আফগানিস্তানকে নাড়িয়ে দেওয়া সাত দিন: যেভাবে একের পর এক শহর দখলে নিল তালেবান
গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রাদেশিক রাজধানী জারাঞ্জ দখলের ঘোষণা দেয় তালেবান। ইরান সীমান্তের নিকটবর্তী এই বাণিজ্য কেন্দ্রের পতনকে কেবলমাত্র সূচনা বলে আখ্যা দেয় তালেবান কর্তৃপক্ষ।
এক বিবৃতিতে তালেবানের একজন কমান্ডার বলেন, "এটা কেবল শুরু। দেখতে থাকুন, অন্যান্য প্রদেশও দ্রুত আমাদের হাতে চলে আসবে।"
৬ আগস্ট নিমরোজ প্রদেশের রাজধানী জারাঞ্জের দখল নেওয়ার মধ্য দিয়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের প্রধান কোনো শহর এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে আসে।
মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে জারাঞ্জ কমান্ডারের বক্তব্যই সত্য বলে মনে হবে। বিদ্যুৎগতিতে আফগান সরকারকে সরিয়ে একের পর এক শহর দখল করে চলেছে তালেবান যোদ্ধারা।
জারাঞ্জের কৌশল অবলম্বন করেই অন্যান্য শহর দখল করা হচ্ছে। কৌশল অনুযায়ী, প্রথমে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো দখলে নিয়ে জারাঞ্জকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা হয়। এরপর হুট করেই মূল শহরে আক্রমণ চালিয়ে নেওয়া হয় নিয়ন্ত্রণ। ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাঙতে সক্ষম হয় তালেবান।
একই কৌশলে এক সপ্তাহের মধ্যে বাকি শহরগুলোর পতন ঘটে। রোববার উত্তরের বিমানঘাঁটি বিশিষ্ট প্রধান শহর কুন্দুজ এবং এর কয়েকদিনের মধ্যে পুল-ই-খুমরি ও গজনীর পতন ঘটে। রাজধানী কাবুল ঘিরে ফেলার কৌশল হিসেবেই শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান।
বৃহস্পতিবার দেশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহার ও হেরাত দখলের মধ্য দিয়ে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক সবথেকে বড় বিপর্যয়টি ঘটে। আফগান সেনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান বি-৫২ বোম্বার বিমান বাহিনী মিলেও তালেবানের অগ্রসর হওয়ার গতি কমাতে পারেনি।
শুক্রবার পর্যন্ত উঠে আসা তালেবানের দখলকৃত অঞ্চলের চিত্র আফগান সরকার এবং তাদের পশ্চিমা মিত্র শক্তির জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের ৬৫ ভাগের বেশি অঞ্চল এখন তালেবানের দখলে। এক ডজনের বেশি প্রাদেশিক রাজধানীর পতন ঘটেছে। একা হয়ে পড়েছে কাবুল।
জারাঞ্জের পতন সবার আগে ঘটলেও গত রোববার কুন্দুজ পতনের পর আশঙ্কা রীতিমতো উদ্বেগে রূপান্তরিত হয়। তখন পর্যন্ত দখলে যাওয়া চারটি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে তৃতীয় ও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজধানীর পতনের পর গণমাধ্যমের সামনে তড়িঘড়ি করে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ রূপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানান তিনি।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের কাছে বাইডেন বলেন, "দেখুন, আমরা ২০ বছর ধরে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ ব্যয় করেছি। তিন লাখ আফগান সেনা সদস্যকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক সমরসজ্জায় সজ্জিত করেছি। আফগান নেতাদের মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের নিজেদেরই নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে। নিজ দেশের জন্য লড়াই করতে হবে।"
অন্যদিকে, গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে তালেবানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ সামনে এসেছে। এর মধ্যে আছে- সাবেক সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণ, মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিরশ্ছেদ এবং মেয়েদের জোর করে বিয়ে করতে অপহরণ করার মতো ভয়াবহ সব চিত্র।
"আমরা কারাগারের কাছে মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেছি। সেগুলোর আশেপাশে কুকুর ঘোরাঘুরি করছিল," বলেন ৩৬ বছর বয়সী বিধবা ফ্রিবা। উত্তরাঞ্চলের শহর কুন্দুজ তালেবানের হাতে যাওয়ার পর রোববার ছয় সন্তান নিয়ে পালিয়ে কাবুল আসেন তিনি।
গত সপ্তাহে তালেবান দ্রুত অগ্রসর হতেই বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে পড়েছে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির আন্তর্জাতিক মিত্র গোষ্ঠীগুলো। দূতাবাসগুলো তড়িঘড়ি করে নিজ দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু, তালেবান বিদ্রোহীরা দেশের বিভিন্ন সংযোগস্থল বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলো দখলে নিয়েছে তারা। সমঝোতা চুক্তির তোয়াক্কা না করেই বিমানঘাঁটি দখলে নেওয়ায় সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত সপ্তাহে দখলে যাওয়া প্রায় সবগুলো শহর থেকে একই অভিযোগ এসেছে। ক্ষুধার্ত এবং হতাশ পরাজিত আফগান শক্তি কাবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রতিরক্ষা সহায়তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও আফগান সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
কিন্তু, আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর পেছনে ২০ বছর ধরে বিলিয়ন ডলার ব্যয় এবং পশ্চিমা জেনারেলদের অধীনে তিন লাখ সেনা সদস্যের প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও এত দ্রুত তাদের হটিয়ে দেওয়ার বিষয়টি রাজনীতিক এবং বিশ্লেষকরা কীভাবে দেখছনে?
আফগানিস্তানে বারাক ওবামার অধীনে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রোকারের মতে, বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখার অর্থ "দেশকে তালেবান যোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়া"।
আফগানিস্তান পুনর্গঠন প্রকল্পের মার্কিন বিশেষ মহাপরিদর্শকসহ অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত সহায়তার অপব্যবহার ও দুর্নীতি এই পতনের কারণ। দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং বেতনের পেছনে ব্যয় করা অর্থ পরিকল্পিতভাবে ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করা হলেও কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়।
আরও সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ ,করলে পশ্চিমা শক্তির অপসারণ এবং আফগান সরকার ও সামরিক নেতৃবৃন্দের অব্যবস্থাপনার পরিণতি হলো আজকের এই বিপর্যয়।
তবে, আফগানিস্তানের সবথেকে গুরুতর ভুল ছিল গ্রামীণ অঞ্চলের দিকে নজর না দেওয়া। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকে আফগান সামরিক বাহিনী কেবলমাত্র শহরগুলো প্রতিরক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিল।
ফলে, প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনপদগুলো দখল করে তালেবান প্রাদেশিক রাজধানীগুলো ঘিরে ফেলে। সকল ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তালেবান প্রাদেশিক রাজধানীগুলো একে একে দখল করে। ধারাবাহিক এই কৌশলেই এখন কাবুল দখলের পথে রয়েছে তারা।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আফগান সরকার ও সেনাবাহিনী তালেবানদের মতো উজ্জীবিত নয়। তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠী আকারে ছোট। কেন্দ্রীয়ভাবে যোদ্ধার সংখ্যা মাত্র ৬০ হাজার বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া, তাদের অস্ত্র সজ্জাও ভারি নয়। কিন্তু, তালেবান যোদ্ধারা ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিকভাবে উদ্দীপ্ত।
অন্যদিকে, আফগান সেনাদের দৃঢ় মনোবল থাকার মতো কোনো বিষয় নেই, অন্তত তাদের বেতন তো অবশ্যই না।
গত সপ্তাহে স্থানীয় রাজনীতিক এবং সেনা সদস্যদের দ্রুত পিছু হটতে দেখা গেছে। তারা তালেবানদের সাথে সবঝোতার চেষ্টা করেন। অনেকে আত্মসমর্পনও করে।
তালেবানের দ্রুত আগ্রাসনে আফগান সরকার বিপর্যস্ত হলেও এই পরাজয় ছিল অনিবার্য।
দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করা ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের সিনিয়র ফেলো বিল রোজিও বলেন, আফগান সেনাবাহিনী দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত।
মাঠ পর্যায়ের সেনা সদস্যদের কাছে তেমন কোনো অস্ত্র নেই। তাদের লড়াই করার মতো মনোবলেরও অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"কাবুল এবং এর আশেপাশের প্রদেশগুলোর যে সামরিক শক্তি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তা ব্যবহার করেই কাবুলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। নাটকীয়ভাবে কোনো পরিবর্তন না হলে কীভাবে তা সম্ভব আমার জানা নেই। যেসব প্রদেশের ইতোমধ্যে পতন ঘটেছে, সেগুলোও তালেবানের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে," বলেন তিনি।
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান