কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কড়াল গ্রাসে, তবুও বেড়েছে ভারতীয় অতি-ধনীদের সম্পদ
অর্থনীতির এক ধস প্রত্যক্ষ করছে প্রতিবেশী ভারত। নতুন কিছু গবেষণার আলোকে জানা যাচ্ছে, কোভিডের কারণে কোটি কোটি মানুষের নতুন করে দরিদ্র হওয়ার ঘটনা।
মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দরিদ্ররা হয়েছেন অতি-দরিদ্র, সঙ্গতির অবনতি হয়েছে অনেক মধ্যবিত্তের। এসব ভারতীয়রা যখন দৈনিক আয়ে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি নিয়ে জীবনধারণের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনই সমাজের একেবারে উপরের তলার ধনীরা আরও বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন।
গেল বছর এসব অতি-ধনীদের সম্মিলিত সম্পদের স্ফীতি হাজার হাজার কোটি ডলার বেড়েছে।
যেমন ধরুন মুকেশ আম্বানির কথাই- নানা রকমের শিল্পে বিনিয়োগ থাকা রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের এই মালিকের মোট সম্পদ এখন ৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুসারে, এক বছর আগের তুলনায় তার বিত্ত বেড়েছে দেড় হাজার কোটি ডলারের বিস্ময়কর গতিতে। মুকেশই এখন এশিয়ার সেরা ধনী।
সম্পদ অর্জনের গতিতে আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি সামান্যই পিছিয়ে আছেন। গত বছরের জুলাইয়ে তার সম্পদ মাত্র ১৩ বিলিয়ন ডলার থাকলেও, তা গত ৬ জুলাইয়ে উন্নীত হয় ৫৫ বিলিয়নে। এশীয় সেরা ধনীদের কাতারে গৌতমের অবস্থান চতুর্থ।
এ দুজনের সম্পদ এশিয়ার কিছু কিছু দেশের মোট জিডিপির চাইতেও বেশি। স্বজাতি ও সাধারণ ভারতীয়দের সাথে তাদের সম্পদ বেড়ে চলার বিপরীতমুখী গতি আয় বৈষম্যের প্রতীক; বিশ্বব্যাপী যা রূপ নিয়েছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতায়। তবে এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতিতে অতি-ধনীদের সম্পদ স্ফীতিটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে, তার কারণ অবশ্যই সাধারণ মানুষের দুর্দশা। ২০২০ সালে মহামারির অভিঘাতে বিশ্বব্যাপী যত মানুষ দরিদ্র হয়েছেন, তার অর্ধেকের বেশি হয়েছে ভারতে।
এশীয় ধনীদের শীর্ষে:
চীনা ধনকুবেরদের পেছনে ফেলে চলমান মহামারির অধিকাংশ সময়জুড়ে এশিয়ার সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তির অবস্থান ধরে রাখেন মুকেশ আম্বানি। চলতি বছরের তার এ আসন খুব বেশি সময় রদবদল হয়নি; একইসঙ্গে, তিনি বিশ্বের ১২তম শীর্ষ ধনী। তার বিত্ত মেক্সিকোর মোঘল কার্লোস স্লিম হেলু ও ডেল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল ডেলের চাইতেও বেশি।
২০২০ সাল ছিল মুকেশের রিলায়েন্স শিল্পজোটের জন্য খুবই পয়মন্ত; এসময় সিলিকন ভ্যালির তথ্যপ্রযুক্তি জায়ান্ট গুগল ও ফেসবুক থেকে শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ আসে। ভারতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি বাজারে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য থেকে মুকেশকে সহযোগী হিসেব বেছে নেয় তারা।
অন্যদিকে, আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা- বন্দর পরিচালনা, তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র, এরোস্পেসসহ অনেক শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন। রিলায়েন্সের মতো আদানি গ্রুপও ভারতীয় পুঁজিবাজারে অত্যন্ত ভালো পারফর্ম করেছে।
২০২০ সালের জুন পরবর্তী সময়ে আদানি গ্রুপের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারমূল্য ৮০০ শতাংশ বাড়ে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটের শিল্পপতি গৌতম আদানি। মোদির জাতীয় উন্নয়নের প্রকল্পগুলোয় অংশগ্রহণে আদানির প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাড়তি সুবিধা পাবে- বিনিয়োগকারীদের সেই আস্থাকে প্রকাশ করেছে এমন দরস্ফীতি।
অবশ্য মুকেশ আম্বানিও গুজরাটের।
গত মাসে দেশটির জাতীয় একটি দৈনিক ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে, আদানির কোম্পানিগুলোতে করা তিনটি বিদেশি তহবিলের বিনিয়োগ কেন্দ্রীয় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা জব্দ করেছে জানানো হয়। তারপর কোম্পানিগুলোর শেয়ারমূল্য অনেকটাই কমে যায়।
তবে এ সংবাদকে 'প্রচণ্ড ভুলে ভরা' উল্লেখ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানান আদানি। কিন্তু, ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই যায়, মাত্র এক মাসের মধ্যেই ২০ বিলিয়ন ডলার হারান তিনি।
এই লোকসানের পরও চীনা ধনকুবের ও টেনসেট সিইও পনি মা'র পেছনেই এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের কাতারে রয়েছেন গৌতম আদানি।
আদানি ও আম্বানির সঙ্গে টক্কর দিতে পারার সক্ষমতা জ্যাক মা'র মতো যেসব চীনা ধনকুবেরের ছিল- তারা সম্প্রতি চীনা সরকারের রোষানলে পুঁজিবাজারে বিপুল সম্পদমূল্য হারান।
এ বাস্তবতায়, আদানি ও আম্বানির রাজত্ব বিস্ময়কর ঘটনা নয়- বলেই জানান মার্কেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্সের প্রতিষ্ঠাতা সৌরভ মুখার্জি। তিনি বলেন, ভারতীয় অর্থনীতির প্রধান প্রায় সব কয়টি খাতেই এই দুই শক্তিশালী কর্পোরেট হাউজের যেকোনো একটি নিয়ন্ত্রণ করছে, কিছু খাতে রয়েছে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা।
তিনি সিএনএন বিজনেস'কে বলেন, "ভারত আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যেখানে ব্যবসাবাণিজ্য খাতের ৯০ শতাংশ আয় করছে শীর্ষ ১৫টি প্রতিষ্ঠান।"
ভারতের সাধারণ মানুষ কেমন আছে?
একদিনে ছয়শ কোটি ডলার হারানোর মতো রেকর্ড লোকসানকে আদানি অগ্রাহ্য করেতে পারলেও তার নিজ দেশে চলছে এক চরম অর্থনৈতিক অরাজকতা। মহামারির তাণ্ডবে বন্ধ হয়েছে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ২০২০ সালে ভারত সরকার যখন কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে; তারমধ্যে শীর্ষ ১ শতাংশ উচ্চবিত্ত জনসংখ্যার আয় সাড়ে ৪০ শতাংশ বাড়ে। ২০০০ সালের তুলনায় এটি ৭ শতাংশ পয়েন্ট বেশি বলে গত জুনে প্রকাশিত ক্রেডিট সুইসের বৈশ্বিক সম্পদ প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এছাড়া, অর্থনৈতিক বৈষম্য পরিমাপের সূচক জিনি কো-ইফিসিয়েন্ট অনুসারে গত বছর ভারতের আয় বৈষম্য ছিল ৮২.৩ পয়েন্ট, ২০০০ সালে যা ছিল ৭৪.৭ পয়েন্ট। জিনি সূচকে স্কোর বৃদ্ধি মানে উচ্চ মাত্রায় আয় বৈষম্য। অর্থাৎ, কোন দেশে যত বেশি স্কোর হবে, সেখানে আয় বৈষম্য সবচেয়ে বেশি। এ সূচকে শূন্যের অর্থ আয় সমতা। আর ১০০ স্কোরের অর্থ ওই দেশ বা অঞ্চলে মাত্র একজন ব্যক্তিই সব আয় করছে।
তার ওপর আবার জাতীয় লকডাউনের প্রভাবে গত বছর ভারত বিরল এক মন্দার মুখ দেখে; যা চার মাস স্থায়ী হয়। চলতি বছর অর্থনীতির আংশিক পুনরুদ্ধার হলেও সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার পর গত মে নাগাদ রেকর্ড মাত্রায় পৌঁছে যায় বেকারত্বের হার।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, অর্থনীতির মন্থর গতির প্রভাবে গত বছর ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত মানুষের সংখ্যা তিন কোটি ২০ লাখ কমেছে। দৈনিক মাত্র দুই ডলার বা তার চেয়ে কম আয়কারী দরিদ্র বেড়েছে সাড়ে ৭ কোটি ।
পিউ এর গবেষক রাকেশ খোঁচার গত মার্চে তার এক পোস্টে লেখেন, বিশ্বজুড়ে মহামারির কারণে যত মানুষ দরিদ্র হয়েছেন তার প্রায় ৬০ শতাংশ ছিলেন ভারতীয় নাগরিক। তবে এ হিসাবে মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গে যারা দরিদ্র হয়েছেন তাদের সংখ্যা যোগ হয়নি।
সেই তুলনায়, চীনে জীবনযাত্রার মান বেশ উন্নত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আয় হারানো অনেক পরিবার গত বছর থেকেই তাদের স্থায়ী সম্পদ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে, অনেক পরিবার কমিয়েছে খাদ্যের পেছনে অর্থ ব্যয়। অভাবগ্রস্ত মানুষ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও স্থানীয় মহাজনদের থেকে ঋণ করে চলছেন। ভারতের কর্নাটক রাজ্যের আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এসব তথ্য জানানো হয়।
গবেষকদের মতে, মহামারির কারণে ভারতে ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন। তারা বলেন, "আমাদের জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯০ শতাংশ ব্যক্তি লকডাউনের সময় অর্থ সংকটে কম খাওয়ার কথা বলেছেন। এই সংখ্যা সত্যিই আশঙ্কাজনক। তার চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয়, ২০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, লকডাউনের ছয় মাস পরও তাদের খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ বাড়েনি। মহামারি চলাকালে যা পুষ্টি স্বল্পতার দিকটি তুলে ধরছে।"
- সূত্র: সিএনএন