অন্ধ হয়েও দাবায় চ্যাম্পিয়ন যে নারী
দাবার বোর্ডে জেসিকা লজার দুর্দমনীয় এক নারী। প্রতিপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দ্রুত খেলতে পারেন তিনি। তিনি অনবরত আক্রমণ করেন, অনেকটা নেটফ্লিক্সের টিভি সিরিজ 'দ্য কুইন'স গ্যাম্বিট' এর চরিত্র বেথ হারমনের মতোই। তিনি নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীকে প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সুবিধাজনক অবস্থানের বাইরে নিয়ে আসেন, এরপর আক্রমণ করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে নেন এবং একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে যান।
দাবা খেলায় এই সফলতার জন্য অজস্র প্রশংসা নিজের ঝুলিতে ভরেছেন লজার। একটি চ্যাম্পিয়নশিপ দলেও জায়গা করে নিয়েছেন যেখানে বিশ্বের বিখ্যাত দাবাড়ুদের সাথে খেলতে হয় প্রতিযোগীদের।
কিন্তু এসব শুনেও যদি আপনার মনে কৌতূহল না জাগে, তাহলে জানিয়ে রাখি যে লজার আসলে চোখে দেখতে পান না।
৪১ বছর বয়সী লজারের কাছে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই দাবা ছিল নেশার মতো, অবসর কাটানোর দারুণ উপায়ও বটে। তিনি এই খেলাকে ভালোবাসেন এবং কখনোই নিজের শারীরিক অক্ষমতার জন্য পিছিয়ে থাকতে চাননি।
সম্প্রতি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে লজার নিজের মনের ভাব ব্যক্ত করেছেন, 'আমি যখন দাবা খেলতে বসি, তখন সবকিছুতে সবচেয়ে বেশি সাম্য অনুভব করি। কারণ একবার আপনি খেলতে শুরু করার সাথে সাথেই সেখানে আপনার অবস্থান, শারীরিক বৈশিষ্ট্য, টাকাপয়সা কোনোকিছু এখানে আলোচ্য নয়; উভয় পক্ষই তখন সমানে সমান।'
কটূক্তি বন্ধের উপায়
লজার তার জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই অন্ধ ছিলেন। চার মাস অকালপক্ক অবস্থায় জন্ম নেওয়ায় তাকে অক্সিজেন দিতে হয়েছিল যার ফলশ্রু তিতে তার চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় 'রেটিনোপ্যাথি'। ফলে লজারের এক চোখ পুরোপুরি অন্ধ এবং অন্য চোখে তার ২০/৪৮০ এর মত দৃষ্টি আছে। অর্থাৎ লজারের চোখে দেখার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ এবং তার দৃষ্টিতে কোনোকিছু গভীরভাবে উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে।
তার চোখে দাবার গুটিগুলো ঘোলা এবং বিকৃত আকারের হয়ে ধরা পড়ে।
লজার জানান, দাবার ঘরে গুটি আছে কিনা তা তিনি বলতে পারেন; কিন্তু কোন গুটি তা সবসময় সঠিক বুঝতে পারেন না। এর জন্য তাকে গুটিগুলো স্পর্শ করে বুঝে নিতে হয়।
সাত বছর বয়সে লজার দাবা খেলা শেখেন এবং কিশোর বয়স থেকেই এটিকে গুরুত্বের সাথে নেন। এক পর্যায়ে তার অক্ষমতা নিয়ে যারা মজা করতো, তাদের মুখ বন্ধ করার একটি উপায় তিনি পেলেন; আর তা হলো দাবা। তবে দাবা লজারের কাছে এর চাইতেও অনেক বেশি কিছু।
লজার মনে করেন, দাবা খেলায় কোনো শিশুও চাইলে বড়দের হারিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ এখানে গায়ের জোর কোনো বিষয় নয়। আর সে কারণেই আমি দাবা খেলা আরও ভালোভাবে শিখতে আগ্রহী হই।
৩৬ বছর বয়সে তিনি দুটি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়েছেন সান ফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে এবং সেটিই লজারের দাবা খেলার জন্য প্রিয় একটি জায়গা। আর তার খেলার সময় যে সেখানে দর্শকের ভিড় জমে যায় তা বলাই বাহুল্য।
মহামারিকালে দাবায় তুমুল আগ্রহ
লজারের জন্য করোনা মহামারিকালে অন্য সব দুশ্চিন্তা ভুলে থাকার একটা বড় উপায় ছিল দাবা খেলা। ২০২০ সালে করোনা সংকট যখন তুঙ্গে, তখনই তিনি টানা তৃতীয়বারের মত ইউএস ব্লাইন্ড চেস চ্যাম্পিয়নশিপে স্কোর করেন।
সময়টা ছিল ২০২০ সালের অক্টোবর। সেবারই যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পিপল ফর ডিজ্যাবিলিটিজ এর সঙ্গে একটি বার্ষিক অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। লজারের দলে ছিলেন আরও চারজন শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি। করোনার জন্য খেলাটি হয়েছিল ভার্চুয়ালি। কোচ লায়র ল্যাপিড ভাবতেই পারেননি যে রাশিয়া ও ব্রাজিলের মতো কঠিন প্রতিপক্ষের সামনে আমেরিকা টিকতে পারবে। ৪৪ টি দেশের ৬০ টি দলের মধ্যে আমেরিকার অবস্থান ছিল ৩৯তম এবং ল্যাপিডের দল ১০ম অবস্থানে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
লজারের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?
অলিম্পিয়াডে ভালো ফলাফল করার পরও দাবা খেলায় লজারের ভবিষ্যত এখনো অস্পষ্ট।
একদিকে লজার ও তার দলের সদস্যরা তারকা বনে গেছেন এবং কোচ ল্যাপিডের বোন তাদের খেলার ভিডিও ফুটেজ নিয়েছেন। তিনি তাদের সংগ্রামী লড়াই দেখানোর জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্রও বানাতে চাইছেন।
অন্যদিকে লজারের ইচ্ছা এ বছর অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ২০২২ অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়া। কিন্তু তিনি চিন্তিত এই ভেবে যে তিনি হয়ত ভেন্যুতে যাওয়ার খরচ জোগাড় করতে পারবেন না এবং ঘরেই বসে থাকতে হবে।
তবে কোচ ল্যাপিড বিশ্বাস করেন, তার দলের পারফরমেন্স দেখে বিভিন্ন দাবা ফেডারেশন হয়তো তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিবে।
তবে যা-ই ঘটুক না কেন, জেসিকা লজার কিন্তু দাবা বিশারদ হওয়ার জন্য তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন বিসর্জন দিবেন না। তিনি বলেন, 'অনেকেই বলে যে তুমি কিছু অর্জন করতে চাইলে নির্দিষ্ট একটা বয়সের মধ্যেই অর্জন করতে হবে; তা নাহলে তুমি আর কখনোই পারবে না। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করিনা, কারণ আমার জীবন আর দশটা মানুষের মতো নয়।'
- সূত্র: সিএনএন