ক্যামেরা-ট্র্যাপ জরিপে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিরল প্রজাতির বহুরূপী বন্য বিড়ালের সন্ধান
জনশ্রুতি আছে, বিড়াল নয়বার জীবন ধারণ করতে পারে! কিন্তু একটি বিড়াল কত রকমের বর্ণ ধারণ করতে পারে?
শুনে অবাক হবেন, বহুরূপী বন্য বিড়াল আমাদের দেশেও পাওয়া গেছে।
এই প্রতিবেদনে একটি মাঝারি আকারের বন্য বিড়াল সম্বন্ধে জানব আমরা, যেটিকে 'এশীয় সোনালি বিড়াল' নামে ডাকা হয়।
নাম শুনেই হয়তো বুঝতে পারছেন, রহস্যময় এই বিড়ালের গাত্রবর্ণ কমলা-সোনালি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আরও পাঁচ ধরনের রঙ ধারণ করতে পারে এই বিড়াল। প্রত্যেকটি রঙই একটি অপরটির চেয়ে আলাদা।
ব্যাপারটি শুরুতে এতই বিভ্রান্তিকর ছিল, বিজ্ঞানীরা প্রথমে এক বিড়ালকেই বারবার দেখে ভেবেছিলেন এখানে হয়তো একাধিক প্রজাতির বিড়াল রয়েছে।
এশীয় সোনালি বিড়াল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বনে জঙ্গলে দেখা যায়। এরা বাংলাদেশেও বাস করে।
এই প্রজাতির বিড়াল এতই বিরল, দেশের বৈধ রেকর্ডগুলোয় এদের দেখা পাওয়ার দৃষ্টান্ত হাতের আঙুলে গোনা যাবে।
সম্প্রতি সিলেট বিভাগে প্রথমবারের মতো একটি পদ্ধতিগত ক্যামেরা-ট্র্যাপ জরিপে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলার বনভূমিতে এশীয় সোনালি বিড়ালের উপস্থিতি ধরা পড়ে।
সীমান্তে অবস্থিত এই মিশ্র ও চিরহরিৎ বনাঞ্চল ভারতের ত্রিপুরা পাহাড়ের সঙ্গে সংযুক্ত। জৈবিকভাবে অচেনা এ অঞ্চল ইন্দো-বার্মা জীববৈচিত্র্য হটস্পটের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত, যেখানে সমন্বিত গবেষণা খুবই কম হয়েছে।
বাংলাদেশের তরুণ প্রাণীবিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত নর্থইস্ট বাংলাদেশ কার্নিভোর কনজারভেশন ইনিশিয়েটিভ (এনবিসিসিআই) নামে একটি মাংসাশী প্রাণী গবেষণা গোষ্ঠী এই চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারটি করেছে।
স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিরীক্ষণের জন্য ক্যামেরা-ট্র্যাপ প্রযুক্তি সারা বিশ্বেই ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এই প্রযুক্তি।
এশীয় সোনালি বিড়াল (Catopuma temminckii) একটি মাঝারি আকারের বিড়াল। এদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বনে দেখা যায়।
এসব বিড়ালের লেজের দৈর্ঘ্য ৪০ থেকে ৫৭ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের মাথা থেকে শরীরের দৈর্ঘ্য ৬৬ থেকে ১০৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এই শ্রেণির বিড়ালের কাঁধ সাধারণত মাটি থেকে ৫৬ সেমি উচ্চতায় অবস্থান করে।
সিলেট ও চট্টগ্রামের বনাঞ্চলকে সোনালি বিড়ালের বাসস্থান হিসেবে মনে করা হয়। তবে এই প্রজাতি বেশ বিরল। সারা দেশে এমন বিড়াল দেখার নজির ১০টিরও কম।
বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী ড. রেজা খান ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা থেকে একটি সোনালি বিড়ালের চামড়া সংগ্রহ করেন। আর বাংলাদেশের সোনালি বিড়ালের ওপর হওয়া একমাত্র গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান।
২০০৮ সালের সেই গবেষণায় পার্বত্য অঞ্চলে বন্যপ্রাণী শিকারকে বিড়ালের অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
পাখি পর্যবেক্ষক রোনাল্ড হালদারও জানিয়েছেন, বান্দরবান জেলায় পাখির ছবি তুলতে গিয়ে সোনালি বিড়ালের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। প্রায় এক দশক পরে, ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্স (সিসিএ) নামে এক সংরক্ষণ এনজিও সাঙ্গু-মাতামুহুরীর সংরক্ষিত বনে ক্যামেরা-ট্র্যাপ স্থাপন করলে সেখানে সোনালি বিড়ালের উপস্থিতি ধরা পড়ে।
সিলেট বিভাগেও এ বিড়ালের হাতে গোনা দুটি রেকর্ড রয়েছে। ২০০৯ সালে সিলেটের মেঘালয় সীমান্তবর্তী একটি একটি গ্রামে 'কালো চিতা' ভেবে একটি সোনালি বিড়ালকে হত্যা করেন স্থানীয়রা। ২০১৭ সালে আরেকটি গবেষণায় মৌলভীবাজারের এক বনে এই প্রজাতির বিড়াল ধরা পড়ে।
সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বনগুলো চরিত্রগতভাবে একইরকম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের প্রত্যেকটিতেই সোনালি বিড়াল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। নিয়মিত সোনালি আবরণের বাইরে আরও পাঁচটি রঙ ধারণ করতে পারে এ বিড়াল। এসব রঙের আবরণকে বলা হয় মরফ।
বাংলাদেশে দেখা মেলা বিড়ালগুলোর মধ্যে এর আগে সোনালি, ধূসর ও কালো রঙের মরফের রেকর্ড পাওয়া গেছে। এবারই প্রথম দারুচিনি (লালচে বাদামী) রঙের বিড়াল আবিষ্কৃত হলো।
এশীয় সোনালি বিড়ালই এশিয়ার একমাত্র বহুরূপী বন্য বিড়াল। ২০১৯ সালে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের দিবাং উপত্যকায় ক্যামেরা-ট্র্যাপ থেকে করা এক গবেষণার পর প্রথম এই তথ্য আলোচনায় আসে। সেই গবেষণায় এক বনে ছয়টি ভিন্ন রঙের বন্য বিড়াল আবিষ্কৃত হয়েছিল।
অসংখ্য হুমকির শিকার এ বিড়াল এখন বিশ্বব্যাপীই বিলুপ্তির মুখে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) বাংলাদেশ তাদের ২০১৫ সালের হুমকি মূল্যায়নে সোনালি বিড়ালকে 'দুর্বল' ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে।
আমাদের দেশে এই প্রজাতির সম্ভাব্য ব্যাপ্তি দুই হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও কম জায়গায়। আবাসস্থল ধ্বংসের পাশাপাশি চামড়া ও পশমের জন্য শিকারিরা এসব বিড়ালের অস্তিত্বকেই মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এগুলো অন্যান্য ছোট বিড়ালের মতো নয়। ২০০৫ সালে উত্তর-মধ্য থাইল্যান্ডে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, একটি সোনালি বিড়ালই অন্তত ৩০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখল করে থাকে। আর খাবার সংগ্রহ থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজ এরা দিনের মধ্যে করে ফেলতে পছন্দ করে। তবে বনের পরিধি কমে গেলে এরা আবাসস্থলের জন্য স্বল্প জায়গাতেই নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
এনবিসিসিআইয়ের জরিপে আরও জানা যায়, এই অঞ্চলে স্থলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি বৈচিত্র্যময় ও স্বতন্ত্র সম্প্রদায় রয়েছে। এ গবেষণায় ১০টিরও বেশি মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ব্রাশ-লেজযুক্ত চিংড়িসহ একটি সমৃদ্ধ শিকারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এই দর্শনীয় আবিষ্কারগুলো হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী বনগুলোর গুরুত্ব আবারও ফুটিয়ে তুলেছে। এ অঞ্চলের চা বাগানগুলো সাধারণত বন্যপ্রাণীর করিডোর হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কৃত্রিম সাফারি পার্ক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের এসব বনভূমি বাংলাদেশে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের মডেল হতে পারে। আন্ত-সীমান্ত সুরক্ষিত বনভূমি নির্মাণের জন্যও এগুলো সবচেয়ে আদর্শ জায়গা।