ভাগ্য বলে পাখি, কবিতা
আমার বন্ধু জামশিদ ও তার বাগদত্তা শিরিনের সঙ্গে তেহরানের পাহাড়ের পাদদেশে ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করছিলাম। কদিন আগেই শিরিনের এক বন্ধুর ক্যানসার ধরা পড়েছে। তাই জামশেদ আর আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তাতে অবশ্য কোনো কাজ হচ্ছিল না। একটু এগোতেই দেখলাম পথের ধারে একটা বাক্সে অনেকগুলো রঙিন কার্ড নিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। একটা ক্যানারি পাখি বসে বাক্সটার ওপর।
আমাদের দাঁড়াতে বলে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গেল শিরিন। পার্স থেকে টাকা বের করে দিল তাঁকে। তারপর চোখ বন্ধ করে দুই হাত এক করল প্রার্থনার ভঙ্গিতে। ক্যানারিটা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে বাক্সের ভেতর থেকে একখানা কার্ড টেনে নিল চঞ্চুর সাহায্যে। হাত বাড়িয়ে কার্ডখানা নিয়ে ওটার উল্টো পিঠে লেখা কবিতাটা পড়ল শিরিন। পড়তে পড়তে হাসি ফুটে উঠল তার মুখে।
'কী লেখা?', পাশ থেকে জানতে চাইল জামশিদ।
আলহামদুলিল্লাহ! স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শিরিন। তারপর কার্ডের লেখাটা পড়ে শোনাল, "কানানে ফিরে যাবে পথভ্রষ্ট জোসেফ—দুঃখ কোরো না।" তার মানে আমার বন্ধু ভালো হয়ে যাবে।
প্রেম ও সুরা
কবিতা ইরানি সংস্কৃতিতে বিশেষ পবিত্র স্থান দখল করে আছে। ইরানিরা কবিতাকে স্রেফ শিল্পের একটি রূপ হিসেবেই কদর করে না, জাতপাতনির্বিশেষে সব শ্রেণির ইরানির জীবনযাপন ও নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মিশে রয়েছে কবিতা। রাস্তার ঝাড়ুদার পর্যন্ত আপনাকে জীবনের প্রবহমানতা নিয়ে লেখা ওমর খৈয়ামের কোনো কবিতার লাইন শুনিয়ে দেবে অনায়াসে। ট্যাক্সিচালক শুনিয়ে দেবে রুমির সুফি কবিতা, রাজনীতিবিদ দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলবেন ফেরদৌসির কবিতা শুনিয়ে। আমার বাবার চাচা শেখ সাদীর কবিতা এত পছন্দ করতেন যে আমাদের পরিবারের পদবির নাম রাখেন তাঁর একটি কবিতার পঙ্ক্তি থেকে (বেখরাদ—অর্থ জ্ঞানী)। তবে আর যা-ই হোক, ফারসি কবিদের মধ্যে ইরানিদের কাছে হাফিজের চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই।
চতুর্দশ শতাব্দীর কবি হাফিজের জীবনের বেশির ভাগ কেটেছে তাঁর জন্মভূমি শিরাজে, যা এখন 'কবিদের নগর' নামে বিখ্যাত। হাফিজ সবচেয়ে বিখ্যাত তাঁর গজলগুলোর (প্রেমের কবিতা) জন্য, যা পরিচিত দিওয়ান নামে। তাঁর রচনার সিংহভাগই কবিতা। হাফিজের সিংহভাগ কবিতাই প্রেম, সুরা এবং ধর্মীয় ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষের নির্লজ্জ ভণ্ডামি নিয়ে। নিজেকে পুণ্যবানের প্রতিমূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করার চেয়ে তথাকথিত 'পাপে' নিমজ্জিত থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন হাফিজ। তাঁর দিওয়ান উপমাসমৃদ্ধ, কিন্তু নিটোল ও সহজবোধ্য ভাষায় লেখা। তাঁর দিওয়ান অনেকের মতে, ফারসি কবিতার স্বর্ণযুগের উজ্জ্বলতম প্রতিনিধি।
হাফিজের কবিতা যেমন মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা কুড়িয়েছে, তেমনি সেই আমলে দারুণ বিতর্কিতও হয়েছে। তবে সব বাধা-বিপত্তি তুচ্ছ করে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়েই শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে রয়েছে তাঁর দিওয়ান। বর্তমান ইরানে হাফিজ অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অধুনাকালে তিনি পরিণত হয়েছে প্রায় দেবতুল্য ব্যক্তিতে। তাঁর কবিতা প্রায়ই ধ্রুপদি পারসিক সংগীতায়োজনসহযোগে গাওয়া হয়। শিরাজ শহরে হাফিজের মাজার সর্বক্ষণ গুঞ্জরিত থাকে ভক্তকুলের পদচারণে। সারা দুনিয়া থেকে তাঁর গুণমুগ্ধ ভক্ত ও পর্যটকেরা এসে ভিড় জমান এখানে।
তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটি হলো, ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য হাফিজের কবিতা ব্যবহার করার ইরানীয় প্রথা, অর্থাৎ শিরিন সেদিন যে কাজটি করেছিল, সেটি।
অশরীরীর ভাষা
এই প্রক্রিয়াটি ফাল-ই হাফিজ নামে পরিচিত, যার অর্থ 'হাফিজের মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী'। ঐতিহ্যবাহী এই প্রথার মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যৎ জানার জন্য কবিকে প্রশ্ন করা—যা লেসান ওল গেইব (অশরীরীর ভাষা) নামে পরিচিত এবং তাঁর কাছে কঠিন সিদ্ধান্ত ও সিদ্ধান্তহীনতার সমাধান চাওয়া।
ফাল-ই হাফিজ প্রথাটি ইরানে (এবং আফগানিস্তানের মতো অন্যান্য ফারসিভাষী অঞ্চলেও) বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত। একটি জনপ্রিয় লোকশ্রুতি অনুসারে, প্রথাটির প্রচলন হয় কবির মৃত্যুর পরে কোনো এক সময়। ১৭৬৮ সালে ওরিয়েন্টালিস্ট স্যার উইলিয়াম জোন্সকে পাঠানো এক চিঠিতে হাঙ্গেরির কাউন্ট ক্যারোলি রেভিকস্কি লেখেন (গল্পটি তিনি কোথাও থেকে শুনেছিলেন), হাফিজের মৃত্যুর পর কিছু ধার্মিক লোক বুঝতে পারছিলেন না, তাঁর মৃতদেহ নিয়ে কী করবেন। তাঁদের এ অনিশ্চয়তার কারণ 'হাফিজের কবিতার অশ্লীল ভাষা'। তাঁকে কবর দেওয়া হবে কি না, এ নিয়ে বিবাদ লেগে যায়। শেষে স্থির হয় যে হাফিজের বই থেকে দৈবচয়নের মাধ্যমে যেকোনো একটি পৃষ্ঠা খোলা হবে এবং সেই পৃষ্ঠার প্রথম লাইন দুটিকেই বেছে নেওয়া হবে ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে। ওতে যা লেখা থাকবে, সে অনুসারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে হাফিজকে কবর দেওয়া হবে কি না।
হাফিজের ভাগ্য ভালো। কারণ, যে পৃষ্ঠা খোলা হয়েছিল, তার প্রথম শ্লোকটি ছিল:
'হাফিজের লাশ দেখে কুঁকড়ে যেয়ো না;
পাপে ডুবে থাকলেও বেহেশতই তার ঠিকানা'
হাফিজের কবিতা যেমন ইরানিদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়, তেমনি জনপ্রিয় ফাল-ই হাফিজ প্রথাও। অনাদিকাল থেকেই ইরানিরা কৌতূহলী মানুষ। তারা সর্বদাই তাদের চারপাশের দুনিয়ার রহস্য এবং জীবনের গূঢ়ার্থের অনুসন্ধান করে চলেছে। তাদের অনুসন্ধিৎসু মনের উদাহরণ পাওয়া যায় কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এনসাইক্লোপিডিয়া ইরানিকা'তে। তাতে বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিক অ্যাগাথিয়াস লিখেছেন, জরথ্রুস্টীয় পুরোহিতরা কীভাবে অগ্নিশিখায় ভবিষ্যৎ দেখতেন। ইরানের জাতীয় মহাকাব্য শাহনামার এক জায়গায় ফেরদৌসি বর্ণনা করেছেন, সিংহাসনের মাথা থেকে একটি রত্ন পড়ে যেতে দেখে রাজা খসরু পারভেজ কীভাবে নিজের আসন্ন মৃত্যু ও সাসানিয়ান রাজবংশের পতন আন্দাজ করেছিলেন। অধুনাকালে ফারসি সাহিত্যের পণ্ডিত মাহমুদ ওমিদসালার এনসাইক্লোপিডিয়ায় লিখেছেন, ইরানিরা তাদের ভাগ্যগণনার জন্য তাস খেলে। কেউ কেউ তো এ কাজে অন্যান্য ফারসি কবির বই (যেমন রুমির মসনভি), এমনকি পবিত্র কোরআন শরিফও ব্যবহার করে। তবে ওমিদসালার একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন যে ইরানে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য হাফিজের দিওয়ানই সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।
আজ ইরানের যেকোনো জায়গায় শিরাজের ভ্রাম্যমাণ কবিদের দিয়ে যে কেউ ভাগ্যগণনা করিয়ে নিতে পারে। জনপ্রিয় বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে প্রশিক্ষিত পাখি নিয়ে ঘোরে ভবিষ্যদ্বক্তারা। পাখিগুলো কবিতা লেখা কার্ড তুলে ভাগ্যগণনা করতে সাহায্য করে। শিরিন তেহরানের যে জায়গা থেকে ভাগ্যগণনা করিয়েছে, এমন জায়গা ইরানে অনেক আছে। যানজটের জন্য কুখ্যাত তেহরানের মতো বড় শহরগুলোতে ট্রাফিকের লালবাতি জ্বললেই ছোট ছোট বাচ্চারা নেমে পড়ে কবিতা লেখা কার্ড নিয়ে যানজটে আটকা পড়া যাত্রীদের ভাগ্যগণনার জন্য। তাদের সঙ্গে অবশ্য পাখি থাকে না।
ইরানে হাফেজের কবিতা-কার্ডের বিক্রেতা বিস্তর আছে। হাতের কাছে দিওয়ান থাকলে যেকোনো জায়গায়ই ফল-ই হাফিজ করা যায়। মনে মনে একটা প্রশ্ন ঠিক করুন (প্রশ্নটা কিন্তু কাউকে জানানো যাবে না)। তারপর বইয়ের যেকোনো পাতা উল্টে দেখে নিন সওয়ালের জবাব।
'আমার কি ভেনিসে ঘুরতে যাওয়া উচিত?', 'আমার প্রেমিকা কি আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে?', 'চাকরিটা কি পাব?'—এমন অজস্র প্রশ্নের জবাব খুঁজে নিন ফল-ই হাফিজের মাধ্যমে। ইরানে তো প্রবাদই আছে যে সব প্রশ্নের জবাব জানেন কেবল স্রষ্টা এবং শিরাজের হাফিজ। আর সেই জবাব থাকে দৈবচয়নের মাধ্যমে খোলা বইয়ের একেবারে প্রথম দুই পঙ্ক্তিতে। ইরানিরা ইচ্ছা হলেই কবিদের পরামর্শ নেয়। অবশ্য প্রধান ইরানি উৎসবগুলোতে—যেমন নওরোজ (ইরানি নববর্ষ) ও শাব-ই ইয়ালদাতে (সূর্যের জন্মোৎসব)—নেওয়া ভবিষ্যদ্বাণীগুলোই বেশি গুরুত্ব পায়।
২০১৪ সালে আমিও চোখ বন্ধ করে মনে মনে একটা প্রশ্ন করে দিওয়ান-এর পাতা উল্টেছিলাম। পরদিন বিশ্বকাপে ইরানের সঙ্গে আর্জেন্টিনার খেলা ছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমাদের ছেলেরা লিওনেল মেসিদের টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করতে পারবে কি না। জবাব দেখে খুব হতাশ হয়েছিলাম:
'এ কালের দুঃখের অন্ত দেখতে পাচ্ছি না,
বেগুনি সুরা মজুত করো, এ ছাড়া আর কোনো দাওয়াই আমি জানি না।'
অচিরেই দেখলাম হাফিজ যে কেবল সুরার ব্যাপারেই জ্ঞান রাখতেন তা নয়, বিশ্বকাপের মতো আরও দু-একটা ব্যাপারেও জানাশোনা ছিল তাঁর। দিওয়ান-এর ভবিষ্যদ্বাণীই ফলেছিল—মেসিরা বিদায় করেছিল আমাদের।
সব মৌসুমের কবি
খৈয়াম আমার নায়ক। তবে আর সব ইরানির মতোই, হাফিজ মিশে আছেন আমার সমগ্র সত্তার সঙ্গে। হাফিজের সঙ্গে আমার অষ্টপ্রহর বসবাস। ছোটবেলায় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারতাম না, আমার নানি কেন হাফিজে মন্ত্রমুগ্ধ কিংবা আমার দাদা কেন দিনরাত হাফিজের কবিতা আওড়াতেন, কেনই বা তাঁর দিওয়ান-এর একটা কপি সব সময় থাকত দাদার লিভিংরুমের টেবিলে (এখনো থাকে)। শাব-ই-ইয়ালদাতে আমার ফুফু চোখ মুদে ফিসফিস করে কিছু একটা বলতেন, তারপর সেই দিওয়ান-এর একটা পাতা খুলে দেখতেন, তাঁর প্রশ্নের কী জবাব দিয়েছেন 'কামাতুর বুড়ো হাফিজ' (কার্ল মার্ক্সের কাছে লেখা এক চিঠিতে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস হাফিজকে এই নামে সম্বোধন করেছিলেন)।
সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হাফিজের কবিতার সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছি আমিও। গভীর আত্মিক বন্ধনে যুক্ত হয়েছি কবির সঙ্গে। বুঁদ হয়েছি ফাল-ই হাফিজের নেশায়। নিয়তিতে আমার বিশ্বাস নেই, সব সমস্যার সমাধানে হাফিজের কেরামতিতেও বিশ্বাস করি না। তবু খাঁটি ইরানীয় সত্তা বজায় রেখে কোনো কঠিন সমস্যায় পড়লেই কিংবা পরামর্শের দরকার পড়লেই ফিরে যাই হাফিজের কাছে।
অবশ্য হাফিজের কাছ থেকে আর্জেন্টিনার সঙ্গে ইরানের হারার ভবিষ্যদ্বাণী পাওয়ার পর বেশ মনঃক্ষুণ্ণই হয়েছিলাম। তবু কবি যখন দিওয়ান-এর মাধ্যমে আশ্বস্ত করেন যে সব ঠিক হয়ে যাবে, তখন ঠিকই অবর্ণনীয় আনন্দ ও স্বস্তিতে ছেয়ে যায় অন্তরাত্মা। আমরা সবাই—ইরানি হই আর যা-ই হই—দিন শেষে এই আশ্বাসবাণীটাই শুনতে চাই, কিংবা নিদেনপক্ষে বিশ্বাস করতে চাই, তাই না?
-
অনুবাদ: মারুফ হোসেন