কারো হাতে টাকা নেই, টাকা তোলার জন্য মরিয়া আফগানরা ভিড় করছে ব্যাংকের সামনে
তালেবান ক্ষমতা দখলের পরের দুই সপ্তাহ থেকেই বন্ধ আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো। মানুষের হাতে নেই টাকা এবং নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতিও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ সঞ্চিত অর্থ উত্তোলনে ভিড় করছেন ব্যাংকের সামনে। সামনের দিনগুলোতে কঠিন অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের দুশ্চিন্তাও তাদের মধ্যে ভর করেছে। সব মিলিয়ে প্রায় ভেঙ্গে পড়ার দ্বারপ্রান্তে দেশটির ব্যাংকিং খাত।
কাবুল থেকে আসা চিত্রের সুবাদে ব্যাংকগুলোর সামনে বহু মানুষের জমায়েত দেখছে বিশ্ববাসী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কিছু সংবাদে ভিড়ের মধ্যে জনতার উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কথা যেমন জানা গেছে, ঠিক তেমনি পাহারায় নিয়োজিত তালেবান যোদ্ধারা তাদের গাছের ডাল দিয়ে পিটিয়েছে, জানা গেছে এমন খবরও। ভিড় ছত্রভঙ্গ করতে মানুষের দিকে পাথরও ছুড়ে মারে তারা।
আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলি মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন'কে জানায়, তালেবানের নির্দেশ মেনে ব্যাংকে লেনদেন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। টাকা ফুরিয়ে আসায় ব্যাংক প্রদত্ত অন্যান্য সেবা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থেই বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর কাছে টাকা প্রায় শূন্যের কোঠায়।
এমনটা হওয়ার প্রধান কারণ, আফগান অর্থনীতি আন্তর্জাতিক সহায়তায় বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহের উপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল। তালেবানের ঝড়ো গতিতে কাবুল দখলের পর থেকে অধিকাংশ দাতাগোষ্ঠী তাদের প্রতিশ্রুত তহবিল ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, নানা ধরনের অনুদানের সাহায্যেই আফগানিস্তানের সরকারি ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ নির্বাহ করা হতো।
তাই দাতাগোষ্ঠী মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পর গভীর অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের মেঘ জড়ো হয়েছে মধ্য এশীয় দেশটির অর্থনীতির ভাগ্যাকাশে, যেখানে ৪৭ শতাংশ গৃহস্থালি দারিদ্র্যের শিকার।
আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক, গ্রাহক এবং বিনিয়োগকারীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স গ্রুপের লেখা একটি মেমো গত ২৩ আগস্ট প্রকাশ করে আফগান-আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স। সেখানে লেখা ছিল, "আফগানিস্তান ও দেশটির ব্যাংকিং খাত অস্তিত্ব সংকটের মতো আসন্ন বিপদের দিকে এগিয়ে চলেছে, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়তে পারে।"
নিরাপত্তার স্বার্থে নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন আফগান অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ সিএনএন'কে বলেছেন, "সবটাই বিশাল তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংক খুলে দেওয়া মাত্রই সকলে অনুধাবন করবেন, পুরো ব্যবস্থার ভিত্তি কতোটা দুর্বল।"
আরেকজন ব্যাংকার বলেছেন, "আমার সহকর্মীরা এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।"
ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ধরে নেওয়ার কারণও যথেষ্ট। তালেবান কাবুল দখলের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রে থাকা আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের বেশি সম্পদ ফ্রিজ করে বাইডেন প্রশাসন। তালেবান সরকার বা তাদের অধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অর্থ চাইলেও পাবে না।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক বৃহৎ দাতাগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আফগানিস্তানের জন্য ছাড়কৃত ৪৫ কোটি ডলার গেল সপ্তাহের শুরুতে স্থগিত করে। একইভাবে, বিশ্বব্যাংকও স্থগিত করেছে প্রতিশ্রুত সহায়তা।
