শিরোনামের সঙ্গে বাজেট কাঠামোর সংযোগ কম: সানেম
- ঘোষণায় থাকলেও বাজেট ব্যয়ে জীবন-জীবিকার প্রাধান্য নেই
- জিডিপির আকারের তুলনায় ১৭.৫% বাজেট যথেষ্ট নয়
- নতুন করে সৃষ্ট আড়াই কোটি দরিদ্র নিয়ে কোনো কথা নেই
- চাকরি হারানো কয়েক লাখ মানুষের জন্য নেই প্রণোদনা
- শিক্ষার জন্য সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও ডিজিটাল ডিভাইস সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেই
- পরোক্ষ কর-নির্ভরতা বৈষম্য বাড়াবে
সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটে শিরোনামের সঙ্গে আয় ও ব্যয় কাঠামোর সংযোগ কম বলে মনে করছে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
সানেম বলছে, করপোরেট করহারে ছাড়, স্থানীয় বিনিয়োগে করছাড় সহ কয়েকটি ছাড়ে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হবে। তবে করোনার এই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য তেমন কিছু নেই বাজেটে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করা ভ্যাট ও শুল্কে উল্লেখযোগ্য ছাড় নেই। নতুন করে সৃষ্ট আড়াই লাখ দরিদ্রের জন্য কিছু বলা হয়নি, কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকারদের জন্য কিছু নেই, স্বাস্থ্যখাতে বড় কোনো সংস্কারের প্রস্তাবও নেই। ফলে এটিকে জীবন ও জীবিকার প্রাধান্যের বাজেট বলা যাবে না।
শনিবার (০৫ জুন) বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা জানায় সানেম। ভার্চুয়াল এ আলোচনায় অংশ নেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান এবং সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের আরেকজন অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা।
বৃহস্পতিবার (৩ জুন) দেশের ইতিহাসে ৫০ তম বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল। বাজেটের শিরোনাম রাখা হয়েছে 'জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য সুদূঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ।
ড. সেলিম রায়হান তার আলোচনায় বলেন এ বছরের বাজেট ঘোষণায় মহামারি পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে নিরূপণ করা হয় নি। করোনার এ সময়ে মাঠ পর্যায়ের সঠিক পরিস্থিতি সরকারের হাতে নেই।
তিনি বলেন, বাজেটের অনেক জায়গায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা বলা হলেও সামাজিক পুনরুদ্ধারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রতিফলিত হয় নি। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, দারিদ্র্য, বৈষম্যের বিষয়গুলো যথার্থভাবে আসেনি।
তিনি বলেন টাকার অংকে বাজেট বাড়লেও জিডিপির অনুপাতে আমাদের বাজেট খুব সামান্যই বেড়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ। দশ বছর আগেও এর হার এমনই ছিল।
মহামারির এ সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষাখাতে বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ বরাদ্দ করার মাধ্যমে জিডিপির তুলনায় বাজেট অনুপাত আরো বাড়ানো যেতো। কিন্তু বরাবরের মতোই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার জিডিপির ১ শতাংশ হারে ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। এটা আরো বাড়াতে হবে। এ বাজেট এলডিসি উত্তরণে সহায়ক নয়।
শিক্ষাখাত করোনা মহামারির কারণে যে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাজেটে তার প্রতিফলন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে 'ডিজিটাল ডিভাইস' এর মত নতুন বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বাল্য বিবাহের হার বাড়ছে। এসব মোকাবিলায় শিক্ষাখাতে সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা বাজেট ঘোষণায় নেই।
নতুন করে সৃষ্ট আড়াই লাখ দারিদ্রের বিষয়টি বাজেটে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে সানেম বলছে, দেশের পুরোনো গরীবদের যে তালিকা সেটি ত্রুটিপূর্ণ। অনেক গরীব মানুষ সেই তালিকায় নেই, আবার অনেক স্বচ্ছল মানুষ সেখানে সামাজিক ভাতা পান। অন্যদিকে মহামারির কারণে নতুন করে যারা গরীব হয়েছেন, তাদের কোন তালিকা সরকারের কাছে নেই। বাজেটে এ নিয়ে কোনো কথাও নেই।
মহামারি মোকাবেলায় বাজেট হয়নি উল্লেখ করে ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, বাজেটে মোটামুটিভাবে আগের বছরগুলোর একটা ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাত, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়লেও এটি খুব সামান্য।
বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় এর একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। এটাকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বলতে পারি। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে যে ব্যবসাকে চাঙ্গা করতে প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে সেটার সুবিধা সাধারণ জনগণ, নিম্ন আয়ের মানুষ, মধ্যবিত্তরা কতটা পাবেন সেটা সুস্পষ্ট নয়।
তিনি বলেন, যে ছাড়গুলো দেয়া হয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মধ্যম আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা সুবিধা পাবে তা সুস্পষ্ট নয়। এ ছাড়ের ফলে সাধারণ মানুষ কতটা সুবিধা পাবে, কর্মসংস্থান কতটা উজ্জীবিত হবে সেটার ব্যাপারে আমাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে পলিসিগত বিষয়েও দুর্বলতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বড় ধরণের একটা সংস্কার দরকার ছিল। গতানুগতিকতার বাইরে যেয়ে একটা ভিন্ন কিছুর আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে ছিল, যেটা আমরা বাজেটে লক্ষ্য করিনি।
তিনি বলেন, আমরা দেখেছি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কিছু ছাড়, প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। ই-লার্নিং এর ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া হয়েছে, ১০ লাখ মানুষকে আইটি খাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। কিন্তু এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের শ্রমবাজারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খুবই ছোট ছোট উদ্যোগ। ফলে এটাকে বড় করে না দেখে একটা সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনার আশা করছি আমরা।