বাণিজ্যে শর্টকাট পথ ধরে চড়া মূল্য দিচ্ছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা
২০১৯ সালে এক মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আমদানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ বন্ধ করার আগে, ভালো ব্যবসাই করেছে টেরিটাওয়েল প্রস্তুতকারক ভার্জিন গ্রেস লিমিটেড।
ভার্জিন গ্রেসের কাছে এখন সাড়ে ৪ লাখ মার্কিন ডলার বকেয়া রেখে, ওই আমদানিকারক কোন সাড়াই দিচ্ছে না।
অপেক্ষাকৃত ছোট এ রপ্তানিকারক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাহায্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের প্রচলিত প্রক্রিয়া- লেটার অব ক্রেডিট বা এলসি পাশ কাটিয়ে সেলস কন্ট্রাক্ট নামের শর্টকাট ধরার খেসারত দিচ্ছে এখন। আর্থিক ক্ষতির সাথে সাথে মুদ্রা পাচারের মতো আইনি ঝুঁকিরও সম্মুখীন প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ হিল আজিজ বলেন, 'সাড়ে চার লাখ ডলারের মধ্যে বহু চেষ্টা করে এ পর্যন্ত মাত্র ২৭ হাজার ডলার পেয়েছি। গত কয়েক মাস থেকে আর ফোনও রিসিভ করে না, কোন টাকাও দিচ্ছে না।'
বিভিন্ন সূত্রমতে, ভার্জিন গ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিল করলে, মানি লন্ডারিং মামলার সম্মুখীন হতে পারে। এছাড়াও, ভবিষ্যতে কোম্পানির রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে।
কারণ, যখন কোন পণ্য বিদেশের বাজারে পাঠানো হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমে রপ্তানি নিবন্ধন করে এবং পরে রপ্তানি আয় হিসাব করে। কোন রপ্তানি আনুষ্ঠানিক নীতিমালা অনুসরণ করে না করা হলে, সেটিকে সম্ভাব্য মুদ্রা পাচারের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
'মুদ্রা পাচারের মামলা ঠেকাতে গিয়ে ইতিমধ্যে ঢাকার পূর্বাচলে নিজের জমি বিক্রি করে ব্যাংকের কিছু দায় শোধ করেছেন আজিজ। আর্থিক দৈন্যতার কারণে এখন আগের ৩৫০ জন কর্মী কমিয়ে মাত্র ৫০ জন কর্মী দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন।
'এক সময় আমার ৫২টি তাঁতে সাড়ে তিনশ শ্রমিক কাজ করতো। নিজে কিছু অর্ডারের কাজ করার পাশাপাশি, বাইরেও সাব- কন্ট্রাক্টে করাতাম। এ ঘটনার পর, আমার প্রতিষ্ঠান প্রায় বসে গেছে। এখন মাত্র ৫০ জন লোকবল নিয়ে, অন্যের কাছ থেকে কাজ নিয়ে সাব-কন্ট্রাক্টটিং করে টিকে থাকার চেষ্টায় আছি,' আক্ষেপ করে বলেন তিনি।
এরকম আরও অন্তত সাত বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকের তথ্য পাওয়া গেছে, যারা এ প্রক্রিয়ায় ১৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে প্রতারণার শিকার হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এভাবে রপ্তানিকৃত অর্থ না পাওয়ার তালিকায় আরো বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এবং তাদের বেশ বড় অঙ্কের অর্থ আটকে রয়েছে; কিন্তু অর্থপাচার মামলায় পড়া ও পরবর্তী রপ্তানি আটকে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে, তারা এসব বিষয় প্রকাশ করেন না। কেউ কেউ নিজস্ব সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকের সহযোগিতায় 'ভিন্ন উপায়ে' রপ্তানির অর্থ প্রত্যাবাসন দেখিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
পণ্য আমদানি রপ্তানিতে স্বতসিদ্ধ নিয়ম- 'লেটার অব ক্রেডিট' বা এলসি হলেও, খরচ ও সময় বাঁচাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেলস কন্ট্রাক্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যাতে বেশকিছু প্রতারণার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতারকদের সহজ শিকার হোম টেক্সটাইল রপ্তানিকারকরা:
ভিক্টিম প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে; আঞ্জির টেক্সটাইল, ভার্জিন গ্রেস লিমিটেড, আল মুসলিম টেক্সটাইল, এইচএন কটন প্রোডাক্টস লিমিটেড, বাংলাদেশ টাওয়েল, মিরে টাওয়েল ও মোলটেক্স। এরা সকলেই হোম টেক্সটাইল তৈরি করে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি রপ্তানিকারক।
এর মধ্যে, আঞ্জির টেক্সটাইল ও ভার্জিন গ্রেস লিমিটেড– এ দুই প্রতিষ্ঠানেরই আটকে আছে, প্রায় সাড়ে আট লাখ মার্কিন ডলার। সবগুলো প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিতে পাওনার পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ডলার।
প্রতারণার শিকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা দ্য বিজনেস স্ট্যাডার্ডকে বলেছেন, তাদের প্রায় সকলেই যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এক আমদানিকারক কামরান মালিকের সাথে ব্যবসা করেছেন। ওই ব্যবসায়ী রপ্তানিকারকের মূল্য পরিশোধ না করেই বন্দর থেকে কৌশলে মাল খালাস করিয়েছেন।
রপ্তানিকারকরা জানান, ক্রেতার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের নিতে দরকারি নথি দিয়ে শিপিং এজেন্টরাও তাদের সহযোগিতা করছে না।
একটি রপ্তানিকারক কোম্পানির প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আমদানিকারককে যথেষ্ট সময় দিয়েছি। কিন্তু তারা শুধু আমাদের বিশ্বাসের অপব্যবহার করেছে।'
তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ওই আমদানিকারক যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাকিস্তানে চলে গেছেন।
তিনি আরো বলেন, 'আমরা রপ্তানি আয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়সীমা দু'বার বাড়িয়েছি, এবং টাকা পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক রপ্তানিকারক জানান, রপ্তানির অর্থ ফেরত আনার জন্য তাকে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অন্যান্যদেরও একইভাবে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
অভিযুক্ত বায়ার কামরান মালিকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে টিবিএস-এর পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং এসএমএস করে এ বিষয়ে জানতে চাইলেও উত্তর দেননি।
সমিতিও যেখানে অসহায়:
প্রতারণার শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো- বাংলাদেশ টেরিটাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) এর সদস্য।
এ সংগঠনের চেয়ারম্যান শাহাদত হোসেন সোহেল বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, রপ্তানির টাকা আটকে থাকার তথ্য আমরা জেনেছি এবং কোন কোন প্রতিষ্ঠানের কত টাকা আটকে আছে, তাও জানি। কিন্তু, প্রতারণার শিকার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কিছু জানায়নি। ফলে আমরা অ্যাসোসিয়েশন থেকে তাদের সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে পারছি না।
আনুষ্ঠানিকভাবে কেন জানায়নি – এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'অভ্যন্তরীণ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কায়, তারা জানাতে চায় না।'
'এসব রপ্তানিকারক স্বল্প পুঁজির। রপ্তানির অর্থ না পেলে, তাদের জন্য ব্যবসায়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে' – বলেন তিনি।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ'র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ প্রক্রিয়ায় রপ্তানি করে অর্থ না পাওয়ার অভিযোগ তাদের কাছেও মাঝেমধ্যেই আসে। তবে কতজন রপ্তানিকারক এ ধরনের সমস্যায় পড়েছেন, এমন কোন তথ্য নেই তাদের কাছে।
তিনি বলেন, এ ধরনের তথ্য পাঠানোর জন্য সম্প্রতি আমরা সংগঠনের সদস্যদের চিঠি পাঠিয়েছি। বিকেএমইএ'র আরেক সহসভাপতি ও নারায়নগঞ্জের ফতুল্লাহ অ্যাপারেলসের সিইও ফজলে শামীম এহসান বলেন, সেলস কন্ট্রাক্টে রপ্তানির পর তার নিজেরও ৩২ হাজার ডলারের অর্থ দেয়নি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান।
মূলত, তুলনামূক নিরাপদ রপ্তানির মাধ্যম এলসি। কিন্তু এলসি'তে টাকা একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যাংকে রাখতে হয়, এলসির চার্জ গুণতে হয় এবং বেশকিছু নিয়ম মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেই তুলনায় সেলস কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে এমন বাধ্যবাধকতা কম। এলসির ব্যয়ও বেঁচে যায়। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এলসির বাইরে সেলস কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এক সময় পণ্য চালানোর ৯০ শতাংশের বেশি রপ্তানি এলসির মাধ্যমে হলেও, এখন তা অর্ধেকের নিচে নেমেছে। আর সেলস কন্ট্রাক্টে রপ্তানি হয় ৫০ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে কী পরিমাণ রপ্তানি চালান সেলস কন্ট্রাক্টে যাচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব নেই রপ্তানিকারক সংগঠনগুলোর কাছে। তবে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে রপ্তানি চালানের অর্ধেকের বেশিই হচ্ছে সেলস কন্ট্রাক্টে।
অপেক্ষাকৃত ছোট পুঁজির রপ্তানিকারকরা এ প্রক্রিয়ায় রপ্তানি করে থাকেন। তিন ব্যবস্থায় সেলস কন্ট্রাক্টের পণ্য রপ্তানি করা হয়।
বিজিএমইএ'র সাবেক পরিচালক ও টিএডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন বলেন, 'শুরুতে সেলস কন্ট্রাক্ট হওয়ার পর পণ্য পাঠানোর আগে পেমেন্ট নিশ্চিত করা হয়, যা সবচেয়ে নিরাপদ। আরেক ব্যবস্থা হলো পণ্য আমদানিকারকের বন্দরে পৌঁছানোর পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে অর্থ পরিশোধ করার পর বিল অব লেডিং (বিএল) সাবমিট করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুঁকি হলো, আমদানিকারক কোন কারণে টাকা না দিলে, বিএল সাবমিট না হলে ওই পণ্য নিয়ে জটিলতায় পড়েন রপ্তানিকারক। আর তৃতীয় ব্যবস্থা হলো আমদানিকারক টাকা না দিলেও, রপ্তানিকারক পন্য খালাসের অনুমতি দেন, যা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু, বিশ্বস্ত আমদানিকারকের ক্ষেত্রে কোন কোন রপ্তানিকারক এ ঝুঁকি নেন।'
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আলোচ্য রপ্তানিকারকরা এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তারা অর্থ প্রাপ্তির আগেই শিপিং এজেন্টের সহায়তায় বিএল আমদানিকারককে পাঠিয়ে দেন এবং পণ্য খালাসের অনুমতি দেন। বন্দর থেকে পণ্য খালাস করে, এখন লাপাত্তা আমদানিকারক।
এটি ব্যাংকিং নিয়মের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায়, এ অর্থ আদায়ে ব্যাংকেরও কিছু করার থাকে না।
কেন এত ঝুঁকি নেন রপ্তানিকারকরা:
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে অর্ডার ধরতে গিয়ে, অনেক রপ্তানিকারক নতুন আমদানিকারকের ক্ষেত্রেও এমন ঝুঁকি নিয়ে থাকেন। আবার কোন কোন আমদানিকারক দীর্ঘদিন ব্যবসা করে বিশ্বাস তৈরি করে এমন প্রতারণা করে থাকেন।
আবার কখনো কখনো পণ্য জাহাজীকরণের পর কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশের বন্দরে পৌঁছানোর পর, আমদানিকারক এমন আবদার করে থাকেন। তখন ওই পণ্য আনার ক্ষেত্রে বহু প্রক্রিয়া এবং অনেক খরচ রপ্তানিকারকের ওপর পড়ে, যা তার জন্য আর্থিকভাবে সুবিধাজনক হয় না।
পণ্য না আনলে, ওই দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ তা নিলামে তোলে। অর্থাৎ, একবার জাহাজীকরণের পর ওই পণ্য ফেরত আনা রপ্তানিকারকের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, যা ছোট পুঁজির রপ্তানিকারকরা বহন করতে পারেন না।
মোহাম্মদ হাতেম জানান, তার এ ধরনের একটি পণ্য চালান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানির পর, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান অর্থ পরিশোধ না করে পন্য খালাস করতে চাইলে তিনি রাজি হননি। পরবর্তীতে ওই পণ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ নিলামে তোলে। সেখান থেকে তিনি একটি টাকাও পাননি।
তিনি বলেন, এমনও হয়, শিপিং এজেন্টের যোগসাজশে অনেক সময় এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, ক্রেতা প্রতিষ্ঠান নিজস্ব কাউকে দিয়ে এসব পণ্য খালাস করিয়ে নেয়।