বান্দরবানে কাজুবাদাম চাষ: ফলন ও দামে হতাশ চাষীরা
বান্দরবান জেলায় এবার কাজুবাদামের ফলন কম হয়েছে। গাছে ভাল মুকুল আসলেও সে পরিমাণে ফল ধরেনি। এর সাথে এ বছর দাম কম হওয়ায় হতাশার কথা জানিয়েছেন চাষীরা।
এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. একেএম নাজমুল হক বলেন, "কাজুবাদামের দাম সবসময় মান ও চাহিদার উপর নির্ভর করে। এ বছর গাছে ফুল আসার সময় স্বাভাবিক বৃষ্টিটুকু ছিল না। যার কারণে অনেকটাই ঝরে গেছে। যেগুলো ফল হিসেবে এসেছে সেগুলোও হয়তো মানহীন"।
''কাজুবাদামের যেটা বাদাম হিসেবে খাওয়ার অংশ সেটাকে নাট বলা হয়। এগুলো ভালো করে রোদে শুকাতে হয়। মান ও আকারে বড় থাকলে তখন দামও ভাল পাওয়া যায়। ভাল ফুল ও নাটের জন্য গাছের গোড়ায় সার প্রয়োগ করতে হয়। পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য স্প্রেও করতে হয়।''
সম্প্রতি রোয়াংছড়ি উপজেলার সদরে সুয়ানলু পাড়ায় সরেজমিনে গেলে কাজুবাদাম চাষীরা জানান, এ পাড়ার অধিকাংশ পরিবার কাজুবাদাম চাষী। গত বছরের চেয়ে এবার কম দাম পাচ্ছেন তারা। অনেকেই আগামী বছর ভাল দাম পাওয়ার আশায় শুকিয়ে ঘরেই রেখে দিচ্ছেন কাজুবাদামগুলো।
এ পাড়াবাসী রাওলম বম জানান, তাঁর পাঁচ একরের জায়গায় ২০০ গাছ রয়েছে। যখন মুকুল ভালই আসছিল এমন সময় হালকা বৃষ্টি দরকার ছিল। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়ায় ভাল ফল ধরেনি। গেল বছর পাঁচ মণ নাটের (বাদাম হিসেবে খাওয়ার অংশ) জায়গায় এবার মাত্র ৩ মণ পেয়েছেন তিনি। এতেও মণ প্রতি দুই হাজারের বেশি বিক্রি হয় না।
কাজুবাদামের দাম ও ফলন নিয়ে হতাশার সুরে একই পাড়ার বাসিন্দা চাষী পারখুপ বম ও দানিয়াল বম বলেন, তাদের প্রত্যেকের দুই থেকে তিনশটি কাজুবাদাম গাছ রয়েছে। এবার মুকুল বেশি ধরেছিল। তবে ফলন কম। ব্যবসায়ীরাও ভাল দাম দিয়ে কিনতে চায় না। এ কারণে আগামী বছর ভাল দামে বিক্রির আশায় ঘরে মজুত করে রাখছেন।
তবে তিন-চার বছর আগেও কাজুবাদামের দাম মণ প্রতি ৩ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে বলে সাপলাই কারবারী ও ভাননিঙাক বম জানান।
তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যোগাযোগের অভাব এবং চাহিদা না থাকায় একসময় বিক্রিই হত না। কাজুবাদাম বাগানে এমনিই পড়ে থাকত। কয়েক বছর হল ব্যবসায়ীরা এসে ভাল দামে কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু গত বছর থেকে হঠাৎ দাম পড়ে যায়। এ বছর মণ প্রতি ২ হাজার টাকায় নেমে আসে।
এদিকে রোয়াংছড়ির স্থানীয় ব্যবসায়ী অংশৈসিং মারমা ও চিংমং মারমা জানান, চাষীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের আড়তে কাজুবাদাম সরবরাহ করে থাকেন তারা। রোয়াংছড়ি এলাকার বিভিন্ন চাষীদের কাছ থেকে এ পর্যন্ত দেড়শ মণের মত কাজুবাদাম সংগ্রহ করা হয়েছে। নাট এর মানভেদে মণ প্রতি ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ পর্যন্ত দাম দিয়েছেন তারা।
দাম নিয়ে চাষীদের অসন্তোষ্ট বিষয়ে এই দুই ব্যবসায়ীর ভাষ্য, মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বাইরের ব্যবসায়ীরা না আসায় গত বছর থেকে দাম কমে যায়। এছাড়া এ বছর ফলন কম হওয়ার পাশাপাশি নাটের মানও ভাল নয়। এ কারণে দাম কম হয়ে থাকে।
থানচি উপজেলার কয়েকজন কাজু বাদাম চাষীদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারাও জানান, মুকুল আসার সময় নির্দিষ্ট তাপমাত্রা থাকতে হয়। দরকার হালকা বৃষ্টিও। আবার বৃষ্টি বেশি হলেও মুকুল ঝরে যায়। এমন পরিস্থিতিতে আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় কাজুবাদামের ফল কম ধরেছে।
থানচি উপজেলার ছান্দাক পাড়াবাসী নিথোয়াই অং মারমা ও বাচিং মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তাদের প্রত্যেকের বাগানে দুই হাজারে মত কাজুবাদামের গাছ রয়েছে। এ বছর সেখান থেকে ২০ মণ করে নাট পেয়েছেন তারা। কিন্তু এ বছর বিক্রি করতে হচ্ছে মণ প্রতি মাত্র ১৭শ টাকায়।
''গত বছরও যথাসময়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা থাকায় ফল ও নাট আকারে বড় ছিল। যার কারণে দাম বেশি ছিল। তখন মণ প্রতি ৩,২০০ থেকে ৩,৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।''
এই এলাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী স্বপন কুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, তিনি এ বছর থানচি এলাকা থেকে এক মণ ১৮০০ টাকায় কাজু বাদাম সংগ্রহ করছেন। বর্তমানে তার কাছে ১০০ মণ কাজুবাদাম রয়েছে। কিন্তু মান এত ভাল নয়।
এদিকে মানভেদে দামে তারতম্য থাকলেও কাজুবাদাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের একটি সম্ভাবনাময় কৃষি পণ্য উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. একেএম নাজমুল হক জানান, কাজুবাদামের জন্য এ বছর থেকে ২১১ কোটির একটা প্রকল্প শুরু হচ্ছে। এ প্রকল্প থেকে চাষীদের বিনামূল্যে চারা বিতরণ ও কাজুবাদাম প্রদর্শনী, সার বিতরণ ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।
কৃষকরা এ সুবিধা পাওয়ার পর পাহাড়ে কাজু বাদামের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়ে যাবে বলে আশা করছেন কৃষি বিভাগের এই কর্মকর্তা।