এ বাস্তবতায় দ্রুত নগদ তহবিল ফুরিয়ে আসার ঘটনা উল্লেখ করে আফগান ব্যাংকিং গ্রুপটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনতিবিলম্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ ছাড়করণের আহবান জানায়।
নতুন শাসকদের প্রাক্তন শত্রু যুক্তরাষ্ট্র, আগামীদিনে তালেবান- যুক্তরাষ্ট্র সংযোগ কোন পর্যায়ে থাকবে তাও দেখার বিষয়, তবু নিরুপায় হয়েই দেশটির ব্যাংকাররা এ আহবান জানিয়েছেন।
অর্থ সংকট যেকোনো দেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও, বাণিজ্যে বিশাল ঘাটতি থাকায় আফগানিস্তানের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা।
আফগান ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স গ্রুপটি আরো লিখেছে, "দ্রুত রিজার্ভের অর্থ হাতে না পেলে আমাদের আশঙ্কা সমগ্র আফগান অর্থনীতি ব্যর্থ হবে, বাধ্য হয়ে তখন গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বিক্রি করতে হবে। আমাদের পরিষেবা বন্ধ হয়ে গেলে, জনগণ খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক সেবা বঞ্চিত হবে, যার ফলে দেশজুড়ে হতাশা ও ক্ষোভের কারণে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত দেখা দিবে।"
আরেকটি সূত্র সিএনএন'কে বলেছে, অর্থনৈতিক সংকট তালেবান সরকারকে এমন আকস্মিক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চলেছে, সমস্ত দেশ যার ফলে অস্থিতিশীল হবে। সংকটের জেরে দেশটির প্রতিদ্বন্দ্বী জিহাদি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার তীব্র লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়লে, অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র অঞ্চলজুড়ে।
তালেবানের কাবুল দখলের আগে দেশ ছেড়ে পালানো আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আজমল আহমেদি ইতঃপূর্বে দেশটির সামনে আসন্ন অর্থনৈতিক প্রতিকূলতা, বিপুল মুদ্রাস্ফীতি এবং দেশত্যাগী মানুষের ভিড় সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দিয়েছিলেন।
তিনি সিএনএন'কে বলেন, "বহির্বিশ্বের মানবিক সহায়তা এই মুহূর্তে শুধু অব্যাহত রাখাটাই জরুরি নয়, বরং তা সামনের মাসগুলোতে আরও বাড়াতে হবে। আরেকটি সংকটের জন্য অপেক্ষা করা কোনমতেই উচিত হবে না।"
গত মঙ্গলবার তালেবানের একজন মুখপাত্র জানান, অচিরেই ব্যাংক খুলে দেওয়া হবে। পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের পতন ঘটিয়ে গত দশদিনের বেশি সময় ব্যাংকিং খাত বন্ধ রাখার পর এ বার্তা দেন তিনি। এসময়ে পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে পড়েছে দেশটির আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহ।
কিন্তু, মুখপাত্রের দাবির বিপরীতে ব্যাংক পুনরায় খুলে দেওয়ার ব্যাপারে তালেবানের শীর্ষ পর্যায়ের কোন পদক্ষেপ আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান নয়। ফলে গেল বুধবারেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সামনের রাস্তায় হয়রান জনতার ভিড় চোখে পড়েছে।
লন্ডনে অবস্থিত আফগান দূতাবাসের বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা গজল গাইলানি বলেন, "টানা বন্ধ থাকছে ব্যাংকগুলো, খুলে দেওয়ার নেই কোন ইঙ্গিত। আফগানিস্তানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে, আবার মানুষের হাতের টাকাও ফুরিয়ে আসছে।"
আফগানিস্তানের অনেক গ্রামাঞ্চলে অর্থ ছাড়াও জীবনযাত্রা চলতে পারলেও, শহরে সেভাবে জীবনধারণ অসম্ভব।
তাছাড়া, বেশিরভাগ সরকারি কর্মীই ব্যাংক চেকের মাধ্যমে বেতন পেতেন। নগদ লেনদেন নির্ভর অর্থনীতি হওয়ায় মানুষের কষ্টও সীমাহীন হয়ে উঠছে।
ঋণদাতারাও আস্থা পাচ্ছেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের দোষ দেওয়াও যায় না। টানা চার দশকের যুদ্ধের পর তালেবান প্রশাসনের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা ও সচলের প্রচেষ্টা কতদূর সফল হবে, সেটাই অনাস্থার মূল কারণ।
এ বাস্তবতায় অবৈধ মাদক ছাড়া বড় কোন বৈধ রপ্তানি খাত নেই দেশটির। রপ্তানির বৈধ খাত থাকলে সেখান থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ তারল্য সংকটকে মোকাবিলা করা যেতো। ইতোমধ্যেই, বন্ধ হয়েছে ডলারের ভিত্তিতে প্রতিবেশী দেশ থেকে আমদানির বাণিজ্য। ফলে ওষুধ, খাদ্যসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক গভর্নর আজমল আহমেদি।
- সূত্র: ডেইলি মেইল