১৯২০-এর দশকে একজন বাঙালি পর্যটকের চোখে কাবুল
কাবুলের দুই নম্বর দ্রষ্টব্য তার বাজার। অমৃতসর, আগ্রা, কাশীর পুরোনো বাজার যাঁরা দেখেছেন, এ বাজারের গঠন তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না। সরু রাস্তা, দুদিকে বুক-উঁচু ছোট ছোট খোপ। পানের দোকানের দুই বা তিন-ডবল সাইজ। দোকানের সামনের দিকটা খোলা বাক্সের ঢাকনার মত এগিয়ে এসে রাস্তার খানিকটা দখল করেছে। কোনো কোনো দোকানের বাক্সের ডালার মত কব্জা লাগানো, রাত্রে তুলে দিয়ে দোকানে নিচের আধখানা বন্ধ করা যায়- অনেকটা ইংরেজীতে যাকে বলে 'পুটিঙ আপ দি শাটার'।
বুকের নিচ থেকে রাস্তা অবধি কিংবা তারো কিছু নিচে দোকানেরই একতলা গুদাম ঘর, অথবা মুচির দোকান। কাবুলের যে কোনো বাজারে শতকরা ত্রিশটি দোকান মুচির। পেশাওয়ারের পাঠানরা যদি হপ্তায় একদিন জুতোতে লোহা পোঁতায়, তবে কাবুলে তিন দিন। বেশীরভাগ লোকেরই কাজকর্ম নেই- কোনো একটা দোকানে লাফ দিয়ে উঠে বসে দোকানীর সঙ্গে আড্ডা জমায়, ততক্ষণ নিচের অথবা সামনের দোকানের একতলায় মুচি পয়জারে গোটা কয়েক লোহা ঠুকে দেয়।
আপনি হয়তো ভাবছেন যে, দোকানে বসলে কিছু একটা কিনতে হয়। আদপেই না। জিনিসপত্র বেচার জন্য কাবুলী দোকানদার মোটেই ব্যস্ত নয়...
সুখদুঃখের নানা কথা হবে-কিন্তু পলিটিক্স ছাড়া। তাও হবে, তবে তার জন্য দোস্তি ভালো করে জমিয়ে নিতে হয়। কাবুলের বাজার ভয়ঙ্কর ধূর্ত- তিনদিন যেতে না যেতেই তামাম বাজার জেনে যাবে আপনি ব্রিটিশ লিগেশনে ঘন ঘন যাতায়াত করেন কি না- ভারতবাসীর পক্ষে রাশিয়ান দূতাবাস অথবা আফগান ফরেন আপিসের গোয়েন্দা হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। যখন দোকানী জানতে পারে যে, আপনি হাই-পলিটিক্স নিয়ে বিপজ্জনক জায়গায় খেলাধুলা করেন না, তখন আপনাকে 'বাজার গপ্' বলতে তার আর বাধবে না...
আফগানিস্তানের ব্যাঙ্কিং এখনো বেশীরভাগ ভারতীয় হিন্দুদের হাতে। ভারতীয় বলা হয়ত ভুল, কারণ এদের প্রায় সকলেই আফগানিস্তানের প্রজ্ঞা। এদের জীবন যাত্রার প্রণালী, সামাজিক সংগঠন, পালাপরব সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত কেউ গবেষণা করেনি।
আশ্চর্য বোধ হয়। মরা বোরোবোদুর নিয়ে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ পড়ে, একই ফোটোগ্রাফের বিশখানা হাজা-ভোঁতা প্রিণ্ট দেখে সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায়, কিন্তু এই জ্যান্ত ভারতীয় উপনিবেশ সম্বন্ধে 'বৃহত্তর ভারতের' পান্ডাদের কোনো অনুসন্ধিৎসা কোনো আত্মীয়তা-বোধ নেই।
কাবুলের বাজার পেশাওয়ারের চেয়ে অনেক গরীব, কিন্তু অনেক বেশী রঙীন। কম করে অন্তত পঁচিশটা জাতের লোক আপন আপন বেশভূষা চালচলন বজায় রেখে কাবুলের বাজারে বেচাকেনা করে। হাজারা, উজবেগ (বাংলা উজবুক), কাফিরি-স্থানী, কিজিলবাশ (ভারতচন্দ্রের কিজিলবাসের উল্লেখ আছে, আর টীকাকার তার অর্থ করেছেন 'একরকম পর্দা'!) মঙ্গোল, কুর্দ এদের পাগড়ি, টুপি, পুস্তিনের জোব্বা, রাইডিং বুট দেখে কাবুলের দোকানদার এক মুহূর্তে এদের দেশ, ব্যবসা, মুনাফার হার, কঞ্জুশ না দরাজ-হাত চট করে বলে দিতে পারে।
এই সব পার্থক্য স্বীকার করে নিয়ে তারা নির্বিকার চিত্তে রাস্তা দিয়ে চলে। আমরা মাড়োয়ারী কিংবা পাঞ্জাবীর সঙ্গে লেনদেন করার সময় কিছুতেই ভুলতে পারি না যে, তারা বাঙালী নয়- দু'পয়সা লাভ করার পর কোনো পক্ষই অন্য পক্ষকে নেমন্তন্ন করে বাড়িতে নিয়ে খাওয়ানো তো দূরের কথা, হোটেলে ডেকে নেওয়ার রেওয়াজ পর্যন্ত নেই। এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ অঙ্গাঙ্গি বিজড়িত।
স্বপ্নসম লোকযাত্রা। খাস কাবুলের বাসিন্দারা চিৎকার করে একে অন্যকে আল্লারসুলের ভয়ডর দেখিয়ে সওদা করছে, বিদেশীরা খচ্চর গাধা ঘোড়ার পিঠে বসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফার্সীতে দরকসর করছে, বুখারার বড় বড় কারবারিরা ধীরে গম্ভীরে দোকানে ঢুকে এমনভাবে আসন নিচ্ছেন যে, মনে হয় বাকী দিনটা ঐখানেই বেচাকেনা, চা-তামাক-পান আর আহারাদি করে রাত্রে সরাইয়ে ফিরবেন- তার পিছনে চাকর হুঁকো-কল্কি সঙ্গে নিয়ে ঢুকছে। তারও পিছনে খচ্চর-বোঝাই বিদেশী কার্পেট। আপনি উঠি উঠি করছিলেন, দোকানদার কিছুতেই ছাড়বে না। হয়ত মোটা রকমের ব্যবসা হবে, খুদা মেহেরবান, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর রসুলেরও আশীর্বাদ রয়েছে, আপনারও যখন ভয়ঙ্কর তাড়া নেই, তখন দাওয়াতটা খেয়ে গেলেই পারেন।
রাস্তায় অনেক অকেজো ছেলে-ছোকরা ঘুরাঘুরি করছে- তাদেরই একটাকে ডেকে বলবে, 'ও বাচ্চা, চাওয়ালাকে বলতো আরেক প্রস্থ চা দিয়ে যেতে।'
তারপর সেই সব কার্পেটের বস্তা খোলা হবে। কত রঙ, কত চিত্রবিচিত্র নক্সা, কী মোলায়েম স্পর্শসুখ। কার্পেট-শাস্ত্র অগাধ শাস্ত্র- তার কূল-কিনারাও নেই। কাবুলের বাজারে অন্তত ত্রিশ জাতের কার্পেট বিক্রি হয়, তাদের আবার নিজ জাতের ভিতরে বহু গোত্র, বহু বর্ণ। জন্মভূমি, রঙ, নক্সা, মিলিয়ে সরেস নিরেস মালের বাছ-বিচার হয়। বিশেষ রঙের নক্সা বিশেষ উৎকৃষ্ট পশম দিয়ে তৈরি হয়- সে মালের সস্তা জিনিস হয় না। এককালে বেনারসী শাড়িতে এই ঐতিহ্য ছিল- আড়িবেল শাড়ির বিশেষ নক্সা বিশেষ উৎকৃষ্ট রেশমই হত- সে নক্সায় নিরেস মাল দিয়ে ঠকাবার চেষ্টা ছিল না।
আজকের দিনে কাবুলের বাজারে কেনবার মত তিনটে ভালো জিনিস আছে- কার্পেট, পুস্তিন আর সিল্ক। ছোটখাটো জিনিসের ভিতর ধাতুর সামোভার আর জড়োয়া পয়জার। বাদ-বাকি বিলাতী আর জাপানী কলের তৈরী সস্তা মাল, ভারতবর্ষ হয়ে আফগানিস্তানে ঢুকেছে।
কাবুলের বাজার ক্রমেই গরীব হয়ে আসছে। তার প্রধান কারণ ইরান ও রুশের নবজাগরণ। আমুদরিয়ার ওপারের মালে বাঁধ দিয়ে রাশানরা তার স্রোত মস্কোর দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে, ইরানীরা তাদের মাল সোজাসুজি ইংরেজ অথবা রাশানকে বিক্রি করে। কাবুলের পয়সা কমে গিয়েছে বলে সে ভারতের মাল আর সে পরিমাণে কিনতে পারে না- আমাদের রেশম মলমল মসলিন শিল্পেরও কিছু মরমর, বেশীরভাগ ইংরেজ সাত হাত মাটির নিচে কবর দিয়ে শ্রাদ্ধশান্তি করে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
বাবুর বাদশা কাবুলের বাজার দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। বহু জাতের ভিড়ে কান পেতে যে-সব ভাষা শুনেছিলেন, তার একটা ফিরিস্তিও তাঁর আত্মজীবনীতে দিয়েছেন:
আরবী, ফার্সী, তুর্কী্, মোগলী, হিন্দী, আফগানী, পশাঈ, প্রাচী, গেবেরী, বেরেকী ও লাগমানী।
'প্রাচী' হল পূর্ব-ভারতবর্ষের ভাষা, অযোধ্যা অঞ্চলের পূরবীয়া- বাঙলা ভাষা তারই আওতায় পড়ে।
সে সব দিন গেছে; তামাম কাবুলে এখন যুক্তপ্রদেশের তিনজন লোকও আছে কিনা সন্দেহ।
তবু প্রাণ আছে, আনন্দ আছে। বাজারের শেষ প্রান্তে প্রকাণ্ড সরাই। সেখানে সন্ধ্যার নমাজের পর সমস্ত মধ্যপ্রাচ্য কাজকর্মে ইস্তফা দিয়ে বেঁচে থাকার মূল চৈতন্যবোধকে পঞ্চেন্দ্রিয়ের রসগ্রহণ দিয়ে চাঙ্গা করে তোলে। মঙ্গোলরা পিঠে বন্দুক ঝুলিয়ে, ভারী রাইডিং বুট পরে, বাবরী চুলে ঢেউ খেলিয়ে গোল হয়ে সরাই-চত্বরে নাচতে আরম্ভ করে।
বুটের ধমক, তালে তালে হাততালি আর সঙ্গে সঙ্গে কাবুল শহরের চতুর্দিকের পাহাড় প্রতিধ্বনিত করে তীব্র কন্ঠে আমুদরিয়া-পারের মঙ্গোল সঙ্গীত...
আবার এই সমস্ত হট্টগোল উপেক্ষা করে দেখবেন, সরাইয়ের এক কোণে কোন ইরানী কানের কাছে সেতার রেখে মোলায়েম বাজনার সঙ্গে হাফিজের গজল গাইছে। আর পাঁচজন চোখ বন্ধ করে বুঁদ হয়ে দূর ইরানের গুল বুলবুল আর নিঠুরা নিদয়া প্রিয়ার ছবি মনে মনে এঁকে নিচ্ছে।
আরেক কোণে পীর-দরবেশ চায়ের মজলিসের মাঝখানে দেশ-বিদেশের ভ্রমণকাহিনী, মেশেদ-কারবালা, মক্কা-মদিনার তীর্থের গল্প বলে যাচ্ছেন। কান পেতে সবাই শুনছে...
চার সর্দারজীতে মিলে একটা পুরনো নখের মতো পালিশ তিনখানা রেকর্ড ঘুরিয়ে বাজাচ্ছে-
হরদি বোতলাঁ
ভরদি বোতলাঁ
পাঞ্জাবী বোতলাঁ
লাল বোতলাঁ
হায়, কাবুলে বোতল বারণ। কে জানত, শ্রবণেও অর্ধপান!
কাবুলের সামাজিক জীবন তিন হিস্যায় বিভক্ত। তিন শরিকে মুখ দেখাদেখি নেই।
পয়লা শরিক খাস কাবুলী; সেও আবার দু'ভাগে বিভক্ত- জনানা, মর্দনা। কাবুলী মেয়েরা কট্টর পর্দার আড়ালে থাকেন, তাদের সঙ্গে নিকট আত্মীয় ছাড়া, দেশী-বিদেশী কারো আলাপ হওয়ার জো নেই। পুরুষের ভিতরে আবার দু'ভাগ। একদিকে প্রাচীন ঐতিহ্যের মোল্লা সম্প্রদায়, আর অন্যদিকে প্যারিস-বার্লিন-মস্কো ফের্তা এবং তাদের ইয়ারবক্সীতে মেশানো ইয়োরোপীয় ছাঁচে ঢালা তরুণ সম্প্রদায়। একে অপরকে অবজ্ঞা করেন, কিন্তু মুখ দেখাদেখি বন্ধ নয়। কারণ অনেক পরিবারেই বাপ মশাই, বেটা মসিয়ো।
দুসরা শরীক ভারতীয় অর্থাৎ পাঞ্জাব ফ্রন্টিয়ারের মুসলমান ও ১৯২১ সনের খেলাফৎ আন্দোলনের ভারতত্যাগী মুহাজিরগণ। এঁদের কেউ কেউ কাবুলী মেয়ে বিয়ে করেছেন বলে শ্বশুরবাড়ির সমাজের সঙ্গে এঁরা কিছু যোগাযোগ বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তিসরা শরীক ইংরেজ, ফরাসী, জর্মন, রুশ ইত্যাদি রাজদূতাবাস। আফগানিস্তান ক্ষুদে গরীব দেশ। সেখানে এতগুলো রাজদূতের ভিড় লাগাবার কোনো অর্থনৈতিক কারণ নেই, কিন্তু রাজনৈতিক কারণ বিস্তর। ফরাসী জর্মন তুর্ক সব সরকারের দৃঢ়বিশ্বাস, ইংরেজ-রুশের মোষের লড়াই একদিন হয় খাইবার-পাসে, নয় হিন্দুকুশে লাগবেই লাগবে। তাই দু'দলের পাঁয়তারা কষার খবর সরজমিনে রাখার জন্য একগাদা রাজদূতাবাস।
তবু পয়লা শরিক আর দুসরা শরিকে দেখা-সাক্ষাত, কথাবার্তা হয়। দুসরা শরিকের অধিকাংশই হয় কারবারি, নয় মাস্টার প্রোফেসর। দু'দলের সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকা অসম্ভব। কিন্তু পয়লা ও তেসরা ও দুসরা-তেসরাতে কখনো কোনো অবস্থাতেই যোগাযোগ হতে পারে না।
যদি কেউ করার চেষ্টা করে, তবে সে স্পাই।
-
সূত্র: ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে' বই থেকে নেওয়া