ঢাকা- দীনবন্ধু মিত্রের কাল এবং নীলদর্পণ
ডাক্তার দুর্গাদাস করের বাড়ির দরজায় যখন দীনবন্ধু পৌঁছুলেন তখন শহরটা প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে, ঘড়িতে রাত নয়টা। আর্মেনিয় গীর্জার ঘণ্টার শব্দ কানে আসছে। বেশ ক'বার কড়া নাড়বার পর দরজা খুলে দিলেন দুর্গাদাস কর। বাসার সবাই মনে হল ঘুমিয়ে পড়েছে। পুত্র গোবিন্দ কিংবা মাধব কাউকেই দীনবন্ধুর চোখে পড়ল না। শুধু তাদের দাই জেগে আছে, এক মনে গুন গুন করে গান গাইছে- "শাহজাদে আলম তেরে লিয়ে …।"
ঢাকা শহরে দুর্গাদাস এসেছেন খুব বেশি দিন হয়নি। এর আগে ছিলেন বরিশালে, এসিস্ট্যান্ট সিভিল সার্জন হিসেবে। বেশ চলে যাচ্ছিল- রোগী দেখা আর পাশাপাশি টুকটাক লেখালেখি। তবে এই লেখালেখিই মনে হয় কাল হল। 'স্বর্ণশৃঙ্খল' নামে একটা নাটক লিখেছিলেন ক'বছর আগে। লোকজনের উৎসাহে কিছু স্থানীয় অভিনেতা নিয়ে মঞ্চেও উঠেছিল নাটকটা। নিজের লেখক পরিচয়টা অবশ্য গোপন করেছিলেন কারণ নাটকটা ছিল রূপকধর্মী, বলা যায় বাংলা ভাষায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা প্রথম নাটক। কিন্তু গুপ্তচরের আঙুল দুর্গাদাস করের দিকেই। তাই ইংরেজ সরকার তড়িঘড়ি করে তাঁকে বদলি করে দিল ঢাকায়। সেখানে নতুন হাসপাতাল হয়েছে রবার্ট মিটফোর্ডের নামে। ঢাকার সিভিল সার্জন আলেকজান্ডার সিম্পসনের সাথে দুর্গাদাস করের উপর দায়িত্ব পড়ল মিটফোর্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার। ইংরেজ সরকারের আশা- তাকে ব্যস্ত রাখলে যদি এসব লেখালেখি বন্ধ হয়! বরিশালে মাছ, সবজি সবকিছুই ছিল টাটকা আর সস্তা। ঢাকায় এসে পড়লেন বিপদে, জীবনযাত্রার ব্যয় তো বাড়লই, সাথে যোগ হল মশার উপদ্রব। তবে এতো সব মন খারাপ করা বিষয়ের মাঝেও একটা বিষয়ে তিনি খুব তৃপ্ত। ঢাকায় এসে তিনি পেয়েছেন মনের মত এক বন্ধুমহল- সাবজজ তারকনাথ ঘোষ, ঢাকা কলেজের শিক্ষক ভোলানাথ পাল আর ঢাকা জিপিওর ইন্সপেক্টর পোস্টমাস্টার দীনবন্ধু মিত্র। সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা অবশ্য দীনবন্ধুর সাথেই। দীনবন্ধুর মাঝে তিনি যেন তার নিজের ছায়া দেখতে পান।
দুর্গাদাসের মতন দীনবন্ধুও এ শহরে নতুন। বাংলাবাজারের মুখে বিশাল জায়গাজুড়ে ব্যাপ্টিস্ট মিশনের হোস্টেল আর পাঠকক্ষ, তারই গা ঘেঁষে লাল দালানে দীনবন্ধুর কর্মস্থল- ঢাকা জিপিও। পোস্টমাস্টারের চাকরিটা শুরু করেছিলেন ৫ বছর আগে, পাটনায়। এর মাঝে পদোন্নতিও পেয়েছেন। ইন্সপেক্টিং পোস্টমাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন উড়িষ্যা আর নদীয়ায়। কিছুদিন আগে বদলি হয়েছেন ঢাকায়। বাসা নিয়েছেন তাঁতীবাজার এলাকায়। চারদিকে নানাবিধ কারখানা আর কিছু স্বর্ণকারের দোকান। একা মানুষ, সময় কাটানোর জন্য প্রায় সন্ধ্যাতেই চলে আসেন দুর্গাদাসের বাড়িতে। কৌতুকপ্রিয় এক মানুষ এই দীনবন্ধু, মুহূর্তেই যে কোনো আড্ডার মধ্যমণি হয়ে উঠেন। তবে শুধু আড্ডার জন্যই যে তিনি এ বাড়িতে আসেন তা বললে ভুল হবে। গত কিছুদিন ধরে দু'বন্ধুই খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। শহরের লোকেরা যখন ঘুমে অচেতন তখন শুরু হয় তাঁদের ব্যস্ততা। প্রতি রাতেই দীনবন্ধু কিছু ছাপানো কাগজ সাথে নিয়ে আসেন। প্রথমবারের মতন একটা নাটক লিখেছেন দীনবন্ধু, এগুলো ছাপাখানা থেকে জোগাড় করা প্রুফ কপি। পুরো কাজটা তাঁরা করেন খুব সাবধানতা নিয়ে। ভাদ্র মাসের তীব্র গরমের মাঝে ঘরের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে, কুপি জ্বালিয়ে বসে চলে প্রুফ রিডিং। দীনবন্ধু পড়ে চলেন- "রে নরাধম, নীচবৃত্তি নীলকর! এই কি তোমার খ্রীষ্টান ধর্ম্মের জিতেন্দ্রিয়তা?" জন্ম নেয় বাংলা সাহিত্যের যুগসৃষ্টিকারী নাটক 'নীলদর্পণ'।
সময়টা ১৮৬০ সাল। সে বছরের শেষভাগে প্রকাশিত হয় 'নীলদর্পণ'। ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচারে বাংলার কৃষকদের জীবন তখন দুর্বিষহ, বহুবছরের শোষণ আর বঞ্চনার ক্ষোভে তখন গড়ে উঠছে খণ্ড খণ্ড প্রতিরোধ। কাপড়ের রঞ্জক হিসেবে নীলের চাহিদা বরাবরই ছিল। ১৮শতকের শেষ পর্যন্ত বিলেতের চাহিদা পূরণ করত ওয়েস্ট ইন্ডিজে উৎপাদিত নীল। নানা কারণে সেখানের উৎপাদন হ্রাস পায়। ইংরেজদের চোখ পড়ে বাংলার উর্বর জমির উপর। যে জমিতে কৃষকরা এককালে ধান, কলাই, সরিষা চাষ করে সচ্ছল জীবন যাপন করত, ইংরেজরা শুধুমাত্র নিজেদের প্রয়োজনে তাদের সে জমিতে নীলের বীজ বুনতে বাধ্য করে। দাদনের টাকা জোরপূর্বক গ্রহন করানো হয়। ফসলের নায্য দাম বলতে আর কিছুই থাকে না। দাদন নিতে বাধ্য হয়ে কৃষক একসময় নিজের ঘরবাড়ি, জমিজমা, গবাদী পশু সব হারায়। নীলচাষে আপত্তির কোনো সুযোগ ছিল না বাংলার কৃষকের। প্রতিবাদ করলেই দণ্ড। লাঠিপেটা থেকে শুরু করে গৃহদাহ, লুটতরাজ, রাহাজানি কিছুই বাদ যায় না। নীল গুদামগুলো হয়ে উঠে একেকটা কারাগার, নীলকরদের অন্যায়ের প্রতিবাদকারী যে কাউকে সেখানে আটক থাকতে হয় মাসের পর মাস, বাদ যায় না পরিবারের নারীসদস্যরাও। 'অবাধ্য' কৃষককে গুলি করে মেরে ফেলতেও ইংরেজ নীলকরদের এতটুকু বাঁধে না।
দীনবন্ধু ছিলেন নীলকরদের অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী। ঢাকায় আসবার আগে দু'বছর তিনি ছিলেন যশোহর, নদীয়া অঞ্চলের দায়িত্বে। সেখানে দেখেছেন কীভাবে বিঘার পর বিঘা জমির খেঁজুর গাছ কেটে নীলকররা স্থানীয় কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করেছে। নিঃস্ব হয়েছে কৃষক, আর বাড়ির যে নারীটি খেঁজুর পাতা থেকে পাটি বুনে কিছু আয়-রোজগার করত, তারও আয়ের পথ বন্ধ হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের কারণে পুরো উনিশ শতকজুড়েই বিলেতে নীলের চাহিদা বেড়েই চলে। ফলে নীলচাষ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলয়। বদলি সূত্রে দীনবন্ধু যখন ঢাকায় পৌঁছুলেন, দেখলেন এখানেও নীলের চাষ পুরোদমেই চলছে।
খুব সম্ভব ১৮ শতকের শেষেই ঢাকায় নীলচাষের শুরু হয়। জেমস টেলরের A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca বইটি থেকে জানা যায় ১৮০১ সালেও ঢাকায় দু'টি নীলকুঠি ছিল। তবে ১৮১৩ সালে চার্টার অ্যাক্ট পাশের পর বেশ অনেক ইংরেজ ঢাকায় এসে নীলচাষের উদ্যোগ নেয়। পুরান ঢাকার বাইরের অনেক এলাকাই সে সময় কৃষিজমি ছিল। সেসব জমির দখল নিয়ে তারা কৃষকদের নীলচাষে বাধ্য করে। ১৮৪০ সালে ঢাকায় নীলকুঠির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাইত্রিশে। এ সময়ে ঢাকা জেলার প্রায় এক লক্ষ বিঘা জমিতে নীলের চাষ হত আর বছরে উৎপাদন হত আড়াই হাজার মণ নীল। বুড়িগঙ্গার তীর ধরে গড়ে উঠে প্রচুর নীলের কারখানা ও কুঠি। ঢাকার নীলক্ষেতেও চলত নীলের চাষ। বর্তমান আনবিক শক্তি কমিশন অফিসের স্থানে নীলকর জে পি ওয়াইজের একটি কুঠিবাড়ি ছিল। ওয়াইজঘাটের বর্তমান বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ভবনটি ছিল ওয়াইজের বাসভবন। ঢাকার আরেক প্রভাবশালী নীলকর ছিলেন জর্জ ল্যাম্ব। কালক্রমে ঢাকার প্রায় সব কুঠিরই মালিক হয়ে যান এই দুই নীলকর। তাদের জমিদারি বিস্তৃত হয় ঢাকা ছাড়িয়ে ময়মনসিংহ, ফরিদপুর আর বরিশালে। নীলকরদের স্বার্থ রক্ষার্থে ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয় ঢাকার প্রথম পত্রিকা 'ঢাকা নিউজ'। একে বলা হত 'প্ল্যান্টার্স জার্নাল'। প্রতি শনিবার প্রকাশিত হত 'ঢাকা নিউজ'। নীলকরদের পক্ষের নানাবিধ খবরাখবরের পাশাপাশি সেখানে নিয়মিত ছাপানো হত নীল ও কুসুমফুলের চলতি বাজারদর। গুটিকয় দেশি পত্রিকা বাদ দিলে, বঙ্গদেশে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রিকা আর প্রকাশনাগুলোতে নীলচাষিদের হাহাকার কোনো স্থান পেত না।
কর্মজীবনের প্রথম পাঁচ বছরই দীনবন্ধু কাটিয়েছেন উড়িষ্যা, নদীয়া আর ঢাকা জেলায়। সদরে দপ্তর থাকলেও, ডাক ব্যবস্থা তদারকির জন্য যত জায়গায় পোস্ট অফিস আছে সেসব জায়গাতেই দীনবন্ধুকে যেতে হয়েছে। এই জেলাগুলোর বহু জমিতে তখন চলছে নীলচাষ। ফলে দীনবন্ধু খুব কাছে থেকে দেখেছেন গরীব কৃষকদের উপর ইংরেজ নীলকরদের অকথ্য নির্যাতন। এমনিতেই দীনবন্ধু মানুষের কষ্ট দেখলে অস্থির হয়ে উঠেন। তার উপর প্রতিনিয়ত একের পর এক করুণ ঘটনা নিরুপায় হয়ে প্রত্যক্ষ করা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে ওঠে। নিজ অসহায়ত্বর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজেন কালি-কলমে। এর আগে কিছু কবিতা লিখলেও জীবনে প্রথমবারের মতন নাটক লেখার জন্য কলম ধরলেন দীনবন্ধু। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ বিষয়ে চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর দীনবন্ধু জীবনীতে-
"দীনবন্ধু পরের দুঃখে নিতান্ত কাতর হইতেন, নীল-দর্পণ এই গুণের ফল। তিনি বঙ্গদেশের প্রজাগণের দুঃখ সহৃদয়তার সহিত সম্পূর্ণরূপে অনুভূত করিয়াছিলেন বলিয়াই নীল-দৰ্পণ প্রণীত ও প্রচারিত হইয়াছিল। যে সকল মনুষ্য পরের দুঃখে কাতর হন, দীনবন্ধু তাহার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ের অসাধারণ গুণ এই ছিল, যে, যাহার দুঃখ, সে যেরূপ কাতর হইত, দীনবন্ধু তদ্রূপ বা ততোধিক কাতর হইতেন। ইহার একটী অপূৰ্ব্ব উদাহরণ আমি প্রত্যক্ষ করিয়াছি। একদা তিনি যশোহরে আমার বাসায় অবস্থিতি করিতেছিলেন। রাত্রে তাঁহার কোন বন্ধুর কোন উৎকট পীড়ার উপক্রম হইল। যিনি পীড়ার আশঙ্কা করিতেছিলেন, তিনি দীনবন্ধুকে জাগরিত করিলেন, এবং পীড়ার আশঙ্কা জানাইলেন। শুনিয়। দীনবন্ধু মূর্চ্ছিত হইলেন। যিনি স্বয়ং পীড়িত বলিয়া সাহায্যাৰ্থ দীনবন্ধুকে জাগাইয়াছিলেন, তিনিই আবার দীনবন্ধুর শুশ্রূষায় নিযুক্ত হইলেন। ইহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি। সেই দিন জানিয়াছিলাম, যে, অন্য যাহার যে গুণ থাকুক, পরের দুঃখে দীনবন্ধুর ন্যায় কেহ কাতর হয় না। সেই গুণের ফল নীল-দৰ্পণ।"
সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নাটক লিখলেও দীনবন্ধুকে সে নাটক প্রকাশে চরম সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছে। একদিকে নীলকরদের দোর্দণ্ড প্রতাপ আর অন্যদিকে ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি-এই দুই কারণে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয় বই প্রকাশের প্রত্যেক ধাপে। ছাপাখানা নির্বাচন থেকে প্রুফ দেখা সবকিছুতেই গোপনীয়তা। সর্বত্রই যে ইংরেজদের আধিপত্য! ঢাকার প্রথম ছাপাখানা এনেছিলেন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ইংরেজিতে নিজস্ব রিপোর্ট ছাপানোর কাজে তা ব্যবহৃত হত। ধারণা করা হয় এই মুদ্রণযন্ত্রটি পরে নীলকরদের উদ্যোগে 'ঢাকা নিউজ' কিনে নেয় এবং পত্রিকা বের করা শুরু করে। ঢাকায় প্রথম বাংলা মুদ্রণের যন্ত্র বাঙ্গালা যন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ঈশ্বর চন্দ্র বসু আর তাঁর ভাইয়ের ছেলে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবান চন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা)। হরিশ চন্দ্র মিত্র ছিলেন এর কম্পোজিটর। এই মুদ্রণযন্ত্রেই ছাপা হয় দীনবন্ধুর নীলদর্পণ। নীলদর্পণ প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালের অক্টোবর মাসে। বইয়ের প্রচ্ছদে নাটকের পুরো নাম-'নীল দর্পণং নাটকং'। রচয়িতা হিসেবে দীনবন্ধুর নাম গোপন থাকে, সেখানে ছাপানো হয় ছদ্মনাম- ক্ষেমস্বরেন। বাংলা নাট্যসাহিত্যে যখন সংস্কৃতের অনুবাদ আর পুরাণ নির্ভর নাটকের আধিপত্য ঠিক সে সময়ে নীলদর্পণের আবির্ভাব একই সঙ্গে অভিনব ও সাহসী উদ্যোগ। প্রকাশের পরপরই নীলদর্পণ দেশি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ আর বুদ্ধিজীবি মহলে তুলল ব্যাপক আলোড়ন। ইংরেজ নীলকরদের বর্বর চরিত্র সবার সামনে উন্মোচিত করে নীলদর্পণ হয়ে উঠল সময়ের মানবিক এক দলিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একে তুলনা করেছেন Uncle Tom's Cabin এর সাথে - " নীলদর্পণ বাঙ্গালার Uncle Tom's Cabin, 'টম কাকার কুটীর' আমেরিকার কাফ্রীদিগের দাসত্ব ঘুচাইয়াছে, নীলদর্পণ নীলদাসদিগের দাসত্বমোচনের অনেকটা কাজ করিয়াছে।"
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শিবনাথ শাস্ত্রী অভিভূত হয়ে লিখেছেন-
"নাটকখানি বঙ্গসমাজে কি মহা উদ্দীপনার আবির্ভাব করিয়াছিল, তাহা আমরা কখনও. ভুলিব না, আবালবৃদ্ধবনিতা আমরা সকলেই ক্ষিপ্তপ্রায় হইয়া গিয়াছিলাম। ঘরে ঘরে সেই কথা, বাসাতে বাসাতে তাহার অভিনয়। ভূমিকম্পের ন্যায় বঙ্গদেশের সীমা হইতে সীমান্ত পর্যন্ত কাঁপিয়া যাইতে লাগিল।"
নীলদর্পণের গ্রহনযোগ্যতা শহর ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল প্রত্যন্ত গ্রামে, কবিয়ালেরা নীলদর্পণের কাহিনীনির্ভর গান তৈরি করলেন। বিদ্রোহের রসদ হয়ে সে গান ছড়িয়ে গেল নিরক্ষর নীলচাষীদের মাঝে।
"হে নিরদয় নীলকরগণ।
আর সহে না প্রাণে এ নীল দহন॥
কৃষকের ধনে প্রাণে, দহিলে নীল আগুনে,
গুণরাশি কি কুদিনে, কল্লে হেতা পদার্পণ।
দাদনের সুকৌশলে, শ্বেত সমাজের বলে,
লুঠেছ সকল তো হে কি আর আছে এখন॥
দীন জনে দুঃখ দিতে কাহার না লাগে চিতে,
কেবল নীলের হেরি পাষাণ সমান মন।
বৃটন স্বভাবে শেষে, কালী দিলে বঙ্গে এসে,
তরিলে জলধিজল, পোড়াতে স্বর্ণভবন॥"
বইপ্রকাশের মাত্র একবছরের মধ্যেই ১৮৬১ সালের জুন মাসে প্রথম ঢাকাতে মঞ্চস্থ হয় নীলদর্পণ। জুনের ১২ তারিখে প্রকাশিত কলকাতার 'হরকরা' পত্রিকায় ঢাকা সংবাদদাতা এ সংক্রান্ত একটি খবর জানান এভাবে- "Our native friends entertain themselves with occasional theatrical performances and the Nildarpana was acted on these occasions ."
নাটক মঞ্চায়নের কালে লেখক দীনবন্ধু মিত্র সহ ডাক্তার দুর্গাদাস কর, ডাক্তার বৃন্দাবনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকায় তখনো পেশাদার নাট্যমঞ্চ গড়ে উঠেনি। সম্ভবত বরিশালে 'স্বর্ণশৃঙ্খল' নাটকের মঞ্চায়নে অংশ নেয়া উৎসাহী অভিনেতা, অভিনেত্রীরাই ঢাকার নীলদর্পণ মঞ্চায়নে সাহায্য করেছিলেন। এরপর দীনবন্ধু বদলি হয়ে যান নদীয়া। তিনি আরো একবার কর্মসূত্রে ঢাকা এসেছিলেন। তবে সে অবস্থানের বিস্তারিত আজও অজ্ঞাত।
-
সহায়ক সূত্রঃ
১- দীনবন্ধু রচনাবলী, ক্ষেত্রগুপ্ত সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, ১৯৬৭, কলকাতা
২- ঢাকা আমার ঢাকা, সাঈদ আহমদ, সাহিত্যপ্রকাশ, ২০১০, ঢাকা
৩- ঊনিশ শতকে ঢাকার থিয়েটার, মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৭৯, ঢাকা
৪- পুরানো ঢাকার সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, অনুপম হায়াৎ, বাংলা একাডেমি, ২০০১, ঢাকা
৫- Rural Life in Bengal: Illustrative of Anglo-Indian Suburban Life, C. Grant, W. Thacker & Co., 1860, London.