জীবন যুদ্ধে হার না মানা খাদিজা-কুলসুম
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ইউনিয়ন চরবিশ্বাস। এখানকার বাসিন্দাদের উপজেলা কিংবা জেলা সদরসহ দেশের যেকোনো এলাকায় যাতায়াত করতে হলে নৌপথের কোনো বিকল্প নেই। দুর্গম এ চরাঞ্চলে মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া পুরুষদের অন্য কোনো কাজ নেই। পরিবারে ও পরিবারের বাইরে স্বীকৃতি ও মর্যাদার প্রশ্নে দুর্গম এ চরের নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে। সেখানে কোনো নারীর ঘরের বাইরে গিয়ে অর্থ উপার্জনের কথা কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু সে প্রথা ভেঙে দুই নারী স্পিডবোট চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। হাল ধরেছেন দারিদ্র্যের কবলে থাকা সংসারের।
বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা দুরন্ত সব নদ-নদীতে স্পিডবোট চালিয়ে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন কুলসুম বেগম ও খাদিজা বেগম। এসব নদ-নদীর উত্তাল ঢেউ ও তীব্র স্রোতকে হার মানাতে পারলেও ডাঙার কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষের কাছে তারা অসহায়। প্রভাবশালীদের হুমকি ও বাধার কারণে হতাশা নেমে এসেছে তাদের জীবনে। স্পিডবোট চালানোর কারণে তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত এই দুই নারী ঘরে-বাইরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হচ্ছেন। তবে সাহস হারাননি তারা। প্রভাবশালীদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই তারা স্পিডবোট চালিয়ে যাচ্ছেন।
দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত খাদিজা ও কুলসুম বেগমের জীবন সংগ্রামের কাহিনী প্রায় অভিন্ন। জীবনে সংগ্রাম করে চললেও দিন বদলায়নি তাদের।
খাদিজা বেগমের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার চরবিশ্বাস ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিম চরবিশ্বাস গ্রামে। বাবার সংসারে অভাব অনটনের কারণে ১৩ বছর বয়সে খাদিজার বিয়ে হয়। স্বামী আদু আকন ব্যবসায়ী ছিলেন। চার সন্তান নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছিল তাদের। বিয়ের ১৪ বছরের মাথায় আদু আকন মরণঘাতী ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। তার চিকিৎসায় খরচ হয় অনেক টাকা। সংসারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর পর দিশেহারা হয়ে পড়েন খাদিজা। উলোটপালট হয়ে যায় সব হিসাব-নিকাশ। সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পরে তার কাঁধে। তবে দমে যাননি খাদিজা বেগম। পঞ্চম শ্রেণি পাস খাদিজা বেগম প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন নৌপথে স্পিডবোট চালান। লক্ষ্য একটাই দুই ছেলে ও দুই মেয়ের পড়ালেখা ও দু’বেলার অন্ন জোগাড় করা।
খাদিজা বেগমের মতোই সংসার চালাতে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন কুলসুম বেগম (২৮)। তার বাড়ি একই উপজেলার মধ্য চরবিশ্বাস গ্রামে। ২০১০ সালে পাশ্ববর্তী চরের একটি গ্রামের ফিরোজ মল্লিকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই স্বামী ও তার পরিবার কুলসুমের পরিবারের কাছে যৌতুক দাবি করে। এ নিয়ে প্রায়ই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকত। যৌতুককে কেন্দ্র করে প্রায় কুলসুমকে মারধর করতেন ফিরোজ। এরই মধ্যে ২০১১ সালে কুলসুম একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন। সংসারে নতুন সদস্য আসায় খরচ বেড়ে যায়। ওই সময় কুলসুমের ওপর নির্যাতনের মাত্রাও বেড়ে যায়।
সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে স্বামীর নির্যাতন মুখ বুঝে সহ্য করতেন কুলসুম। এরপরও সংসারের ভাঙন ঠেকাতে পারেনি তিনি। ২০১৪ সালে তার স্বামী যৌতুক নিয়ে অনত্র বিয়ে করেন। এরপর শুরু হয় সতীনের নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কুলসুম তার তিন বছরের ছেলে নাহিদকে নিয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। এরপর শুরু হয় সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। বাবার সংসারে অভাব অনটনের কারণে কাজ খুজতে শুরু করেন তিনি। তবে দুর্গম এ চরাঞ্চলে মাছ ধরা আর কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কোনো কাজ নেই। গ্রামের পুরুষরাই এসব কাজ করেন।
বর্ষার পর কার্তিকের ধানকাটা হলে তারাও প্রায় কর্মহীন। সেখানে নারীদের কাজ পাওয়া কল্পনাতীত। এর ওপর কেউ যদি স্বামী পরিত্যক্ত হন, কিংবা কারও স্বামী যদি মারা যান তাহলে নারীদের একপ্রকার পানিতেই পড়ে যেতে হয়। ২০১৫ সালের শেষ দিকে কুলসুম বেগম জানতে পারেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাকশন এইডের আর্থিক সহায়তায় চরবাসীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের (পিআরসিডি) অধীনে চর বিশ্বাস ও চর কাজলের অসহায় নারীদের স্পিডবোট চালনার প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। কুলসুম বেগম প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে দুর্গম এ চরাঞ্চলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে অ্যাকশন এইডের অংশীদার সাউথ এশিয়ান পার্টনারশিপ (স্যাপ)। পরে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটির (আভাস)।
৯ জন নারী ও ১১ জন পুরুষকে স্পিডবোট চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই ৯ জন নারীর একজন কুলসুম বেগম। ৬ মাসে প্রশিক্ষণ শেষ। ৪ বছর ধরে মেঘনা, তেতুলিয়া, আগুনমুখা, দাড়ছিড়া, বুড়াগৌরাঙ্গসহ আশপাশের নদ-নদীতে স্পিডবোট চালিয়ে অর্থ উপার্জন করছেন তিনি।
কুলসুম বেগম বলেন, চরকাজল ও চরবিশ্বাসের ৯ জন নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। এখন মাত্র ২ জন নারী এ পেশায় টিকে রয়েছেন। এরমধ্যে তিনি একজন। প্রভাবশালীদের বাধা ও নানা সমস্যার এর কারণে বাকি নারীরা এ পেশা ছেড়েছেন।
তিনি বলেন, লঞ্চঘাটগুলোতে নৌযানের জন্য যাত্রীরা অপেক্ষা করে। কিন্তু প্রভাবশালীদের বাধার কারণে বেশিরভাগ ঘাট থেকেই তাদের স্পিডবোটে যাত্রী ওঠা-নামা করতে দেয়া হয় না। এজন্য সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়ই বসে থাকতে হয়। তবে চর এলাকায় কারো সঙ্কটাপন্ন অবস্থা হলে খোঁজ পড়ে তাদের। দুর্গম চরাঞ্চল থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছতে তারাই যেন একমাত্র ভরসা।
কুলসুম বেগম বলেন, গত মাসে (ডিসেম্বর-২০১৯) মাত্র ৫ টি ট্রিপ পেয়েছি। ৫ জন রোগী। তাদের অবস্থা ছিল সঙ্কটাপন্ন। এরমধ্যে একজন ছিলেন অন্তস্বত্ত্বা মা। বিষপান করা এক নারী ও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী ছিল ৩ জন। ক্ষিপ্র গতিতে স্পিডবোট চালিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলাম হাসপাতালে। পরে জেনেছি চিকিৎসার পর ৫ জনই সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তখন মনে প্রশান্তি পেয়েছি।
কুলসুম বলেন, এছাড়া পর্যটক, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রকল্প পরিদর্শন কার্যক্রমের জন্য মাঝে মধ্যে তার স্পিডবোট ভাড়া নেওয়া হয়।
খাদিজা ও কুলসুম বেগম জানান, কাজটি মেয়েদের জন্য সহজ নয়। অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যে টিকে থাকতে হচ্ছে। প্রথমদিকে কাজে বের হলে অনেকেই ব্যঙ্গ করতো। হাসি-তামাশাও করছে অনেকে। কারও সমালোচনাকে পাত্তা দেইনি। বোট চালাতে কত্ত রকম ঝক্কি পোহাতে হয়। অনেক সময় ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয়। নদীর মধ্যে স্পিডবোট বিকল হয়ে যায়। তবে প্রশিক্ষণে ইঞ্জিনের রক্ষণাবেক্ষণসহ ছোটখাটো মেরামতের কাজ তারা শিখেছিলেন। ফলে খুব বেশি বিপদে পড়তে হয় না।
খাদিজা ও কুলসুম অভিন্ন স্বরে বলেন, প্রথম দিকে স্পিডবোট চালিয়ে ভালই উপার্জন হতো। কোনো কোনো মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার ছাড়িয়ে যেত। তবে এখন মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন লঞ্চ মালিক স্পিডবোট চালাতে বাধা দিয়ে আসছেন। তারা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে কেউ তাদেরকে কিছু বলার সাহস পান না।
খাদিজা বলেন, তারা মনে করেন আমাদের দুইটি স্পিডবোট চলার কারণে তাদের লঞ্চ ও স্পিডবোটে যাত্রী কমেছে। আমাদের স্পিডবোট চালানো বন্ধ করতে তারা নানা হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছেন। কিন্তু স্পিডবোট না চালালে কিভাবে চলবে আমাদের সংসার, এ চরে কে কাজ দিবে আমাদের। কথা বলতে বলতে খাদিজা বেগমের চোখ ভিজে ওঠে। হাত দিয়ে মুছে তা আড়াল করার চেষ্টা করেন।
