পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করায় ক্ষমা চেয়েছেন দুই বিচারক
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করায় হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়েছেন দুই বিচারক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস এবং আতিকুল ইসলাম এই সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করে পৃথক পৃথকভাবে দুটি লিখিত ব্যাখ্যা জমা দিয়েছেন।
এর আগে বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) চিত্রনায়িকা পরীমনিকে তিন দফা রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনায় প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ব্যাখ্যা চান। পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যে তাদের ব্যাখ্যা জমা দিতে বলা হয়েছিল।
হাইকোর্ট বলেছেন, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর আবেদনের শুনানিতে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হলে দুই ম্যাজিস্ট্রেটকে আদালতে হাজির হতে হবে।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট মাদক মামলায় আটক চিত্রনায়িকা পরীমনিকে বারবার রিমান্ডে নেওয়ার বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করে একটি আবেদন করা হয়।
পরে পরীমনিকে বারবার রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে এ সংক্রান্ত নথি ও তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন হাইকোর্ট। ১৫ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফাকেও ১৫ সেপ্টেম্বর (আজ) মামলার নথিসহ (কেস ডকেট) আদালতে হাজির হতে বলা হয়।
গত ৪ আগস্ট বিকেলে বনানীর ১২ নম্বর রোডের পরীমনির বাসায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব। এ সময় বাসা থেকে সাড়ে ১৮ লিটার বিদেশি মদ, চার গ্রাম আইস, এক স্লট এলএসডি এবং একটি পাইপ জব্দ করা হয়। ওই ঘটনায় র্যাব-১ এর কর্মকর্তা মো. মজিবর রহমান মাদক আইনে একটি মামলা করেন।
ওই মামলায় গত ৫ আগস্ট পরীমনিকে চার দিনের ও গত ১০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে পাঠান আদালত। ওই রিমান্ড শেষে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে মামলায় তৃতীয় দফা রিমান্ড আবেদনে গত ১৯ আগস্ট পরীমনির জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
ওই রিমান্ড শেষে গত ২১ আগস্ট আবার পরীমনিকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এরপর মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েস শুনানি শেষে তার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিনের কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছানোর পর পরদিন সকালে ২৭ দিন পর পরীমনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণত আদালতগুলোয় অভিযুক্ত বা অপরাধীকে বেশকিছু বিষয় বিবেচনা করে জামিনের আদেশ দেয়া হয়ে থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬ ও ৪৯৭ ধারায় জামিন বিষয়ে বলা হয়েছে।
জামিন অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি জামিনের অধিকারী নয়, এর অর্থ এটি নয় যে, তার জন্য আর কোন সুযোগ বাকি নেই। জামিন অযোগ্য অপরাধ সত্ত্বেও যদি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের প্রমাণ পাওয়া না যায় তাহলে সে জামিনে মুক্তি পেতে পারে; এমনকি অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ সংঘটনের যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত অতিরিক্ত সুযোগ লাভ করতে পারে যদি সে- নারী, শিশু কিংবা অসুস্থ ব্যক্তি হন।
এর অর্থ দাঁড়ায়, এমনকি একজন অভিযুক্তকেও তার জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এটি সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় অন্যতম মৌলিক নিয়ম।
অন্যদিকে গুরুতর প্রকৃতির অপরাধের ক্ষেত্রেই সাধারণত অভিযুক্তদের দীর্ঘ সময় রিমান্ডে নেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু পরীমনিকে তিন দফায় সাত দিনের মধ্যে প্রথমে চার দিন, দ্বিতীয় দফায় দুই দিন ও তৃতীয় দফায় এক দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। জাতীয় নিরাপত্তা বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই গুরুতর মামলায় আদালতের এত দিনের রিমান্ডের অনুমতি দিতে দেখা যায়।
পরীমনির কাছে ১৮ লিটার মদ এবং এলএসডি পাওয়ার যে অভিযোগ এসেছে তাতে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬ ধারা অনুসারে তিনি জামিনের অধিকারী ছিলেন না। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যে অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল তার সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড- মৃত্যুদণ্ড নয়।
ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৪৯৬ এবং ৪৯৭, সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদকেই তুলে করে যেখানে স্পষ্ট বলা আছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।
সুতরাং, বিবেচনার ক্ষমতা প্রয়োগ করে, বিচারকরা ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার অধীনে পরীমনির জামিন মঞ্জুর করতে পারতেন। পাশাপাশি একজন নারী হওয়ায় তার জামিন পাওয়ার বিশেষ সুযোগ ছিল।
কিন্তু নিম্ন আদালতের বিচারকরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আবেদনে সাড়া দিয়ে তাকে রিমান্ডে পুলিশের হেফাজতে রাখে এবং তার জামিন নামঞ্জুর করে। এমনকি বিচারক শুনানি ছাড়াই তার জামিনের আবেদন ২১ দিন পর্যন্ত মুলতুবি রেখেছিলেন।
২৬ আগস্ট হাইকোর্ট পরীমনির জামিন আবেদনের শুনানির বিলম্বে একটি রুল জারি করেছিলেন এবং শুনানির জন্য ১ সেপ্টেম্বর ধার্য করেছিলেন।
সেই শুনানি বাকি থাকতেই, অবশেষে ৩১ আগস্ট মহানগর দায়রা জজ আদালত পরীমনিকে জামিন প্রদান করেন। পরদিন সকালে তাকে জেল হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।