হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা: কে ছিলেন পঞ্জি
১৯২০-এর দশকের আমেরিকা। বোস্টনে হইচই ফেলে দিয়েছেন এক ইটালিয়ান অভিবাসী। নাম তাঁর চার্লস পঞ্জি। 'সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি' নামক এক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি। তাঁকে নিয়ে হইচইয়ের কারণ, বিনিয়োগকারীরা হামলে পড়েছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে। চার্লস পঞ্জি যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তাঁর বাঁশির সুরে বিমোহিত হয়ে পঙ্গপালের মতো ছুটে এসেছেন সহস্র বিনিয়োগকারী।
চার্লস পঞ্জির মুখে বাঁশির সুরের জায়গায় ছিল মুনাফার প্রস্তাব। তাঁর কোম্পানি অভাবনীয় মুনাফার প্রস্তাব দিচ্ছিল বিনিয়োগকারীদের। কী সেই প্রস্তাব?
সে সময় বিভিন্ন দেশের ডাক বিভাগ চিঠিপত্র বিনিময়ের জন্য নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক কুপন ব্যবহার করত। এসব কুপনের স্থানীয় মুদ্রামান একই থাকত- তবে মুদ্রার বিনিময়মূল্যের ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় অন্য দেশে আন্তর্জাতিক কুপনের মানও বাড়ত-কমত। এসব কুপনের বিনিময়ে ডাকটিকিট নেওয়ার সুযোগ ছিল। পরে একসময় দেশে দেশে ডাকটিকিটের দামও ওঠা-নামা করতে শুরু করে। চার্লস পঞ্জি প্রথমে এ সুযোগটাই নেন।
ইউরোপে কিছু এজেন্ট নিয়োগ করেন তিনি। তাদের দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এসব কুপন কম মূল্যমানের মুদ্রায় কিনে নিতেন। সস্তায় কেনা এসব কুপনের সঙ্গে তিনি দামি ডাকটিকিট বিনিময় শুরু করেন। এই দুই মূল্যের ব্যবধানের ফলে মোটা অঙ্কের মুনাফা পকেটে ভরতেন পঞ্জি। এই মুনাফার জন্য বিনিয়োগকারীরাও তাঁর কোম্পানিতে অর্থ লগ্নি করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
সে সময় ব্যাংকে টাকা রাখলে বার্ষিক মুনাফা মিলত ৫ শতাংশ। সে জায়গায় পঞ্জির কোম্পানিতে আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে ৪০-৫০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত আইনের মধ্যেই ছিলেন পঞ্জি। কিন্তু একপর্যায়ে লোভ বাড়তে থাকে তাঁর। এবার বড় দাঁও মারার জন্য বড় মতলব আঁটলেন ৫ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার ধুরন্ধর চার্লস পঞ্জি। 'সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানি' নামে প্রতিষ্ঠান খুলে বসলেন। এই কোম্পানির কার্যক্রম এমনভাবে উপস্থাপন করলেন, যাতে দেখে সবার মনে হলো এখানে বিনিয়োগ করলে স্বল্প সময়ের মধ্যে মোটা মুনাফা পাওয়া সম্ভব।
আসল ঘটনা হলো, এ কোম্পানিতে পঞ্জির নিজের বিনিয়োগ ছিল একেবারেই কম। তিনি আসলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাই নানাভাবে ফের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন, যাতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই স্কিমের মাধ্যমে সত্যিই ভালো মুনাফা করা যায়। অর্থাৎ চার্লস পঞ্জি আজকের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা গতকালের বিনিয়োগকারীদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করতেন।
সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির আন্তর্জাতিক কুপন কিনলে মাত্র ৪৫ দিনে ৫০ শতাংশ এবং ৯০ দিনে ১০০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন পঞ্জি বিনিয়োগকারীদের।
প্রথম দিকে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা ঠিকমতোই দেওয়া হতো। সে জন্য পঞ্জির ওপর বিশ্বাস এসে পড়ে সবার। কাজেই লোকে তাঁর স্কিমে বিনিয়োগ করার জন্য হামলে পড়ে।
কিন্তু আসল ঘটনা হলো, এই কোম্পানিতে পঞ্জির নিজের বিনিয়োগ ছিল একেবারেই কম। তিনি আসলে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাই নানাভাবে ফের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন, যাতে তাঁরা বিশ্বাস করেন যে এই স্কিমের মাধ্যমে সত্যিই ভালো মুনাফা করা যায়। অর্থাৎ চার্লস পঞ্জি আজকের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা গতকালের বিনিয়োগকারীদের ঋণ পরিশোধে ব্যবহার করতেন।
হুড়মুড় করে লোকে পঞ্জির স্কিমে বিনিয়োগ করতে থাকেন। হাজার হাজার বিনিয়োগকারীর মধ্যে পঞ্জি এমন বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেন যে তিনি তাঁদের সহজে অর্থ উপার্জনের উপায় বাতলে দিচ্ছেন। এভাবে তিনি আট মাসে নিজের পকেটে ঢোকান দেড় কোটি ডলার।
কিন্তু এরপরই তাঁর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখালেখি শুরু হয় পত্রপত্রিকায়। তার জেরে তদন্তে নামে মার্কিন আইনরক্ষা বাহিনী। তদন্তে বেরিয়ে আসে পঞ্জির স্কিম একটা ফাঁপা বেলুন--এতে আসলে কোনো বিনিয়োগ নেই। ১৯২০ সালের ১২ আগস্ট গ্রেপ্তার হন তিনি।
সেই থেকে এ ধরনের আর্থিক প্রতারণামূলক কর্মকা-কে ডাকা হতে থাকে পঞ্জি স্কিম নামে। এই স্কিমের নামকরণ চার্লস পঞ্জির নামে করা হলেও এ রকম প্রতারণামূলক কর্মকা-ের জনক কিন্তু তিনি নন। তাঁর আগেও বেশ কয়েকজন এ রকম প্রতারণা করেছেন। ১৮৭৯ সালে সারাহ হাউই প্রথম এ ধরনের স্কিম চালু করেন। এ ছাড়া চার্লস ডিকেন্সের উনিশ শতকের কয়েকটি উপন্যাসেও এ রকম স্কিমের উল্লেখ আছে।
পঞ্জি স্কিমের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
পঞ্জি স্কিমের উদ্দেশ্য একটাই- প্রথমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা, তারপর তাঁদের পুরো বিনিয়োগ আত্মসাৎ করা। এখানে বিনিয়োগকারীদের সামান্য বিনিয়োগের বিপরীতে বিশাল অঙ্কের লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নতুন বিনিয়োগকারীদের থেকে আদায় করা টাকা থেকেই পুরোনো বিনিয়োগকারীদের টাকা দেওয়া হয়। অর্থের প্রবাহ যতক্ষণ চলে, এই চক্রও ততক্ষণ চলে।
এই স্কিমে কোনো প্রকৃত পণ্য, সেবা বা ব্যবসায়িক কাঠামো থাকে না। পঞ্জি স্কিমের কাঠামো সাধারণত পিরামিড আকৃতির হয়। এ পিরামিডের একেবারে চূড়ায় থাকে মূল পরিকল্পনাকারী, অর্থাৎ স্কিমের হোতা। এরপর থাকে প্রাথমিক সদস্যরা। এই প্রাথমিক সদস্যরা নতুন সদস্য সংগ্রহ করেন। এভাবে পুরোনো সদস্যের মাধ্যমে নতুন সদস্য সংগ্রহ চলতে থাকে। এই পিরামিডের যত নিচের দিকে নামবেন, এর আকার তত বাড়বে- অর্থাৎ সদস্য বাড়বে। কিন্তু একসময় সদস্য বৃদ্ধির হার কমে আসতে থাকে। ধীরে ধীরে নতুন সদস্য আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। ওই পর্যায়ে পঞ্জি স্কিম ভেঙে পড়তে শুরু করে। এ সময় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগকারীদের টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যান। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ফেরত পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। পঞ্জি স্কিমের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। কারণ, এই শ্রেণির মানুষেরা কম ঝুঁকিতে দ্রুত ধনী হতে চান বেশি।
নানা সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে পঞ্জি স্কিম চালানো হলেও সব পঞ্জি স্কিমেরই কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন ১. অল্প বিনিয়োগে বিশাল মুনাফার আশ্বাস, ২. আয়ের প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনার স্পষ্ট না করা, ৩. অতিরিক্ত ধারাবাহিক রিটার্ন, ৪. অনিবন্ধিত বিনিয়োগ ৫. প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের টাকা বিশাল মুনাফাসহ ফেরত দিয়ে তাঁদের আরও বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা।
সত্যি বলতে কী, ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যেকোনো স্কিম নিয়েই সন্দেহের অবকাশ থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, অস্বাভাবিক রিটার্ন বা স্বল্প সময়ে বিনিয়োগের পরিমাণ দ্বিগুণ-তিন গুণ করার প্রতিশ্রুতিই পঞ্জি স্কিমের মূল বৈশিষ্ট্য। পঞ্জি স্কিমগুলো ধারাবাহিকভাবে মোটা মুনাফার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলার জন্য প্রতারক প্রথমে প্রতিশ্রুতি রাখেন। বিনিয়োগকারীরা তহবিলের প্রবাহ টিকিয়ে রাখার জন্য আত্মীয়-বন্ধুদের স্কিমের আওতায় আনতেই আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ে প্রতারকদের।