কুলসুম বলেন, ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকা গেলেও প্রভাবশালী ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে লড়াই করে এ চরে বসবাস করা বড় কঠিন। তাদের একের পর এক ষড়যন্ত্র আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। আমাদের হেনস্তা করতে এমন কিছু নেই তারা বাকি রেখেছেন।
কুলসুম বেগমের প্রতিবেশী আবু সায়েম গাজী জানান, গলাচিপা উপজেলার মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ইউনিয়ন চরবিশ^াস। কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ৩৫ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরের হাসপাতালে নিতে হয়। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই বলে সেখানে যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। তবে কুলসুম ও খাদিজার স্পিডবোটের কারণে মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ মিনিটেই সেখানে পৌঁছানে সম্ভব হচ্ছে। তারা স্পিডবোট চালিয়ে শুধু সংসারই চলাচ্ছেন না- দুর্গম এ চরবাসীর সেবাও করে যাচ্ছেন।
মধ্য চরবিশ্বাস সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল হালিম বলেন, কুলসুম আমার স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। অভাব-অনটনের কারণে তার লেখা-পড়া এগোয়নি। কমবয়সেই তার বিয়ের খবর পেয়েছিলাম। কয়েক বছর পর জানতে পারি নির্যাতনের কারণে তাকে স্বামীর ঘর ছাড়তে হয়েছে। প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন সে স্পিডবোট চালক। এ দেশে নারীদেরকে সাধারণত এ পেশায় কাজ করতে দেখা যায় না। কুলসুম যখন স্পিডবোট চালায়-তখন তাকে নিয়ে আমার খুব গর্ব হয়।
চরবিশ্বাস ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল মুন্সী বলেন, দুর্গম এ চরে মেয়েরা স্পিডবোট চালক হবে-এটা একসময় স্বপ্ন ছিল। কিন্তু মেয়েরা এখন স্পিডবোট চালাচ্ছেন, অর্থ উপার্জন করছেন। এটা আশার কথা। নারীদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হলে তারা যে কোনো কাজেই অংশগ্রহণ করে সফলতা পেতে পারেন। তাদেরকে দেখে এ ইউনিয়নের অনেক নারী অনুপ্রানিত হয়েছেন।
অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটির (আভাস) প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, চর বিশ্বাস ও চর কাজল বাসিন্দাদের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পের অধীনে অসহায় নারীদের করতে স্পিডবোট কেনা হয়। পেশা শুরুর পর প্রায় দু’বছর নারী চালকরা ভালই উপার্জন করতো। ওই টাকার একটি অংশ স্পিডবোটের নারী চালকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো। বাকি অংশ একটি ব্যাংক হিসাবে জমা করা হয়। এরপর এ প্রকল্পে সঙ্গে যুক্ত হয় অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি অ্যাকশনস ফর সোসাইটির (আভাস)।
সংস্থাটির আর্থিক সহায়তায় নতুন আরও একটি অত্যাধুনিক স্পিডবোট কেনা হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের বাধার কারনে বেশিরভাগ রুটেই স্পিডবোট চালাতে পারছেন না খাদিজা ও কুলসুম বেগম।
প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরে স্পিডবোট দু’টির রুট পারমিট পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে রুট পারমিট দেওয়া হচ্ছে না।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) পটুয়াখালীর বন্দর কর্মকর্তা খাজা সাদিকুর রহমান জানান, গলাচিপা ও তার আশেপাশের এলাকায় ২০ থেকে ২৫ টি স্পিডবোট থাকতে পারে। এরমধ্যে ১৬ থেকে ১৮ টির রুটপারমিট রয়েছে। তবে ওই এলাকায় ২ জন নারী চালক রয়েছেন। তারা স্পিডবোট চালিয়ে সংসার চালান-বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তাদের কেউ বাধা দিলে তা দুঃখজনক। তারা যদি লিখিতভাবে অভিযোগ করেন-তা খতিয়ে দেখে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(https://tbsnews.net/feature/khadija-and-kulsum-tenacious-speedboat-drivers-38335)