আফগানিস্তানে রাশিয়া ও চীনের প্রভাব মোকাবেলায় অপ্রস্তুত ভারত
ফের আফগানিস্তানের দখল নিয়েছে তালেবান। এর ফলে বদলে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক মানচিত্র। দেশটিতে প্রভাব খাটানোর পথ খুলে গেছে চীন ও রাশিয়ার জন্য। অন্যদিকে বেকায়দায় পড়ে গেছে এ অঞ্চলের আরেক বড় শক্তি ভারত।
আশরাফ ঘানির সরকারকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন ও সহায়তা করতো নয়া দিল্লি। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে ভারতের তিক্ত অতীত-ইতিহাস বর্তমান পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। অভিযোগ আছে, ভারতের শত্রুদেশ পাকিস্তান অনেকদিন ধরেই ইসলামি গোষ্ঠীটিকে প্রচ্ছন্ন সহায়তা দিয়ে আসছে। বিনিময়ে ভারতে হামলা চালানো কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে তালেবান।
ভারতও অন্যান্য দেশের মতো তালেবানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করবে কি না, এ নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে জোর বিতর্ক চলছে ভারতে।
গত মাসে তালেবানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দেখা করেছে চীন। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে রাশিয়ার দূত জানিয়েছেন, তিনিও গোষ্ঠীটির সঙ্গে দেখা করবেন। শুধু নয়া দিল্লিই এখনও ইতিকর্তব্য নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর জানিয়েছেন, তারা এখন কাবুলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আফগানিস্তানে অবস্থানরত ভারতীয়দের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা। গত মঙ্গলবার কাবুল থেকে ভারতের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়।
আফগানিস্তানে প্রভাব হারাচ্ছে ভারত
গত দুই দশকে আফগানিস্তানে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং হাসপাতাল, স্কুল, সেতু ও সংসদ নির্মাণে ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ ঢেলেছে ভারত। আফগানিস্তানও তার ভূমি ব্যবহার করে ভারতকে ইরান ও মধ্য-এশিয়ায় যাতায়াত করতে দিয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতা তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার মানে হলো সেখানে ভারতের কৌশলগত অবস্থান দুর্বল হয়ে যাওয়া, আর পাকিস্তানের অবস্থান শক্ত হওয়া। এর ফলে আফগানিস্তানে ভারতের কার্যক্রম চালানোর জায়গা ও সুযোগ দুটোই কমে আসবে।
আরেক প্রখ্যাত কূটনীতিবিদ অশোক মুখার্জি বলেছেন, আফগানিস্তানে ভারতের দুটো অগ্রাধিকার ছিল। প্রথম অগ্রাধিকার ছিল একটা বন্ধুসুলভ আফগান সরকারের—যে সরকার ভারতকে আফগানিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে মধ্য-এশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ করে দেবে। এর ফলে পাকিস্তানকে পাশ কাটিয়ে ইরানে চাবাহার বন্দর ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত। বন্দরটিতে নয়া দিল্লি টাকা ঢালছে।
আফগানিস্তানে ভারতের দ্বিতীয় অগ্রাধিকার ছিল উন্নয়ন অংশীদারত্ব মসৃণভাবে চালিয়ে যাওয়া। ভারত বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল মানবসম্পদ ও আফগানিস্তানের ৩৪ প্রদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর।
কিন্তু তালেবান-শাসিত সরকার খুব সম্ভব পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখবে। ফলে ভারতীয় প্রকল্পগুলো ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
আফগানিস্তানের নতুন সরকার কেমন হবে, এখনই তা আন্দাজ করা কঠিন। এদিকে রাশিয়া ও চীন যেহেতু ইতিমধ্যে তালেবানের সঙ্গে ব্যবসা করার ইচ্ছা জানিয়ে রেখেছে, কাজেই আমেরিকা ও তার মিত্রদের পদক্ষেপও সামনের দিনগুলোতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের আগে ভারত গোষ্ঠীটির কাছ থেকে আশ্বাস আদায় করতে চাইবে, আফগান ভূমি যেন ভারতের বিরুদ্ধে কাউকে ব্যবহার করতে দেওয়া না হয়।
তালেবান আশ্বাস দিয়েছে, আফগানিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের কোনো ক্ষতি তারা করবে না, ইসলামি আইনের মধ্যে থেকে নারী-অধিকার রক্ষা করবে এবং কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আফগান ভূমি ব্যবহার করতে দেবে। কিন্তু তাদের এই আশ্বাস এখনও কেউ ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।
কোন কৌশলে এগোবে ভারত
এদিকে তালেবানের ক্ষমতা দখলকে কীভাবে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে নয়া দিল্লিতে।
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক বিবেক কাটজু মনে করেন, তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ভারতের। তিনি বলেছেন, 'তালেবানের সঙ্গে রফায় আসা ছাড়া ভারতের হাতে কি এই মুহূর্তে আর কোনো উপায় আছে?'
তার মতে, আফগানিস্তানে ভারতের স্বার্থরক্ষার জন্য তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করাই সবচেয়ে ভালো উপায়।
কিন্তু ইসলামি গোষ্ঠীটির সঙ্গে ভারতের অতীত-অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। ১৯৯৯ সালে ভারতের একটি বাণিজ্যিক বিমান অপহৃত হলে তালেবান অপহরণকারীদের পালানোর সুযোগ করে দেয়।
একদল ভারতীয় কূটনীতিকের মতে, এবার তালেবানের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রাখা উচিত। তাদের মতে, তালেবানের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় গেলে দিল্লির অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
কানওয়াল সিবাল বলেছেন, 'আলোচনায় বসার আগে তাদেরকে (তালেবান) প্রমাণ করতে হবে যে, ভারতের বিরুদ্ধে তারা পাকিস্তানের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে না।'
গৌতম মুখোপাধ্যায়ের ধারণা, তালেবান 'স্থায়ী শাসক' হিসেবে টিকতে পারবে না। তিনি বলেন, দলটি সম্ভবত আফগানদের হতভম্ব অবস্থার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। 'আগে হোক পরে হোক, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই।'
গৌতম মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ, 'এখন ভারতের উচিত যতটা সম্ভব আফগান জনগণের ওপর মনোযোগ দেওয়া।'
এদিকে আফগানিস্তানের হিন্দু ও শিখরা ভারতে আশ্রয় পাবে, এ ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন মহল থেকে বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। টুইটারে সমালোচকরা মোদি সরকারকে রীতিমতো ধুয়ে দিয়ে বলেছেন, ভারতের এ ঘোষণা মুসলিম শরণার্থীদের বিরুদ্ধে প্রবল বৈষম্য।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট