আফগানিস্তান: তালেবানের বিস্ময়কর অগ্রগতির নেপথ্য কৌশল
আফগানিস্তানে তালেবানের অগ্রগতি বিস্ময় সৃষ্টি করেছে পুরো বিশ্বজুড়ে। প্রাদেশিক রাজধানীগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে একে একে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির এমন অগ্রগতিতে আফগান সরকার ক্ষমতায় থাকার প্রাণপণ লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
চলতি সপ্তাহে, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ফাঁস হওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই হয়ত কাবুল হামলার শিকার হতে পারে এবং আগামী ৯০ দিনের মধ্যে সরকারব্যবস্থাও ভেঙে পড়তে পারে।
গত ২০ বছরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে ও সুসজ্জিত করতে তাদের সর্বোচ্চটা দিয়েছে; সেই সঙ্গে ব্যয় করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।
অসংখ্য ব্রিটিশ এবং আমেরিকান জেনারেলরা দাবি করেছিলেন যে, তারা সাফল্যের সঙ্গে আফগান বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি করতে পেরেছেন। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠাচ্ছে তাদের দূতাবাস থেকে কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনতে।
পশ্চিমা ন্যাটো মিত্রদের করা দাবি এবং প্রতিশ্রুতিগুলো এখন ভুল প্রমাণিত হতে শুরু করেছে।
শক্তির উৎস:
কাগজেকলমে আফগান সরকারের সেনা, বিমান এবং পুলিশ বাহিনী মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ নিরাপত্তা বাহিনী সদস্য রয়েছে; যা প্রকৃতপক্ষে, দেশটির প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট কম।
এছাড়া আফগান পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দেশত্যাগ এবং দুর্নীতির ইতিহাসও রয়েছে। কিছু অসাধু কমান্ডার এমন বেতন দাবি করেন যার অস্তিত্ব নেই কোথাও।
আফগানিস্তানে নিযুক্ত বিশেষ মহাপরিদর্শক মার্কিন কংগ্রেসের সর্বশেষ প্রতিবেদনে, দেশটির দুর্নীতি নিয়ে উদ্বেগ এবং সেই সঙ্গে আফগান বাহিনীর কর্মদক্ষতার তথ্য নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, এমনকি আফগান সেনাবাহিনী নিজেও নিশ্চিত নয় যে, তাদের কতজন সৈন্য রয়েছে।
এছাড়া, তাদের মনোবল খুবই কম। প্রায়ই তাদেরকে এমন সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে বছরের পর বছর থাকতে হয়, যেখানে কোনো জনবসতি কিংবা পরিবারিক সংযোগ থাকে না। লড়াই না করেই দ্রুত যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে এগুলো তুলে ধরেন ওয়াটলিং।
অন্যদিকে, তালেবানের শক্তি পরিমাপ করা দুঃসাধ্য।
ওয়েস্ট পয়েন্ট ইউএস কমব্যাটিং টেররিজম সেন্টারের মতে, তালেবানের ৬০ হাজার সক্রিয় যোদ্ধা রয়েছে, যা দলটির মূল শক্তি। সেই সঙ্গে অন্যান্য মিলিশিয়া দল ও সমর্থক মিলিয়ে মোট সদস্য সংখ্যা ২ লাখের বেশি নয়।
একজন পশতুভাষী সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ড. মাইক মার্টিন, তালেবানকে কোনো একক গোষ্ঠী মনে করেন না; তিনি বিশ্বাস করেন, দলটির আরও অনেক সমর্থক রয়েছে দেশের ভিতরে।
তিনি বলেন, আফগান সরকারও অনেক সময় স্থানীয় তালেবান সমর্থক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের ইতিহাসেই দেখা যায়, কীভাবে পরিবার, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও প্রাণ বাঁচানোর জন্য দল পরিবর্তন করে তালেবানে যোগ দিয়েছেন।
অস্ত্রের উৎস:
অর্থ এবং অস্ত্র উভয় ক্ষেত্রেই আফগান সরকার পাশ্চাত্যের কাছ থেকে যথেষ্ট সুবিধা পেয়ে থাকে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দেশটি সৈন্যদের বেতন দেওয়া এবং সরঞ্জামাদি কেনার জন্য শত শত কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে। জুলাই,২০২১-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ৮৮ বিলিয়নের বেশি খরচ হয়েছে আফগানিস্তানের নিরাপত্তা খাতে।
