আছে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি, নেই ব্যবহার
জনগণের দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে সাতক্ষীরার ২২ লাখ মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে জেলা শহরের বাঁকাল এলাকায় নির্মাণ করা হয় হাসপাতালটি। উন্নত চিকিৎসাসেবা, যন্ত্রপাতি ও ভবন থাকলেও হয়নি চিকিৎসা সেবার কোনো উন্নতি।
মেডিকেল কলেজটিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নেই যন্ত্রপাতি ব্যবহারের টেকনেশিয়ান। ফলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবন ও হাসপাতালটির সুফল পাচ্ছে না জেলাবাসী। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সামান্য জনবল দিয়েই আমরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা প্রদানের চেষ্টা করছি। এছাড়া উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানালেও এখনো নিরসন হয়নি সংকটের।
২০১২ সালের ২০ জুলাই তৎকালীন স্বাস্থ্য মন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হক সাতক্ষীরায় মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের ৪ এপ্রিল হাসপাতালটির উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
আশাশুনি উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা দরগাপুর থেকে গত ২ ডিসেম্বর চোখের সমস্যা নিয়ে চিকিৎসার জন্য সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলী। কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করে চক্ষু চিকিৎসকের কাছে পৌঁছান তিনি। তবে তার ভাগ্যে চিকিৎসা জোটেনি।
মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আলী বলেন, আমার চোখে সমস্যা হয়েছে। এখন ঠিকমতো দেখতে পারি না। অনেক আশা নিয়ে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর চক্ষু চিকিৎসক আলমগীর কবীরের কাছে গিয়েছি। তবে ওই চিকিৎসক একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে শহরের বেসরকারি হাসপাতাল চায়না বাংলায় গিয়ে তাকে দেখানোর পরামর্শ দেন। শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে এত বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তৈরি করলো কিন্তু কোনো উপকারেই আসলো না আমার। অন্যদেরও একই অবস্থা।
তবে মুক্তিযোদ্ধার ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চক্ষু চিকিৎসক আলমগীর কবীর বলেন, হাসপাতালে যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকে তবে আমি কিভাবে চিকিৎসা দিব। যন্ত্রপাতি রয়েছে কিন্তু যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জনবল নেই। যার কারণে রোগীদের বাইরে ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে বলা হয়।
জেলার তালা উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের মনোহরপুর গ্রামের আবদুল মান্নানের ছেলে গোলাম রাব্বানী। বুকের ব্যাথ্যা ও বমির জন্য ৩ ডিসেম্বর চিকিৎসা নিতে আসেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
গোলাম রাব্বানী বলেন, চিকিৎসক দেখার পর বেশ কিছু পরীক্ষা দিয়েছেন। পরে প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে জানতে পারি এখানে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। বাইরে কোথাও থেকে করাতে হবে। তারপর আবার ডাক্তারকে দেখানোর পরামর্শ দেয় প্যাথলজি বিভাগ।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রধান সহকারী স্বদেশ কুমার রায় বলেন, হাসপাতালে জনবল সংকট প্রকট। চিকিৎসক ৫৮ জনের স্থলে রয়েছে ১৭ জন। শূন্য পদ ৪১। নাসিং কর্মকর্তাদের ৮৬ পদের মধ্যে পূরণ রয়েছে ৭৯ পদ। বাকি সাতটি পদ খালি। এরমধ্যে সেবা তত্ত্বাবধায়ক একজন তবে পদ শূন্য, উপ-সেবা তত্ত্বাবধয়াক একজন সেটিও পদ শূন্য, নার্সিং সুপারভাইজার চারজনের মধ্যে রয়েছে একজন। সিনিয়র স্টাফ নার্স ৮০ জনের মধ্যে রয়েছে ৭৮ জন। হাসপাতালের কর্মচারীদের মোট মঞ্জুরীকৃত পদের সংখ্যা ৪১টি। এরমধ্য শূন্য পদ ২৪ টি, পূরণ রয়েছে ১৭টি। আউট সোর্সিং পদের সংখ্যা ৭৬ জন, এই খাতে শূন্য পদ নেই।
তিনি আরও বলেন, অফিসের কাজ করতে গিয়ে আমাদের রিতিমত হিমশিম খেতে হয়। কর্মচারীদের শূন্যপদের কাজগুলোও বিভিন্ন পদে থাকা অন্য কর্মচারীদের দিয়ে করাতে হয়। ২৪টি শূন্য পদের দায়িত্বের কাজগুলোও পদে থাকা ১৭ জনকে দিয়ে করাতে হিমসিম খেতে হয়। একেক জনের উপর রয়েছে বাড়তি দায়িত্বের বোঝা।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ড. কাজী আরিফ বলেন, এখানে চিকিৎসক সংকট রয়েছে। এছাড়া উন্নত যন্ত্রপাতি অপারেট করার মত প্রয়োজনীয় কেমিক্যাল রি-এজেন্ট ও অপারেটর নেই। যার কারণে আমরা কাঙ্খিত সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। তবে আমাদের আন্তরিকতার কোনো ক্রটি নেই। জনবল সংকটের সমস্যার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার থাকে না। সেটা সরকার বিবেচনা করবেন।
জনবল ও পদ সৃষ্টির অভাবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এখনো চালু করা যায়নি জানিয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার। ৩০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এখানে জরুরি বিভাগ চালুর জন্য যে মঞ্জুরিকৃত পদ সৃষ্টি করা হয় সেটিও এখনো হয়নি। যার কারণে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সব ধরনের রোগীদের আমরা ভর্তি করতে পারি না। এছাড়া চিকিৎসক ৫৮ জনের স্থলে রয়েছে ১৭ জন। চিকিৎসক স্বল্পতার কারণেও চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হিমশিম খেতে হয়।
তিনি আরও বলেন, স্বল্পতা থাকলেও আমাদের যেটুকু রয়েছে সেটুকু দিয়েই সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। এখানে ডেলিভারি, সার্জারিসহ অন্যান্য ছোট খাটো অপারেশন হচ্ছে। বর্তমানে ১০০-১৫০ রোগী নিয়মিত ভর্তি থাকে। পরবর্তী সময়ে জরুরি বিভাগ চালু হলে রোগীর সংখ্যা ২৫০ ছাড়িয়ে যাবে। চিকিৎসা সেবা প্রদানে চিকিৎসকদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি থাকে না। তবে ক্রটি বিচ্যুতি যেটুকু হয় সেটুকু চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে।
সমস্যা নিরসনে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নে ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, একাধিকবার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যেই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জানান, সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নতমানের চিকিৎসা সেবার যন্ত্রপাতি থাকলেও দক্ষ জনবলের অভাবে সেগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউ এর সকল যন্ত্রপাতি পড়ে রয়েছে। এছাড়া জরুরি বিভাগ চালু না হওয়ায় কলোনোসকপি মেশিন, এনডোসকপি মেশিন পড়ে রয়েছে।
তিনি জানান, টেকনেশিয়ান না থাকায় পড়ে রয়েছে ইটিটি মেশিন, ইকো মেশিন, মেমোগ্রাফি মেশিন। এছাড়া পড়ে রয়েছে কার্ডিয়াক মনিটর, ভেন্টিলেটর মেশিন, ইসিজি মেশিন, কার্ডিয়াক বেড। আইসিইউতে পড়ে রয়েছে ভেন্টিলেটর মেশিন ও ডিফিবিলেটর মেশিন। এসব যন্ত্রপাতির মূল্য কয়েক কোটি টাকা।