ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ৩৪ কিলোমিটার ‘মহাবিপজ্জনক’
সিলেট বিভাগের সঙ্গে সড়কপথে সারাদেশের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক। প্রতিদিন এই মহাসড়ক দিয়ে কয়েক হাজার যানবাহন চলাচল করে। গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কের ৩৪ কিলোমিটার অংশ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আর এই ৩৪ কিলোমিটার অংশ দিন দিন ‘মহাবিপজ্জনক’ হয়ে উঠে যাত্রীদের কাছে রূপ নিচ্ছে আতঙ্কে। প্রতিবছরই এই সড়কে ঝরছে অনেক প্রাণ। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছেন অনেকেই।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৪ কিলোমিটার অংশে ৫৩টি দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ৩১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৩২ জন ও আহত হয়েছেন ৪৬ জন। ২০১৯ সালে ৫৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪৭ জনও আহত হয়েছেন অন্তত ৬৭ জন।
মূলত চালকদের অদক্ষতা, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও মহাসড়ক লাগোয়া অবৈধ স্থাপনা এবং তিন চাকার যানের অবাধ বিচরণের কারণেই রোধ করা যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। এর ফলে মহাসড়কে থামছেনা লাশের মিছিল। তাই কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে মহাসড়কটিকে নিরাপদ করে তোলার দাবি জানিয়েছেন যাত্রীরা।
জানা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৪ কিলোমিটার অংশ পড়েছে আশুগঞ্জ, সরাইল ও বিজয়নগর উপজেলায়। ওই তিন উপজেলার অংশে ঝুঁকিপুর্ণ বাঁক রয়েছে ৮ থেকে ১০টি। এর মধ্যে আশুগঞ্জ গোলচত্বর, শাহবাজপুর তিতাস সেতু সংলগ্ন বাঁক, ভৈশামোড়া, রামপুরা, চান্দুরা, বীরপাশা ও ক্ষেতাবাড়ি এলাকার বাঁকগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
এই বাঁকগুলো অতিক্রম করার সময় সড়ক বিভাগ থেকে যানবাহন চালকদের জন্য গতিসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও সেটি মানছেন না চালকরা। ফলে প্রায়ই বাঁকগুলো অতিক্রম করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়াও মহাসড়ক লাগোয়া অবৈধ স্থাপনা এবং তিন চাকার যানবাহনের অবাধ চলাচলের কারণে কমানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনার হার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৩৬ কিলোমিটার অংশের কয়েকটি স্থানে অন্তত দুই শতাধিক অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। যদিও মহাসড়কের ৩০ মিটার এলাকায় কোনো স্থাপনা থাকার নিয়ম নেই বলে জানিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক দিয়ে নিয়মিত যাতায়াতকারী কয়েকজন যাত্রী জানান, নির্দিষ্ট গতিসীমা থাকলেও বড় গাড়িগুলো সেই সীমা লঙ্ঘন করে কে কার আগে যাবে সেই প্রতিযোগিতায় নামে। অধিকাংশ চালকদের অদক্ষতার কারণে বাঁকগুলো অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়।
সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া এলাকার বাসিন্দা শফিকুর রহমান বলেন, ‘‘ঢাকা-সিলেট রুটে চলাচলকারী বাসগুলো রীতিমতো গতির প্রতিযোগিতায় নামে। তা করতে গিয়ে ওভারটেকিং করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেক বাস খাদে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে। গতির এই প্রতিযোগিতা বন্ধ হলে দুর্ঘটনাও কমে আসবে।’’
সরাইল উপজেলার শাহবাজপুর এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, শাহবাজপুর এলাকার তিতাস সেতু সংলগ্ন বাঁক এবং ভৈশামোড়া এলাকার বাঁকটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাঁকগুলোর পাশেই বিল রয়েছে। ‘‘ওই বাঁক দুটি অতিক্রম করতে গিয়ে অনেক সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পানিতে পড়ে যায়। দুর্ঘটনা এড়াতে চালকদের এই বাঁকগুলো আরও সতর্কতার সঙ্গে অতিক্রম করা প্রয়োজন।’’
বিজয়নগর উপজেলার ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা জিয়াদুল হক বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের বীরপাশা এলাকার বাঁকটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। দ্রুত গতিতে ধেয়ে আসা গাড়িগুলো বাঁক অতিক্রম করার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গতবছরও ওই বাঁক অতিক্রম করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে একটি বরযাত্রীবাহী মাইক্রোবাসের পাঁচ যাত্রী নিহত হন।
নিরাপদ সড়ক চাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কমিটির সভাপতি সাদেকুল ইসলাম বলেন, বড় বড় বাঁকগুলো দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দুর্ঘটনার হার কমানোর জন্য বাঁকগুলো সরলীকরণ করতে আমরা সংশ্লিষ্টদের একাধিকবার বলেছি। পাশাপাশি ধীরগতির ছোট গাড়িগুলোর জন্য মহাসড়কে পৃথক লেন তৈরি করার জন্যও সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। যাত্রীদের জন্য ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি নিরাপদ করতে এগুলোর বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও তিন চাকার যানবাহনগুলো দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে বলেন, ‘‘কোনো মালিকই অদক্ষ চালকের হাতে গাড়ি তুলে দেয় না। তারপরও চালকের অবেহলার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। তবে মূল কারণ হলো ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকের কারণে গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। বিশেষ করে তিন চাকার গাড়িগুলোর কারণে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। দুর্ঘটনা রোধ করার জন্য এগুলো আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’’
খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ মাঈনুল ইসলাম বলেন, চালকদের অসচেতনতা ও বাঁকগুলো দুর্ঘটনার একটি কারণ। চালকদের সচেতনতাই দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে পারে। আর তিন চাকার যানবানগুলোকে মহাসড়কে আমরা উঠতে দিচ্ছি না। সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য আমরা সর্বত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সেজন্য যানবাহন মালিক-চালকদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত আলোচনা করে যাচ্ছি। যে জায়গায় যে গতি বেঁধে দেওয়া আছে সেই গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য আমরা চালকদের পরামর্শ দিচ্ছি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম আল মামুন বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি চারলেনে উন্নীতকরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ শেষ হলেই কাজ শুরু হবে। তখন বাঁকগুলো সরলীকরণ করা হবে। আর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। আমাদের উচ্ছেদের পর আবার স্থাপনা তৈরি করা হয়। এখন যেগুলো আছে সেগুলোও উচ্ছেদ করা হবে।