কবুতরের পাখায় আফ্রিকার খনি থেকে হীরা চুরির ভয়াল কাহিনী
দক্ষিণ আফ্রিকা। আটলান্টিক উপকূলের একটি ধূলিধূসর খনি শহরের উপকণ্ঠ। লালচে ধুলোর মধ্যে বসে আছে ১৩ বছর বয়সী এমসিজি। কোলে একটা কবুতর—নাম বার্থোলোমিউ।
এমসিজি, ডি বিয়ার্স কোম্পানির হীরার খনিতে কাজ করে। কবুতরটিকে সে ব্যবহার করে অবৈধ রত্নপাথর পাচার করার জন্য।
ছেলেটির কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে আসছে। হিরের কণামিশ্রিত ধুলো ফুসফুসে ঢুকছে বলে রক্তের সঙ্গে কাশি উঠে আসা। যতদিন বাঁচবে, ছেলেটিকে নিশ্বাসের এই সমস্যা নিয়েই বাঁচতে হবে।
আশি বছর ধরে নামিবিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা সীমান্তের এই শহরটির মালিক ডি বিয়ার্স কোম্পানি। বহিরাগতদের এখানে প্রবেশ নিষেধ।
শহরটির স্বর্ণযুগে ডাই স্পারগেবিট-এর (নিষিদ্ধ এলাকা) সবাই ডি বিয়ার্সের জন্য কাজ করত। শহরের কোনো বাসিন্দার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না।
নানা ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে শহরের বাসিন্দাদের মনোরঞ্জন করত ডি বিয়ার্স। সুসজ্জিত, খাবার-দাবারে পরিপূর্ণ বাড়ি দেওয়া হতো তাদের। কোম্পানিটি বাচ্চাদের জন্য স্কুল বানিয়ে দিয়েছিল। অবসর কাটানোর জন্য তৈরি করেছিল নানা ধরনের ক্লাব।
স্যাটেলাইট ইমেজে নিষিদ্ধ এলাকার ছবি ঝাপসা করে দেবার জন্য স্যাটেলাইট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গোপন চুক্তিও ছিল ডি বিয়ার্সের।
২০০৭ সালে ডি বিয়ার্সের মনে হয়, এ অঞ্চলের কিছু অংশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ হীরা উত্তোলিত হয়ে গেছে। কাজেই শহরটির দরজা প্রথমবারের মতো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হতে থাকে।
যদিও এলাকাটির বেশিরভাগই এখনও ডি বিয়ার্সের দখলেই আছে, তবু সীমিত পরিসরে এখন শহরটিতে ঢোকা যায়।
এমসিজির গল্পটা করুণ। নেহাত ঠেকায় পড়ে সে হীরা পাচারের কাজে নেমেছে। ধরা পড়লে শাস্তি হবে ভয়াবহ। কখনও কখনও অনেকে গুম হয়ে যায়, শিশু হলেও নিস্তার নেই।
কোনো খনিশ্রমিক যদি কর্মস্থলে মারা যায়, তার লাশ মাটির নিচেই সমাধিস্থ করা হয়। কাজটা করা হয় অন্য শ্রমিকরা যাতে লাশটা ব্যবহার করে হীরা পাচার করতে না পারে সেজন্য।
এমসিজির বগলের নিচে ক্ষত। দড়ির দাগ। প্রতিদিন দড়ি বেঁধে খনির গভীরে নামানো হয় ওকে। সেই দড়ির দাগ স্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে ওর বগলের তলায়। খনির তলদেশ খুঁড়ে ধুলিবালিসহ সেই ঝুরঝুরে মাটি বস্তায় ভরে সে। ওসব বস্তা ওপরে তুলে মাটি ছেঁকে হীরা আলাদা করা হয়।
কখনও কখনও বেশ ভালো পরিমাণ হীরা পাওয়া যায়, কোনো কোনো দিন আবার কিছুই পাওয়া যায় না।
যেদিন বেশি হীরা পায়, সেদিনই বার্থোলোমিউকে কাজে লাগায় এমসিজি। আশপাশে যখন কেউ থাকে না, সেই ফাঁকে পাথর চালান করে দেয় সে।
কিছু শ্রমিক কাপড়ের ভেতর লুকিয়ে কবুতর নিয়ে যায়। এমসিজি অবশ্য বার্থোলোমিউকে খনিতে নিয়ে যায় লাঞ্চবক্সে ভরে। খনিতে ঢোকানোর সময় এক্স-রে মেশিন দিয়ে সবাইকে স্ক্যান করা হয়। তবে শ্রমিকদের ওপর বেশি রেডিয়েশনের ব্যবহার দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষিদ্ধ। সেজন্য এক্স-রে মেশিনে তেমন কিছু ধরা পড়ে না।
ধরা পড়ার ঝুঁকি কমাতে কোনো রত্ন পাচারকারী ধরা পড়লে পরের কয়েকটা দিন কবুতর নিয়ে আসে না এমসিজি। সে সময় নিরাপত্তারক্ষীরা স্বভাবতই একটু বেশি সতর্ক থাকে।
এ সময় ধরা পড়লে তারা বার্থোলোমিউকে মেরে ফেলবে। হয় ঘাড় মুচড়ে দেবে, নয়তো মাথায় বলপয়েন্টের খোঁচায় ফুটো করে দেবে, অথবা কামড়ে মাথা ছিঁড়ে নেবে।
মাঝে মাঝে শাস্তিতে একটু বৈচিত্র্যও আসে। তখন ধরা পড়া শ্রমিকের আঙুল ভেঙে ফেলে, নইলে কেটে ফেলে।
স্রেফ সন্দেহের বশে এমসিজির বাঁ হাতের কড়ে আঙুল কেটে নিয়েছে এক প্রহরী।
এক্স-রে মেশিনের বাঁধা পেরোনোর পর এমসিজি কবুতরটাকে জামার ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। কাজ করার সময় সে এক ফাঁকে টুক করে জিহবার নিচে হীরা লুকিয়ে রাখে। আশপাশের শ্রমিকরা সেটা দেখে ফেললেও না দেখার ভান করে।
এমসিজি চুরির হিরেগুলো চারটে থলেতে পুরে দুটো থলে বেঁধে দেয় বার্থোলোমিউর দুই পায়ের সঙ্গে। বাকি দুটো থলে বাঁধে দুই ডানার নিচে।
তারপর কোনো খাদে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয় বার্থোলোমিউকে। পাখিটা এমসিজির কুঁড়েতে উড়ে যায়। সেখানে ওর মা হিরেগুলো উদ্ধার করে।
পরে ওই চোরাই হিরে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে। কমিশন হিসেবে সামান্য কিছু টাকা পায় এমসিজি।
অনেক চোরাই কারবারি হিরের বিনিময়ে ড্রাগ চায়। বিশেষ করে 'টিক', অর্থাৎ ক্রিস্টাল মেথের চাহিদা বেশি।
শ্রমিকরা যে হীরা চুরির জন্য পোষা কবুতর ব্যবহার করে, তা জানেন ডি বিয়ার্সের কর্মকর্তারা। অবশ্য কোম্পানির প্রহরীদের কাছে সব শ্রমিকই সম্ভাব্য চোর। তাদের বিশ্বাস, অত্র অঞ্চলের সব কবুতরই হীরা চুরিতে ব্যবহার হয়।
মাইনিং কোম্পানিগুলোর চাপে সরকার এসব খনি শহরে কবুতর পালা অবৈধ ঘোষণা করে আইন পাস করেছে। একটি জেলায় তো কবুতর দেখার সঙ্গে সঙ্গে গুলি না করাটাই অবৈধ কাজ।
অনেক সময়ই এক্স-রেতে ধরা পড়ে, কিংবা উড়ন্ত অবস্থায় গুলি খেয়ে বহু কবুতর মারা পড়ে। সেজন্য শ্রমিকরা একটা কবুতরের গায়ে যত বেশি সম্ভব হিরে বেঁধে দেয়।
এর ফলে দেখা দেয় আরেক বিপত্তি। পাখার সঙ্গে বাঁধা ভারী থলে নিয়ে কবুতরগুলো ঠিকমতো উড়তে পারে না। হিরের ভারে ক্লান্ত-শ্রান্ত পাখিগুলো প্রায়ই ডায়মন্ড কোস্টের সৈকতগুলোতে পড়ে যায়। তখন কবুতরগুলোর গা থেকে হীরা খুলে নেওয়ার জন্য হামলে পড়ে স্থানীয় বাসিন্দারা।
সৈকতে হিরে বাঁধা পাখি পড়ার খবর খনি অঞ্চলে চাপা থাকে না। খবরটা চাউর হওয়ার পর অন্তত একজন শ্রমিক এক আঙুল হারায়। শাস্তির মাত্রা এর চেয়ে ভয়াবহও হতে পারে—চোখ উপড়ে নেয়া; অথবা হাত, কান, পা বা মাথাও কেটে নিতে পারে। শাস্তিটা অনেক সময় আসল অপরাধী পায় না, অনেক সময় ভুল সন্দেহের শিকার হয়ে নিরীহ কোনো শ্রমিকও পায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার খনি শ্রমিকদের বড় একটি অংশই শিশু। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, হীরা খনিতে কাজ করা ৪৬ শতাংশ শ্রমিকের বয়স পাঁচ থেকে ষোলোর মধ্যে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় হীরার কারবার ঘিরে ব্যাপক দুর্নীতি চলে। একবার পোর্ট নোলথ নামে এক শহরের সমস্ত সরকারি কর্মকর্তা হীরা চোরাচালানের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিল। শহরটির মেয়রের বিছানার নিচে, জুতোর বাক্সের মধ্যে গোলাবারুদের সঙ্গে প্রচুর হীরা পাওয়া যায়।
কবুতর ব্যবহার ছাড়াও আরও অনেক কায়দায় খনি থেকে হীরা চুরি হয়। যেমন, অনেকে তামাকের থলেতে হীরা ভরে চর্বি মাখানো মোমের সাহায্যে থলেটা পায়ুপথে ভরে নেয়। একবার এক মহিলা চশমার সকেটে হীরা লুকিয়ে নেওয়ার সময় ধরা পড়ে।
কেউ কেউ আবার বাহু চিরে ক্ষতের মধ্যে হীরা লুকিয়ে রাখে। এইচআইভি সংক্রমণের ভয়ে তখন আহত শ্রমিককে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ডাক্তার বা নার্স—যার সঙ্গে শ্রমিকের আগে থেকেই আঁতাত করা থাকে—ক্ষতস্থান থেকে হীরা বের করে দেয়। অথবা হীরাটা পরে বের করার জন্য ক্ষতে সেলাই করে দেয়।
অনেক চোরাকারবারির দল আবার সরু সুড়ঙ্গ খুঁড়ে শিশুদের নামিয়ে দেয় খনিতে। ধুলো-কাদায় ভর্তি সুড়ঙ্গে হীরা খুঁজতে খুঁজতে দমবন্ধ হয়ে আসে তাদের। তখন ওপরে উঠে এসে তাজা দম নিয়ে ফের কাজে ফিরে যায় তারা। সুড়ঙ্গগুলোর অবস্থা এত শোচনীয় যে, বেশিরভাগ বাচ্চাকেই মেথ দেওয়া হয়।
হীরা চোরদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কোম্পানিগুলোর পোষা 'জল্লাদ' থাকে। এই জল্লাদেরা শ্রমিকদের শাস্তি দিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পায়।
অবশ্য ডি বিয়ার্সসহ অন্যান্য হীরা কোম্পানির দাবি, চুরি ঠেকানোর জন্য মাঝেমধ্যে শ্রমিকদের গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হলেও, তাদের বিরুদ্ধে আনা বেশিরভাগ নিষ্ঠুরতার অভিযোগ মিথ্যে।
- সূত্র: ডেইলি মেইল