কিন্তু, এত এত ব্যয়ের প্রত্যাশিত ফলাফল দিতে ব্যার্থ হচ্ছে আফগান বাহিনী। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে আফগান বিমান বাহিনীর সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখার কথা ছিলো, সেখানে তারা বারবারই ব্যার্থ হচ্ছে।
আর এই ব্যর্থতার মুখে দক্ষিণের প্রদেশ হেলমান্দের রাজধানী লস্করগাহের পর কান্দাহারের দখল করে নিয়েছে তালেবান বাহিনী। তারা বিমানের পাইলটদের লক্ষ্য করে ভূমি থেকে আক্রমণ চালাচ্ছে।
মাদক ব্যবসায় তালেবান বাহিনীর অর্থ যোগানের প্রধান উৎস হলেও, ধারণা করা হয় পার্শ্ববর্তী পাকিস্তান থেকেও তাদের অর্থের যোগান দেওয়া হতো।
এছাড়া, সম্প্রতিক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া হামভি, নাইট ভিশন সরঞ্জাম, মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারিসহ নানা ধরনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তালেবানরা।
সোভিয়েত আক্রমণের পর আফগানিস্তান এমনিতেই অস্ত্রশস্ত্রে ভরপুর ছিল এবং তালেবান গোষ্ঠী দেখিয়ে দিলো, বিচ্ছিন্ন একটি দলও কীভাবে শক্তিশালী একটি প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে।
উত্তর এবং পশ্চিমকে লক্ষ্যবিন্দু নির্ধারণ:
সব সময় বিছিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়া তালেবান বাহিনীর এইবারের কৌশলের দিকে তাকালে বোঝা যায়, এবার তারা বেশ সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে।
সাবেক ব্রিটিশ সেনা ব্রিগেডিয়ার বেন ব্যারি বলেন, তালেবানদের আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু এবার তাদের গতানুগতিক দক্ষিণাঞ্চল নয়, বরং উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল; যে অঞ্চলের অধিকাংশ প্রাদেশিক রাজধানী তারা দখল করে ফেলেছে।
তালেবানরা গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত অঞ্চল এবং চেকপয়েন্টগুলো দখল করে নিয়েছে, যা আফগান সরকারের নগদ আয়ের উৎসে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তারা সরকারি কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। এর মাধ্যমে গত বিশ বছরে দেশটিতে যা ইতিবাচকতা এসেছিল- তাও স্লান হতে শুরু করেছে।
১০ হাজার সদস্যের আফগান বিশেষ বাহিনী তালেবানের শক্তি ও কৌশলের কাছে বেশ নগণ্য বলেই মনে হচ্ছে। এছাড়া, তালেবানদের যুদ্ধ জয়ের প্রোপাগান্ডা আফগান বাহিনীর মনোবলকে আরও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। আর আফগান বাহিনীর এমন আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে পড়া তালেবান বাহিনীর মনোবলকে আরও বৃদ্ধি করছে।
তাহলে পরিণতি কী?
পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আফগান সরকারের বিপরীতে যাচ্ছে।
জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, যদিও পরিস্থিতি আফগান সামরিক বাহিনীর জন্য ক্রমবর্ধমানরূপে হতাশাজনক বলে মনে হচ্ছে, তবুও "রাজনীতির মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে"।
তিনি মনে করেন, যদি সরকার অঞ্চল ভিত্তিক নৃ-গোষ্ঠীয় বা উপজাতীয় নেতাদের সমর্থন জিততে পারে, তবে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে বা অনুকূলে চলে আসবে।
একই মন্তব্য মাইক মার্টিনও করেছেন। তিনি মাজার-ই-শরীফ শহরের সাবেক যুদ্ধবাজনেতা আব্দুল রশিদ দোস্তামের ফিরে আসার উদাহরণও দেন, যিনি সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে তার চুক্তি বাতিল করেছেন।
শিগগিরই গ্রীষ্মকালীন যুদ্ধের পর্ব শেষ হবে দেশটিতে। কারণ আফগানের পাহাড়ি বন্ধুর এলাকায় শীত মৌসুমে যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। এই সুযোগটি কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারে আফগান সরকার।
তবে বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে তা হলো, আফগানিস্তানে শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা আনতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর প্রচেষ্টা সেই সোভিয়েতের মতোই নিরর্থক হয়েছে।
- সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা