খামারিদের দুর্দশা কমার লক্ষণ নেই
করোনাভাইরাসের ব্যপক সংক্রমণের ফলে এ বছর পশু কোরবানির পরিমাণ কমেছে। এর ফলে প্রায় ২৯ লাখ অবিক্রিত পশু নিয়ে যখন সারা দেশের খামারিরা চাপের মধ্যে, তখন হিমায়িত মাংসের আমদানি ও অবৈধভাবে গবাদি পশু প্রবেশ এ খাতকে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে জানান পশু খামারিরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর কোরবানি উপযোগী পশু ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ, যেখানে কোরবানি হয়েছে ৯০ লাখ পশু। অবিক্রিত থেকে গেছে প্রায় ২৯ লাখ পশু। এর মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ রয়েছে।
দুগ্ধ ও মাংস উৎপাদনকারী খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিএফএ) বলছে, ভারত ও মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে গরু আনার কারণে নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে খামারিদের ওপর। সারা দেশের খামারিরা যখন তাদের অবিক্রিত পশুগুলো কসাইয়ের কাছে বিক্রির চেষ্টা করছেন, তখন অবৈধভাবে গরু ঢুকতে থাকায় দেশি গরুর চাহিদা কমে যাচ্ছে।
বিডিএফএ আরও জানায়, কোরবানিতে অবিক্রিত পশুর বাজারমূল্য প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। এই গরুগুলো বিক্রি করতে না পারলে খামারিদের হাতে টাকা আসবে না। তারা নতুন করে বিনিয়োগও করতে পারবেন না। এমন পরিস্থিতিতে তারা আর্থিকভাবে আরও দুর্বল হচ্ছেন এবং অনেকে ব্যবসা বন্ধ করার কথাও ভাবছেন।
বিডিএফএ প্রেসিডেন্ট ইমরান হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা খামারিদেরকে তাদের অবিক্রিত গরুগুলো কসাইয়ের কাছে বিক্রির পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু কসাইয়ের কাছে যদি এসব গরুর চাহিদা কম থাকে, সেক্ষেত্রে আমাদের জন্য আর কোনো পথ থাকবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'একদিকে হিমায়িত মাংসের আমদানি আমাদের ওপর চাপ তৈরি করে রাখা হয়েছে, অথচ হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে কম দাম হওয়ায় ওই মাংসগুলোই বেশি চলে, আবার যদি অবৈধ পথে গরু আসে, তাহলে খামারিরা তাদের গরুগুলো কসাইয়ের কাছেও বিক্রি করতে পারবেন না।'
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পশু খাদ্যের চড়া মূল্যের কারণে অনেকে পরিচালনা ব্যয় চালাতে পারছেন না। অনেক খামারি ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে চাপে পড়েছেন।
খামারিরা জানান, তাদের খামারে অনেক বড় বড় গরু রয়েছে, যেগুলো বড় শহরের কসাইরা ছাড়া কিনতে কেউ চান না। এইসব গরু উৎপাদনই করা হয় কোরবানি ঈদের জন্য। কিন্তু এখন যখন বাধ্য হয়ে কসাইয়ের কাছে যেতে হচ্ছে তাদের; তবে সেখানেও তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরের বাবু ক্যাটেল অ্যাগ্রোর মালিক ওমর ফারুককে ঢাকার কোরবানি হাটে ৬০টি গরু বিক্রির জন্য আনলেও ৫০টিই ফেরত নিতে হয়েছিল। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'বেশি বড় গরু কসাইরা নিতে চান না। নিলেও দাম অনেক কম বলেন। তবু বিক্রির চেষ্টা করছি। কিন্তু পশুখাদ্যের যে দাম, তাতে খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে, ঋণ শোধের তাগাদা পেয়েছি ব্যাংক থেকে।'
খামারিরা আশংকা করছেন, ভারত ও মিয়ানমার থেকে জীবন্ত গবাদি পশু এবং হিমায়িত মাংস আমদানি বন্ধ করতে না পারলে দেশের খামারিরা তাদের অবিক্রিত পশুগুলো কসাইয়ের কাছেও বিক্রি করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে একেবারে পথে বসে যাওয়ার আশংকা তাদের।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম পোর্টে প্রায় ২৫০০ টন হিমায়িত মাংস ছাড়করণের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে যেখানে এক থেকে দেড় হাজার টন মাংস আমদানি করা হয়, সেখানে এবার ঈদের পরপরই আড়াই হাজার টন মাংস আমদানি করা হয়েছে।
হিমায়িত মাংসের আমদানি ও চোরাচালানের মাধ্যমে গরু আসা বন্ধ করতে বিডিএফএ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে খামারিদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে হিমায়িত মাংসের আমদানি ও অবৈধভাবে গরু চোরাচালান বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, কোরবানি ঈদের ঠিক পরপরই, অর্থাৎ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারত ও মিয়ানমারের গরু দেশে ঢুকছে। ফলে তৈরি হয়েছে দেশের গরুগুলোর চাহিদা কমে যাওয়ার শঙ্কা।
এজন্য অবিক্রিত গরু নিয়ে যেসব খামারি আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তাদের সহায়তার জন্য দ্রুত বিক্রির ব্যবস্থা করতে সরকারের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'কোরবানি ঈদে খুব বেশি পশু বিক্রি হয়নি, সেটা ঠিক। তবে সারা বছর যেহেতু মাংসের চাহিদা রয়েছে, সেহেতু পশুগুলো কসাইয়ের কাছে বিক্রি করলেই সমস্যা মিটে যাবে।'
'তবে অবৈধভাবে গরু আমদানি বন্ধ করতে না পারলে তখন বিষয়টা খামারিদের জন্য ক্ষতির কারণ হবে' উল্লেখ করে, এক্ষেত্রে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ডেইরি খামারের সংখ্যা ৬ লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি।