করোনা পরিস্থিতিতে ট্যুরিস্ট গাইডেরা এখন দিনমজুর
একদিন এই পাহাড়ে, অন্যদিন আরেক পাহাড়ে। এভাবে পর্যটক দল নিয়ে ব্যাগ কাঁধে পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে পথ দেখিয়ে চলেন তারা। কখনো চলে পায়ে হেঁটে এক ঝিরি-ঝর্ণা থেকে আরেক জলপ্রপাতে ঘুরে বেড়ানো। এরপর পর্যটকদের রাতযাপন থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত পর্যন্ত যারা করে দেন সেই ট্যুরিস্ট গাইডরা এখন দিনমজুর হয়ে পড়েছেন।
বান্দরবানের কয়েকজন ট্যুরিস্ট গাইড দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় চলমান লকডাউনে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় সংকটে পড়েছেন তারা। কয়েক শত পর্যটক গাইড এখন আর্থিকভাবে চরম সংকটে দিন পার করছে। কেউ ফিরেছে জুম চাষের জীবনে। কেউ করছে অন্যের বাগানে দিনমজুরি।
ট্যুরিস্ট গাইডরা জানান, এক সময় বেড়াতে আসা পর্যটকদের আঁকাবাঁকা পথ ও বনজঙ্গলের রাস্তা দেখিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তারা। দূরত্বভেদে এসব ট্যুর থেকে পেয়ে থাকেন পারিশ্রমিক। এই আয়ের টাকায় চলেছে তাদের সংসার এবং পরিবার। কিন্তু লকডাউনে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় সে আয়ের পথ একেবারেই বন্ধ।
শহরে আশপাশে বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াতে পারেন যে কেউ। তবে থানচি, রুমা এবং আলীকদম উপজেলার জনপ্রিয় পর্যটন স্পটের অবস্থানগুলো মোবাইল নেটওর্য়াক বিহীন দুর্গম এলাকায়। যার কারণে পর্যটকরা এখানে বেড়াতে আসলে গাইড নিয়ে যাওয়ার প্রশাসনিক নিয়ম রয়েছে।
এতে করে কয়েক বছর ধরে পর্যটকদের বিভিন্ন কাজে সহযোগী হিসেবে পর্যটক গাইড কাজে যুক্ত হয়েছেন কয়েকশ স্থানীয় যুবক। কিন্তু দুই বছর ধরে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় তারাও পড়েছেন সংকটে।
পর্যটক গাইডদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রুমা, থানচি, এবং আলীকদম তিন উপজেলার পর্যটক গাইডরা আমের পুরো মৌসুমজুড়ে অন্যের বাগানে শ্রমিক হিসেবে আম পাড়ার কাজে যুক্ত ছিলেন। সে আমের মৌসুম এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে। এর বাইরে কাজ পেলে করতেন দিনমজুর হিসেবে।
থানচি উপজেলার পর্যটক গাইড শিমিয়ন ত্রিপুরা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গতবছর মাঝে সীমিত পরিসরে পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়ায় কিছু আয় হয়েছে। বর্তমানে সেটাও নেই। যেটুকু জমানো টাকা ছিল তা দিয়ে কোনো রকম চলছি। কিছু কলা বাগান থাকলেও লকডাউনের কারণে তা বিক্রি করা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড কষ্টে দিন কাটাচ্ছি"।
থানচির আরেক ট্যুরিস্ট গাইড চহ্লামং মারমা বলেন, "ঘরে বসে না থেকে ছোটখাট কিছু ফলদ ও বাণিজ্যিক বাগান করেছি। সেগুলো দেখভাল করছি। করোনা পরিস্থিতি কখন কি হয় ঠিক নাই। যারা ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করতেন এখন পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ থাকায় সবাই যে যার মত কিছু একটা করে টিকে থাকার চেষ্টা করছে"।
এদিকে থানচির ট্যুরিস্ট গাইড সমিতির সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ জানিয়েছেন, তিনি নিজেও আমের মৌসুমে আম পাড়ার কাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। সাঙ্গু নদীতে ট্রলারের সহকারী হিসেবেও কাজ করেন তিনি। লকডাউনের কারণে নদী পথেও লোকজনের চলাচল কম হওয়ায় ভাড়া বেশি উঠে না।
থানচির ট্যুরিস্ট গাইড সমিতির সভাপতি ইমন ত্রিপুরা জানান, কিছু ট্যুরিস্ট গাইড পাহাড়ি এলাকা হিসেবে জুম চাষের কাজে ফিরেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্র খোলা থাকা অবস্থায় উপজেলা সদরে এসে থাকতেন তারা। এখন যার যার গ্রামে চলে গেছে সবাই।
তবে বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট গাইড বাগান ও ক্ষেতখামারে দিনমজুর হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক সঙ্কোচের কারণে তারা কিছু বলতে চান না। থানচি উপজেলায় মোট ১৭৫ জন ট্যুরিস্ট গাইড রয়েছে। তার মধ্যে উপজেলা প্রশাসনে নিবন্ধিত ১২৫ জন। বাকী ৫০ জন নিবন্ধন পেতে আবেদনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে বলে জানান তিনি।
রুমা উপজেলার ট্যুরিস্ট গাইডরা জানান, তারাও একই পরিস্থিতিতে রয়েছেন। বেশিরভাগ পর্যটক গাইড দিনমজুরের কাজ করছেন। যে যার মত করে অন্যের বাগানে এবং ক্ষেতখামারে কাজ করছেন।
লাল লম বম নামে এক ট্যুরিস্ট গাইড জানান, তিনি গাইডের কাজ না পেয়ে গত বছর থেকে দিন মজুরের কাজ করছেন। যেখানে সুযোগ হয় সেখানেই কাজ করা হয়। বাকী ট্যুরিস্ট গাইডরাও বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
"পর্যটন মৌসুমে দূরত্বভেদে এক ট্যুরে গেলে দুই থেকে তিন হাজার টাকা পেয়ে থাকি। মাস শেষে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা হাতে থাকত। করোনা পরিস্থিতি একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে। করোনার অবস্থা ভাল না হলে আমাদের কী হবে চিন্তায় আছি।''
রুমা উপজেলা ট্যুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পারনুয়াম বম জানান, এ উপজেলায় মোট ৭০ জন ট্যুরিস্ট গাইড রয়েছে। লকডাউনে ৬০ জনের ট্যুরিস্ট গাইডের অবস্থাই করুণ। হাতে যখন যা কাজ পাই তা করেই দিন পার করছে সবাই।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দেখে সরকার পর্যটন কেন্দ্র খুলে দেওয়ার পরই যার যার স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারবে।