ নির্ভরতা কাটিয়ে স্থানীয় পণ্যে বিশ্বজয় করতে চায় সরকার। আগামী বাজেটে আমদানির বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু পণ্যে আয়কর ও ভ্যাটে ছাড়ের মাধ্যমে দেশে শিল্পায়ন উৎসাহিত করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
আগামী ৩ জুন জাতীয় সংসদে পেশ হওয়ার অপেক্ষায় থাকা বাজেটে "মেইড ইন বাংলাদেশ" নামে একটি ঘোষণায় অর্থমন্ত্রী এমন ছাড়ের সুবিধা দেবেন বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।
এনবিআর সূত্র জানায়, মোবাইল, রেফ্রিজারেটর, এসি, ফ্রিজ, অটোমোবাইল, টিভিসহ ইলেকট্রনিক্স খাত এবং অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রির জন্য ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ বাড়ানো হতে পারে আগামী বাজেটে। একই সঙ্গে ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক সুইং মেশিন, মাইক্রোওভেন, ব্লেন্ডারসহ হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদনে নতুন করে ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা আসতে পারে আগামী বাজেটে। নতুন করে কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করলে ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডের ঘোষণাও আসতে পারে আসছে বাজেটে।
এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "দেশে শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মেইড ইন বাংলাদেশ ধারণাকে কয়েক বছর ধরেই লালন করছে সরকার। এ লক্ষ্যে গত এক দশক ধরেই বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স হলিডে এবং ভ্যাট ও শুল্কে ছাড় দিয়ে আসছে। আগামী বাজেটে নতুন করে আরো কিছু পণ্যে এ ছাড় দিয়ে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' ঘোষণার সুপারিশ রাখছে এনবিআর।"
তবে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ হওয়ার আগে কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয় বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা।
২০১২ সালে এক টনের জেনারেল ব্র্যান্ডের একটি এসি ৮০ হাজার টাকায় কিনেছেন বেসরকারি চাকরীজিবি মাহবুব। দশ বছর পর ২০২০ সালে একই মানের একটি এসি ৩৫-৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করছে ওয়ালটন, ভিশনসহ দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো।
কর অবকাশ এবং ভ্যাট ছাড়ের সুবিধায় স্থানীয় উৎপাদকরা এগিয়ে আসায় কয়েক বছরে এসির দাম কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ব্যবহারকারী বেড়েছে কয়েকগুণ। এই সুবিধায় এসির চেয়েও বেশি হারে দাম কমে মানুষের হাতের নাগালে এসেছে মোটর সাইকেল, টিভি, মোবাইল, ফ্রিজ-রেফ্রিজারেটরসহ জীবন সহজ করার পণ্য সামগ্রী। একপ্রকার বুম বা 'বিস্ফোরণ' ঘটেছে ইলেকট্রনিক্সের বাজারে।
ইলেকট্রিক খাতের বিকাশে সরকারের দেয়া এ সুবিধার মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হচ্ছে। তবে সরকারের মেইড ইন বাংলাদেশ ভিশনের অন্তর্ভুক্তি করে মোবাইল, এসি, ফ্রিজ, লিফটের কর অবকাশ সুবিধা আরো তিন বছরের জন্য বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছে এনবিআর সূত্র।
একইসঙ্গে নতুন করে ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক সুইং মেশিন, মাইক্রোওভেন, ব্লেন্ডারসহ হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদন নতুন করে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় যোগ করে বাজেটে অন্তর্ভুক্তির জন্য তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে এনবিআর। এসব পণ্যেও তিন বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতির সুপারিশের সঙ্গে নতুন করে কারখানা স্থাপনে ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা যোগ হচ্ছে।
কর অবকাশ সুবিধা পেতে কোম্পানিগুলোকে ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যালু এডিশন করতে হবে। কারখানাও স্থাপন করতে হবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটির বাইরে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মধ্যে কারখানা স্থাপন করলেও এ সুবিধা ৫ বছরের জন্য পাওয়া যাবে।
ভ্যালু এডিশনের শর্ত দিলেও দেশের ভিতর এ ইন্ডাস্ট্রি বিকাশে নতুন সুবিধা দারুণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে ইলেকট্রিক সামগ্রী উৎপাদনে ২০১০ সালে প্রথম ভ্যাট ও করছাড় দেয়ার বিপুল পরিবর্তন হয়েছে এ খাতে। পণ্যের দাম অর্ধেকে নেমে আসার পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে বিপুল সংখ্যক মানুষের। এক সময় বিদেশ নির্ভর এ বাজারের এখন ৯০ শতাংশের বেশি দখল স্থানীয় কারখানার। গত দশ বছরে ১৩টি দেশি-বিদেশী ব্র্যান্ড বিপুল বিনিয়োগের মাধ্যমে কারখানা স্থাপন করেছে। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ৫ লাখর বেশি মানুষের।
বাংলাদেশ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ইলেকট্রিক খাতের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক খান বলেন, নতুন সুবিধা দিলে তা দেশের শিল্প বিকাশে নিঃসন্দেহে বড় ভূমিকা রাখবে। 'মেইড ইন বাংলাদেশ' পণ্য বিশ্বব্যাপী পৌঁছে দেয়া যাবে।
তবে দেশে উৎপাদনে করছাড় দেয়ার পাশাপাশি আমদানির ওপর কর বাড়ানোর প্রস্তাব করেন তিনি।
কর ছাড়ের সুবিধা কাজে লাগিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি কারখানা স্থাপন করেছে বিদেশী স্যামসাং, এলজি বাটারফ্লাই, কনকাসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড। নতুন সুবিধা আরো অনেক কোম্পানিকে দেশে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে বলে জানিয়েছেন তারা।
ইলেকট্রনিক্স খাতে কোরিয়ান জায়ান্ট স্যামসাংয়ের পণ্য বাংলাদেশে উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশে বিদ্যুতের প্রসার ও মানুষর জীবন মানের পরিবর্তনের কারণে ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যের চাহিদা বেড়েছে।
এসব পণ্য মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। নতুন সুবিধা দিলে উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়ে জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
"সরকারের নীতি সুবিধার কারণেই বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। দেশের প্রায় সবগুলো বড় ব্র্যান্ড কারখানা স্থাপন করছে। আগামী বাজেটে এ সুবিধা বাড়লে এটি দেশের কর্মসংস্থানের জন্য বড় খবর হবে," যোগ করেন মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ।