জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় আটকে আছে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ
কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত ২৮৩.২৩ একর জমির মূল্য বাবদ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে গত ২ জুন ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার টাকার চেক হস্তান্তর করেছিলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
অধিগ্রহণকৃত জায়গার মালিকদের ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা পরিশোধ করে অল্প সময়ের মধ্যে ওই জায়গার দখল চট্টগ্রাম বন্দরকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা জেলা প্রশাসনের।
চেক হস্তাস্তরের আড়াই মাস পার হয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারেনি কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। দখল বুঝিয়ে দিতে এ পর্যন্ত ৩টি চিঠি দিলেও জেলা প্রশাসন থেকে কোন জবাব পায়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ।
দখল বুঝে না পাওয়ায় বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারছেনা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে ড্রেজিং কার্যক্রম সহ প্রকল্পের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নির্দিষ্ট মেয়াদে কাজ শেষ করতে পারবে কিনা এ নিয়েও দেখা দিয়েছে সংশয়।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মীর জাহিদ হাসান টিবিএসকে বলেন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে অধিগ্রহণকৃত জমির দখল বুঝিয়ে দিতে চিঠি এবং মৌখিকভাবে অনুরোধ করা হলেও তাদের কাছ থেকে কোন ধরনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। দখল বুঝে না পাওয়ায় জাইকাও তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ এগিয়ে নিতে পারছে না। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, জমির দখল বুঝিয়ে দিতে গত ১৪ জুন কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয় বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মীর জাহিদ হাসান। জবাব না পেয়ে একই বিষয়ে আবারো চিঠি দেওয়া হয়। এরপরও কোন জবাব না পেয়ে সর্বশেষ ৩ আগস্ট জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে বন্দর।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প সরকারের ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্প যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সরাসরি নিয়মিত মনিটরিং করে। তাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুকূলে অধিগৃহীত ২৮৩.২৩ একর জমির দখল হস্তান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি জমির দখলভার বুঝে না পাওয়ার কারণে ড্রেজিং কার্যক্রম সহ প্রকল্পের অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। চিঠিতে জমির দখল হস্তান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অধিগ্রহণকৃত জায়গার মালিকানা রয়েছে ২২৯ জনের। সেখানে এখনো বসতি রয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এখনো বসবাসকারীদের টাকা গ্রহণ সংক্রান্ত নোটিশও দিতে পারেনি।
এই প্রসঙ্গে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আল আমিন পারভেজ টিবিএসকে বলেন, অধিগ্রহণকৃত জায়গায় মালিকদের তালিকা করা হচ্ছে। এরপর তাদের টাকা গ্রহণের জন্য নোটিশ করা হয়। লকডাউনের কারণে সঠিক সময়ে এই কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি।
কবে নাগাদ চট্টগ্রাম বন্দরকে জমির দখল হস্তান্তর করা যাবে এর কোন সঠিক সময় উল্লেখ না করে তিনি বলেন, শীঘ্রই দখল বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় মাতারবাড়ী ও ধলঘাট এলাকায় নির্মিত হবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ 'মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প' বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর বন্দর ভবন চত্বরে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধমে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার ঘোষণা দেয়।
২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ হলে মাতারবাড়ি বন্দরের টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৮.৫ মিটার গভীরতার জাহাজ। এই বন্দরে ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করার লক্ষ্যে ডিজাইন করা হচ্ছে। পরে জেটি বাড়লে সক্ষমতা আরো বাড়বে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের মোট বাণিজ্যের ৯২ ভাগ চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সম্পন্ন হয়। যে গতিতে ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, চট্টগ্রাম বন্দর তার সক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণ কাজ পিছিয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২,৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২,৬৭১ কোটি টাকা। প্রকল্প নির্মাণের মেয়াদ ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পে প্রথম ধাপে ডিজাইন, সিভিল ওয়ার্ক হবে। দ্বিতীয় ধাপে হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হবে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়ের পক্ষ থেকে প্রকল্পের যাবতীয় নকশা ব্যয় নির্ধারণ, টেন্ডার ডকুমেন্টস তৈরি এবং অবকাঠামোগত নির্মাণের বিষয়গুলো মনিটর ও তদারক করা হবে। পরবর্তী সময়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ থেকে শুরু করে বন্দর চালু করে দেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করবে। বন্দর চালু হওয়ার এক বছর পর্যন্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দেবে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে ২৩৪ কোটি টাকা দেওয়া হবে।
আর ওরিয়েন্টাল কনসালট্যান্ট গ্লোবাল কোম্পানি প্রকল্পের (বন্দর সংযোগ সড়ক অংশ) সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের কার্যক্রম-সংক্রান্ত পরামর্শ দেবে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে ৪৬৬ কোটি টাকা দেওয়া হবে।
সরকার ২০১৪ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পটি ২০২০ সালের ১০ মার্চ একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। ২০২০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর কনসালটেন্টের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৬ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্প উন্নয়নের কাজ শুরু হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে জমির দখল বুঝিয়ে দিলে প্রকল্প নির্মাণে বড় একটি ধাপ এগিয়ে যাবে। এখন প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ চলছে। জাইকা সমুদ্র বন্দরের ডিজাইন প্রস্তুত করছে। এরপর আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হবে।
এদিকে মাতারবাড়ি বন্দর নির্মাণের আগে সেখানে প্রস্তুত করা হয়েছে আড়াইশ মিটার প্রস্থ, ১৬ মিটার গভীরতা এবং ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল বা প্রবেশপথ। নির্মিত হয়েছে ২টি জেটি। পরবর্তীতে চ্যানেলের প্রস্থ আরো ১০০ মিটার বাড়ানো হবে।
মাতারবাড়িতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় চ্যানেল ও জেটি। ২০১৫ সালে শুরু হয় জেটি নির্মাণের কাজ। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথম জেটিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি নিয়ে প্রথম বাণিজ্যিক জাহাজ ভেসান ট্রায়াম্প ভিড়ে মাতারবাড়ি চ্যানেলের জেটিতে। এরপর চলতি বছরের ১৫ জুলাই দ্বিতীয় জেটিতে প্রথমবারের মতো ভিড়ে বাণিজ্যিক জাহাজ এমভি হরিজন ৯। এ পর্যন্ত ২টি জেটিতে ২০টি জাহাজ ভিড়েছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শেষে জেটি ও চ্যানেল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হবে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে।