আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধন চায় ইইউ
চলমান জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি) সুবিধা অব্যাহত রাখা ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণের পর জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ার জন্য শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা ও তাদের হয়রানি বন্ধে বাংলাদেশকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই শ্রম আইন সংশোধন করতে বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
শ্রমিক হয়রানি ও নির্যাতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি ২০২২ এর জুনের মধ্যে বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন সংশোধন করে সেখানকার শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা এবং ইপিজেডভুক্ত কারখানাগুলোতে যাতে কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) পরিদর্শন করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে ইইউ।
ইইউ এর চলমান জিএসপি স্কিম এর মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে শেষ হবে। পরের বছর থেকে নতুন স্কিম চালু হবে। আগামী জুনে ইইউর নতুন জিএসপি রেজুলেশনের খসড়াটি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হবে। তার আগেই শ্রমিক অধিকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই দুই আইন সংশোধনে চাপ দিচ্ছে ইইউ। এর ওপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশ ২০২৪ সাল থেকে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) বাণিজ্য স্কিমের আওতায় সুবিধা পাবে কি-না।
এছাড়া, শিশু শ্রম নিরসনের জন্য অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার রোডম্যাপ ইইউকে জানানো এবং কৃষি, ফরেস্ট্রি এন্ড ফিশিং, কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি, মাইনিং এন্ড ম্যানুফ্যাকচারিং এন্ড সার্ভিসেস (ডমেস্টিক ওয়ার্ক) কে শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে ইইউ।
এভরিথিং বাট আর্মস সুবিধা ধরে রাখার জন্য শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশকে ২০১৯ সালে ৯ দফা একশন প্ল্যান দিয়ে তা বাস্তবায়নের রোডম্যাপ চায় ইইউ, যাতে মোট পয়েন্ট রয়েছে ১০৩টি। গতবছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশ একটি রোড ম্যাপ দেওয়ার পর তাতে 'সিরিয়াস ফ্রাস্ট্রেশন' প্রকাশ করে ১০ ডিসেম্বর মতামত দেন ইইউ কর্মকর্তারা।
তাদের ওই মতামত অন্তর্ভুক্ত করে ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সভা করে গত ৫ এপ্রিল সংশোধিত রোডম্যাপ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। তাতেও সন্তুষ্ট নয় ২৬ দেশের জোটটি।
তারা ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা, শ্রমিক অধিকার রক্ষায় রোডম্যাপে বাংলাদেশের উল্লেখিত সীমার অনেক আগেই বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা সংশোধন করা, এন্টি ইউনিয়ন ডিসক্রিমিনেশন বা ইউনিয়ন বিরোধী বৈষম্যের শাস্তি বৃদ্ধি করা, সহিংসতা এবং হয়রানির কারণে ছাঁটাই করা শ্রমিকদের পুনর্বহাল ও তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, ন্যূনতম মজুরিসহ অন্যান্য শ্রম অসন্তোষের ক্ষেত্রে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণসহ ১৮টি পয়েন্ট তুলে ধরে নিজেদের অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে ইইউ।
এই ১৮ দফা প্রস্তাব দিয়ে আগামী ১৫ জুন ইইউ সদর দপ্তরের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সভা হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শ্রম সচিবের। সেখানে এসব শর্ত বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরবেন তারা। গুরুত্বপূর্ণ ওই বৈঠকের প্রস্তুতি নিতে বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে স্টেকহোল্ডার সভা হয়েছে, যেখানে দেশের প্রধান রপ্তানিখাত বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
সভায় অংশ নেওয়া বিকেএমইএ'র পরিচালক ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ইইউ'র দেওয়া শর্তগুলোর কোনগুলো বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব, আর কোনগুলো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়, সেসব বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধনের কথা রোডম্যাপে উল্লেখ করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ইইউ চায় আগামী জুনের মধ্যে। বাংলাদেশে একটি আইন সংশোধনের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও চলমান কোভিড পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়ার জন্য ইইউকে অনুরোধ করবে সরকার।
'ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইপিজেড আইন সংশোধন করে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের বদলে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা এবং ইপিজেডভুক্ত কারখানাগুলোতে ডিআইএফই এর মাধ্যমে ইন্সপেকশন করার বিষয়ে সম্মতি দিতে প্রস্তুত সরকার। তবে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা কঠিন হবে।'
'ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে না-এমন নিশ্চয়তা দিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ এনেছে। এখন সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হতাশ হবে', সভায় এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
ইইউ এর শর্ত নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি শ্রম সচিব কে এম আবদুস সালাম।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আন্দোলন দমাতে শ্রমিকদের ওপর দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালানোর সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেছে ইইউ, যাতে রাজী হবে না সরকার। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদনের সঙ্গে কারখানার ২০% শ্রমিকের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার শর্ত শিথিল করে ১০% করার কথা বলেছে ইইউ, যাতে আপত্তি রয়েছে মালিকদের।
'আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষেপাবো না। তাদের দেওয়া শর্ত মানার ক্ষেত্রে যতোটা সম্ভব ছাড় আদায় করার চেষ্টা করবো। আমাদের ইবিএ সুবিধা ২০২৯ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে আশা করছি। যদি আমরা নিশ্চিত হই যে, এলডিসি থেকে গ্রাজুয়েশনের পর ইইউ বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাস সুবিধা দেবে, তাহলে কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে হলেও তাদের দেওয়া শর্তগুলো পূরণে বাংলাদেশ আন্তরিক থাকবে'- জানান ওই কর্মকর্তা।
গৃহকর্মেও শিশুশ্রম নিষিদ্ধ চায় ইইউ
ইইউ প্রণীত ৯ দফা একশান প্ল্যানে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশু শ্রম নিরসনের কথা বলা ছিল। সরকারের পরিকল্পনা ছিল ওই সময়ের মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পখাতগুলো থেকে শিশুশ্রম দূর করবে।
ইইউ বলছে, কেবল রপ্তানিমুখী শিল্পই নয়, কৃষি, ফরেস্ট্রি, ফিশিং, সব ধরণের শিল্প ও সেবাখাত, কৃষিখাত এমনকি গৃহকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করার রোডম্যাপ চেয়েছে বাংলাদেশের কাছে। গৃহকর্ম ও কৃষিখাত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করার শর্ত মানা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই কঠিন বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
শিশু শ্রম নিরসনের লক্ষ্যে আগের প্রস্তাবে ইইউ মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা ও শতভাগ তালিকাভুক্তি বাস্তবায়নের রোডম্যাপ চেয়েছিল, যা বাংলাদেশ জমা দেয়নি।
এখন বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ইইউ। শিশু শ্রম নিরসনের জন্য ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুসহ এ সম্পর্কিত বিষয় রোডম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে সংস্থাটি।
এছাড়া, বাংলাদেশ শ্রম আইন ও ইপিজেড শ্রম আইনে শিশু শ্রমের ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান সংযোজন করতে বলেছে ইইউ।
বেশি সময় দিতে নারাজ ইইউ
নিউ জিএসপি রেজুলেশন আগামী বছর জুনে ইইউ পার্লামেন্টে পাস হওয়ার আগেই বাংলাদেশ শ্রম আইন, ইপিজেড শ্রম আইন, ইপিজেড শ্রম বিধিমালা সংশোধনসহ নতুন শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা, শ্রম পরিদর্শকের খালি পদ পূরণ করা ও নতুন পদ সৃষ্টি করতে চাপ দিচ্ছে সংস্থাটি।
৯ দফা একশন প্ল্যান বাস্তবায়নের রোডম্যাপে বাংলাদেশ শ্রমিক অধিকার সুরক্ষায় বিভিন্ন আইন ও বিধিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী বছর জুনের মধ্যেই সব ধরণের আইন সংশোধনের ব্যাপারে অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছে।
তাছাড়া, রোডম্যাপে বাংলাদেশ ইপিজেড আইন সংশোধন না করার পক্ষে অবস্থানের কথা জানিয়েছিল, তাও মানছে না ইইউ। এ আইনটিও আগামী বছর জুনের মধ্যে সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর পক্ষে কঠোর অবস্থান নিয়েছে তারা।
ইপিজেড আইন সংশোধনের আগেই, চলতি জুনের মধ্যে বাংলাদেশ শ্রম বিধি, ২০১৫ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইপিজেড শ্রম বিধিমালা প্রণয়ন করতে চাপ দিচ্ছে ইইউ। এছাড়া, ডিআইএফই যাতে ইপিজেডে ইন্সপেকশন চালাতে পারে, সেজন্য নীতি কাঠামো চলতি জুনের মধ্যেই প্রণয়ন করতে বলেছে ইইউ।
রোডম্যাপে নতুন শ্রম আদালত স্থাপনের কাজ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চেয়েছিল শ্রম মন্ত্রণালয়, কিন্তু ইইউ'র শর্ত হলো, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নতুন আদালত স্থাপন করতে হবে।
আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ শ্রম পরিদর্শকদের খালি পদগুলো পূরণের রোডম্যাপ করেছিল ঢাকা, কিন্তু ইইউ সদরদপ্তর বলেছে, খালি পদগুলো চলতি বছরের মধ্যেই পূরণ করতে হবে। এবং আগামী মার্চের মধ্যে নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে।
এছাড়া, রানা প্লাজা ধসের পর শুরু হওয়া গার্মেন্টস কারখানা সংস্কার কার্যক্রম চলতি বছরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে নতুন শর্ত দিয়েছে ইইউ, যা বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করছে বাংলাদেশ।