ডিম ও মাংস উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির দাবি বাস্তবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়
করোনার থাবায় দেশব্যাপী ডিম ও মাংস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মুরগির খামার বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (ডিএলএস) ডিম ও মাংসের উৎপাদনে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে সুখবর দিচ্ছে। ফলে সেক্টর সংশ্লিষ্টরা বন্ধ খামারে ডিম ও মাংসের উৎপাদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সম্প্রতি ডিএলএস ২০২০-২১ অর্থবছরের 'লাইভস্টক ইকোনমি' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সে প্রতিবেদনে ডিম, মাংস ও দুধের উৎপাদনের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উল্লেখিত বছরে ২০৫৭.৬৪ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে যা ২০১৯-২০ এ ছিল ১৭৩৬ কোটি পিস। এক বছরের ব্যবধানে ৩২১ কোটি পিস ডিম বেশি উৎপাদন হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, মাংসের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি। ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ২০২০-২১ অর্থবছরেও মাংসের উৎপাদন বেড়ে ৮৪.৪০ লাখ মেট্রিক টনে পৌঁছে। যা আগের বছর ছিল ৭৬.৭৪ লাখ মেট্রিক টন।
নতুন উৎপাদন তথ্য হিসেব করলে প্রতিদিন একেকজন মানুষের মাংসের গড় প্রাপ্যতা রয়েছে ১৩৬.১৮ গ্রাম; যেখানে প্রতিদিনের চাহিদা রয়েছে ১২০ গ্রাম করে।
তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিম, মাংসের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির দাবি করলেও সেক্টর সংশ্লিষ্টরা বলছেন উল্টো কথা। তাদের দাবি, করোনার মধ্যে কম চাহিদা, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া ও উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রির কারণে হাজার হাজার খামারি এখন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) দেয়া তথ্য বলছে, গত দেড় বছরে লেয়ার মুরগির খামার (এই খামারগুলো ডিমের উৎপাদনে জড়িত) বন্ধ হয়েছে ৩০-৩৫ শতাংশ। আর ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির খামার (মাংস উৎপাদনে জড়িত) বন্ধ হয়েছে ৪০-৪৫ শতাংশ। এর প্রধান কারণ এই সময়ে চাহিদা কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। যারা উৎপাদন করছে তাদেরও অনেকে বাজারজাত করার সমস্যা, বাড়তি খরচে উৎপাদন করেও দাম না পাওয়ায় পুঁজি হারিয়ে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
বিপিআইসিসির সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, "স্কুল-কলেজ, বিয়েশাদির অনুষ্ঠান, কর্পোরেট অনুষ্ঠান, দর্শনীয় স্থান সবই বন্ধ। এই সময়ে চাহিদা কমে যাওয়া, ডিম, মুরগির উৎপাদন কমে যাওয়া এবং উৎপাদিত পণ্য খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করতে হয়েছে- যে কারণে অনেকেই লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিয়েছে"।
তিনি বলেন, "প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর উৎপাদন বৃদ্ধির যে তথ্য দিয়েছে তা বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়"।
জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হতো ২.২৫ কোটি থেকে ৩ কোটি পিস। চাহিদা কমে যাওয়ায় এই উৎপাদন ১.৩৫ কোটি পিসে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফ আইএবি) তথ্য বলছে, কোভিডকালীন সময়ে ফিডের চাহিদা ৩০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। অনেকে মুরগি পালন বন্ধ করে দেয়ায় এই চাহিদা কমেছে বলে জানায় সংগঠনটি। ২০১৯-২০ এ ৬৫ লাখ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন ফিড উৎপাদন হয়েছে। এর প্রায় ৬৩ শতাংশ ফিড ব্যবহার হয়েছে পোল্ট্রি খাতে।
এফআইএবি'র সভাপতি ইহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, "প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ডিম, মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির তথ্য কোনভাবেই ঠিক না। বাস্তব চিত্রের সঙ্গে এর কোন মিল নেই। কারণ ফিডের চাহিদা কমেছে ৩০ শতাংশেরও বেশি। বেশ কিছু কোম্পানি টিকতে না পেরে বিক্রির জন্য ক্রেতা খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রডাকশন বেশি থাকলে তো এই চিত্র দেখা যেত না"।
খামার বন্ধ হওয়া এবং উৎপাদন কমে যাওয়ার চিত্র পাওয়া গেছে বিভিন্ন উপজেলার তথ্য থেকেও। এর মধ্যে জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯-২০ এ মোট মুরগির খামার ছিল ৬২৬টি, যা গত বছর নেমে এসেছে ৫৯০টিতে।
এ ধারাবাহিকতায় ডিম ও মাংসের উৎপাদনও কমেছে এই উপজেলাটিতে। জানা গেছে, ১০ কোটি ৮৯ লাখ পিস থেকে কমে ডিমের উৎপাদন ১০ কোটি ৭৭ লাখে নেমেছে। মাংসের উৎপাদনও ০.১৫৭ লাখ মেট্রিক টন থেকে কমে ০.১৪৬ লাখ মেট্রিক টনে নেমেছে।
সরিষাবাড়ি থানার এক ফিড ব্যবসায়ী মাজহারুল ইসলাম বলেন, "দেড় বছরে খামারের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে গেছে। এখন ৩০০টি খামারও নেই"।
সরিষাবাড়ির মত অবস্থা সারাদেশেই বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ব্রিডার এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক রকিবুর রহমান টুটুল টিবিএসের কাছে চট্টগ্রাম জেলার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৭ হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ২ হাজার খামার।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলায় মাসে ২০ লাখ পিস মুরগি উৎপাদন হতো। বর্তমানে এই সংখ্যা নেমে এসেছে ৮ লাখে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা টিবিএসকে বলেন, "করোনার কারণে ছোট কিছু খামার বন্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে প্রডাকশন কমেনি। কারণ কোথাও মাছ, মাংস, দুধ, ডিমের সরবরাহে ঘাটতি ছিল না"।
উল্লেখ্য, সারাদেশে নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা ৯০ হাজার। তবে এক লাখেরও বেশি হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রডাকশনের তথ্য কিভাবে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আমরা প্রতি মাসে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায় থেকে আমাদের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করি। এর জন্য একটি নির্দিষ্ট ফরম রয়েছে। এই ফরমেই তথ্য পাঠায় কর্মকর্তারা"।
এদিকে প্রাণিসম্পদের প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, মাথাপিছু চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে ডিম উৎপাদন হচ্ছে পোল্ট্রি খাতে। এক বছরের ব্যবধানে দেশের মানুষের মাথাপিছু ডিমের গড় প্রাপ্যতা বেড়ে ১২১টিতে উন্নীত হয়েছে। যা আগে ছিল ১০৪টিতে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্য বলছে, একজন সুস্থ মানুষের বছরে গড়ে ১০৪টি করে ডিম খাওয়া উচিত।
লাইভস্টক ইকোনমিতে ডিম ছাড়াও মাংস ও দুধের উৎপাদন বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখিত সময়ে দুধের উৎপাদন হয়েছে ১১৯.৮৫ লাখ মেট্রিক টন। যেখানে ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ছিল ১০৬.৮০ লাখ মেট্রিক টন। দুধের বর্তমান উৎপাদন হিসেব করে দেখা গেছে, দেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ১৯৩.৩৮ মিলিলিটার দুধ খেয়েছে।
যদিও একজন সুস্থ মানুষের দৈনিক অন্তত ২৫০ মিলিলিটার দুধ খাওয়ার প্রয়োজনের কথা বলছে এফএও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএলএসের পরিচালক (এক্সটেনশন) ড. দেবাশীষ দাস বলেন, "কিছু ছোট খামার বন্ধ হয়ে গেছে সেটা ঠিক, কিন্তু বড় কিছু খামার রয়েছে যাদের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের যে তথ্য তা একদমই সঠিক"।
তিনি দাবি করেন, "দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদনে এখন অনেক উন্নতজাত ব্যবহার হচ্ছে যেগুলো প্রডাকশনে বড় ভূমিকা রাখছে"।