সব পঞ্জি স্কিমেরই কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন ১. অল্প বিনিয়োগে বিশাল মুনাফার আশ্বাস, ২. আয়ের প্রবৃদ্ধি ও ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনার স্পষ্ট না করা, ৩. অতিরিক্ত ধারাবাহিক রিটার্ন, ৪. অনিবন্ধিত বিনিয়োগ ৫. প্রাথমিক বিনিয়োগকারীদের টাকা বিশাল মুনাফাসহ ফেরত দিয়ে তাঁদের আরও বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করা।
আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিমগুলো
এবার জেনে নেওয়া যাক আধুনিক ইতিহাসের দুনিয়া কাঁপানো কিছু পঞ্জি স্কিম সম্পর্কে।
মানিট্রন স্কিম- ১৯৯১
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৮৬ কোটি ডলার
অর্থনীতির ছাত্র জাঁ-পিয়েরে ভ্যান রোসেম নিজেও অর্থনীতিবিদ। তাঁর বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান মানিট্রন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই স্কিম চালান রোসেম। নিজের অর্থনীতির ব্যাকগ্রাউন্ড কাজে লাগিয়ে তিনি 'স্টক মার্কেট গুরু' হিসেবে সুনাম কুড়িয়ে নেন।
মানিট্রন দাবি করত তারা একটা কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে বাজারের অবস্থার কথা বলে দিতে পারে। এর ফলে বহু গ্রাহক আকৃষ্ট হয় কোম্পানিটায় বিনিয়োগ করতে। ভ্যান রোসেমের গ্রাহকদের মধ্যে বেলজিয়ান রাজপরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
কিছুদিন বেশ নির্বিঘেœই চলে মানিট্রনের স্কিম। কিন্তু কদিন পর বিনিয়োগকারীদের যেসব চেক দিয়েছিলেন, সেগুলো একের পর এক বাউন্স করতে থাকলে মানিট্রন ভেঙে পড়ে। এরপরই গ্রেপ্তার হন ভ্যান রোসেম।
১৯৯১ সালে প্রতারণার দায়ে রোসেমকে ৫ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। কারাবাস এড়ানোর জন্য তিনি রাজনীতিতে ঢুকে পড়েন। তাঁর এ কৌশল কাজেও লেগে যায়। কয়েক বছর বেলজিয়ামের সংসদে দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
উল্লেখ্য ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ফর্মুলা ১ রেসিং টিম অনিক্স গ্র্যান্ড প্রিক্সের অন্যতম মালিক ছিলেন ভ্যান রোসেম।
কারিতাস স্ক্যাম- ১৯৯৪
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ১০০-৫০০ কোটি ডলার
অ্যাকাউন্টেন্ট ইয়োয়ান স্টয়কা এই স্কিমের হোতা। এ স্কিম ছাড়া হয় দারিদ্র্যপীড়িত রোমানিয়ানদের টার্গেট করে। স্টয়কা আমানতকারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ৩ মাসের মধ্যে তাঁদের ৮০০ শতাংশ রিটার্ন দেওয়া হবে। ৩০ লাখ রোমানিয়ান এই স্কিমের ফাঁদে পা দেন। লোকের মনে বিশ্বাস তৈরির জন্য কারিতাস নিয়মিত স্থানীয় পত্রিকায় বিজয়ীদের তালিকা প্রকাশ করত।
কিন্তু ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে বিজয়ীদের টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয় কারিতাস। এর কদিন পরই মানুষ জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি ৪৫ কোটি ডলার দেনায় আছে।
১৯৯৪ সালে স্টয়কাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতারণার অপরাধে ৭ বছরের কারাদ- দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু দুবার আপিলের পর তাঁর শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে মাত্র দেড় বছর করা হয়।
এমএমএম- ১৯৯৪
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ১ হাজার কোটি ডলার
রাশান নাগরিক সার্জেই মাভরোদি এমএমএম প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৮৯ সালে। প্রথমে কোম্পানিটি খোলা হয়েছিল ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক হিসেবে। তবে মাভরোদি আর্থিক প্রতারণা শুরু করেন আরও বছর পাঁচেক পর, ১৯৯৪ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে এমএমএম তাদের প্রথম রাউন্ড শেয়ার ছাড়ে। প্রতিটা শেয়ারের দাম ছিল ০.৬৫ ডলার। গ্রাহকদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এমএমএমের শেয়ার কিনলে বার্ষিক ১০০০% মুনাফা দেওয়া হবে। কিন্তু এক বছর পরই শেয়ারের দাম বেড়ে ৮১ ডলার হয়ে যায়।
প্রতারণা ব্যবসা তুঙ্গে থাকার সময় এমএমএম তাদের নিজস্ব মুদ্রাও বাজারে ছেড়েছিল। এ মুদ্রার নাম দিয়েছিল 'এমএমএম কুপন'।
প্রায় এক কোটি রাশান মাভরোদির এই স্ক্যামের শিকার হন। সঞ্চয়ের প্রায় সবটুকু টাকা এমএমএমে বিনিয়োগ করেছিলেন তাঁরা। প্রতারিত হওয়া অনেকেরই বিনিয়োগ সম্পর্কে কোনো পূর্বধারণা ছিল না। কর্তৃপক্ষ অবশেষে ২০০৩ সালে কর ফাঁকির দায়ে মাভরোদিকে গ্রেপ্তার করে।
তদন্ত চলাকালীন মাভরোদি সংসদ সদস্য হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন। বিচারে তাঁর মাত্র চার বছরের জেল হয়।
২০১১ সালে এমএমএম ফের চালু হয়। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে এমএম গ্লোবাল নামে 'সামাজিক আর্থিক নেটওয়ার্ক' হিসেবে কার্যক্রম চালাচ্ছে।
গ্রেট মিনিস্ট্রিজ ইন্টারন্যাশনাল- ১৯৯৭
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৫০ কোটি ডলার
ফ্লোরিডাভিত্তিক গ্রেট মিনিস্ট্রিজ ইন্টারন্যাশনাল (জিএমআই) চার বছর ধরে পঞ্জি স্কিম চালায়। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা জেরাল্ড মিনিস্টার পেইন বাইবেলের বাণীর আড়ালে এই প্রতারণা চালিয়ে যেতেন। গির্জার সদস্যদের তিনি প্রতিশ্রুতি দিতেন, তাঁরা যদি বিনিয়োগ করেন, তাহলে দ্বিগুণ 'আশীর্বাদ' ফেরত পাবেন।
সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ঝামেলা বাধল, যখন জিএমআইয়ের কিছু সিনিয়র সদস্য পৃথক স্কিম চালানোর জন্য গ্রেপ্তার হন। এর কিছুদিন পরই জিএমআইয়ের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে কর্তৃপক্ষ। ফলে অর্থসংকটে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি।
পেইনকে ২৭ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। যদিও তিনি দাবি করেছিলেন ধর্মীয় সংগঠনের ওপর খবরদারি করার অধিকার মার্কিন সরকারের নেই।
পিটারস গ্রুপ ওয়ার্ল্ডওয়াইড স্কিম- ২০০৩
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৩৬০ কোটি ডলার
এই স্কিমের হোতা টম পিটারস। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত মিনেসোটাভিত্তিক পিটারস গ্রুপ ওয়ার্ল্ডওয়াইড (পিডব্লিউআই) নিজেদের ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বিক্রেতা হিসেবে পরিচয় দিত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পিডব্লিউআই ভুয়া ক্রয়াদেশ ও স্টেটমেন্ট দেখিয়ে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ মূলধন জোগাড় করেছিল। কিছু টাকা প্রথমদিকের অল্পসংখ্যক বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়, বাকি টাকা যায় পিটারস আর তাঁর সহযোগীদের পকেটে।
পিডব্লিউআইয়ের পঞ্জি স্কিম তহবিলের টাকা পোলারয়েডের মতো কোম্পানি কিনে নিতে ব্যবহার করা হতো। এসব ব্যবসায়িক লেনদেনের প্রচারণা চালানো হতো পিটারসের নিজস্ব ম্যাগাজিনের মাধ্যমে।
২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে পিডব্লিউআইয়ের এক কর্মী এই পঞ্জি স্কিমে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। পিডব্লিউআইয়ের ক্রয়াদেশগুলো যে ভুয়া, সে কথা স্বীকার করে দেওয়া পিটারসের একটা বক্তব্যের রেকর্ডিংও প্রমাণ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেন তিনি।
২০১০ সালের এপ্রিলে পিটারসকে মেইল ও তারবার্তা জালিয়াতি এবং অর্থপাচারের অপরাধে ৫০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়।
ম্যাডফ স্কিম- ২০০৮
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলার
পঞ্জি স্কিম নিয়ে আলোচনা হবে, আর বার্নি ম্যাডফের নাম আসবে না, তা অসম্ভব।
ম্যাডফের জন নিউইয়র্কের কুইন্সে এক ইহুদি পরিবারে। বাবা র্যালফ ম্যাডফ ছিলেন স্টক ব্রোকার, মিস্ত্রির কাজও করতেন। বার্নি ম্যাডফ প্রথমে আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দ্বিতীয় বর্ষে সেখান থেকে চলে যান হফস্ত্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করেন।
কর্মজীবনে ম্যাডফ ছিলেন ওয়াল স্ট্রিটের পোড় খাওয়া স্টক ব্রোকার এবং এনএএসডিএকিউ-এর চেয়ারম্যান। ১৯৯১ সালে তাঁর হাত ধরে সংঘটিত হয় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পঞ্জি স্কিম।
এনএএসডিএকিউ নামের এই ভুয়া প্রতিষ্ঠান চালু হয় ১৯৬০ সালে। ম্যাডফ বিনিয়োগকারীদের প্রতিশ্রুতি দিতেন, এনএএসডিএকিউতে বিনিয়োগ করলে, বাজারের অবস্থা যেমনই থাকুক না কেন, দুই অঙ্কের রিটার্ন দেওয়া হবে।
বহুদিন ধরে ম্যাডফ তাঁর পঞ্জি স্কিম চালিয়ে গেছেন কারও মনে কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করে। তিনি অল্প সময়ে অবিশ্বাস্য রিটার্নের প্রতিশ্রুতি দিতেন না বলে তাঁকে কেউ সন্দেহ করেনি। তিনি শুধু বছরে এফডিআরের চেয়ে সামান্য বেশি রিটার্ন দেখাচ্ছিলেন।
কিন্তু ম্যাডফের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল বাজারের ভালো-মন্দ সব অবস্থাতেই মুনাফা দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২০০৮ সালে ধসের সময় এসে জানা গেল, আদতে ম্যাডফ গ্রাহকের একটা টাকাও কোনো শেয়ারে বিনিয়োগ করেননি। সব টাকা তিনি ব্যাংকে রেখে দিতেন। চার্লস পঞ্জির মতো তিনিও শুধু নতুন গ্রাহকদের টাকায় পুরোনো গ্রাহকদের রিটার্ন দিতেন।
মজার ব্যাপার হলো, ম্যাডফ যার-তার কাছ থেকে বিনিয়োগ নিতেন না। বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য ম্যাডফের পরিচিত কারও সুপারিশ লাগত। ঝামেলা এড়াতেই তিনি গ্রাহকসংখ্যা সীমিত রাখতেন। কম ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বড় তহবিল নিয়ে এগোনোই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। ম্যাডফের গ্রাহক বেশি ছিল ধনী ইহুদি সমাজে।
ধরা পড়ার সময় ম্যাডফের স্কিমে মানুষের মূলধন জমা ছিল প্রায় ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার।
ম্যাডফকে ১১টি ফেডারেল অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারে তাঁকে ১৫০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। ২০০৮ সালের শেষদিকে এই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার সময় তাঁর গ্রাহকসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার ৮০০ জন।
স্ট্যানফোর্ড ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ- ২০১২
আত্মসাৎ করা অর্থের পরিমাণ: ৭০০ কোটি ডলার
স্ট্যানফোর্ড ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ ছিল ক্যারিবিয়ানভিত্তিক কোম্পানি। এর প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা ও অ্যান্টিগার দ্বৈত নাগরিক অ্যালেন স্ট্যানফোর্ড। তাঁর কোম্পানি আমানতের সনদপত্র বিক্রি করত এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে অনেক বেশি রিটার্ন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিত।
বিনিয়োগকারীদের টাকা দিয়ে স্ট্যানফোর্ড বিলাসবহুল জীবন যাপন করতেন। অ্যান্টিগায় তাঁর সদর দপ্তর ছিল প্রাসাদোপম। অ্যান্টিগার অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য দেশটি ২০০৬ সালে তাঁকে নাইট উপাধি দেয়।
কিন্তু ২০০৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ধরা পড়েন। বিচারে তাঁর ১১০ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। স্ট্যানফোর্ডের ১৮ হাজার গ্রাহক আজও তাঁদের বিনিয়োগের টাকা ফেরত পাননি।