১৭৩ বছর আগে এক ছদ্মবেশধারী চা নিয়ে আসে ভারতবর্ষে
ধূমায়িত চায়ের কাপে প্রথম আয়েশের চুমুকটি দিতে ব্রিটেনের বেশ দেরিই হয়ে গেছে। চীনারা চা খাচ্ছে তাদের দুই সহস্র বছর আগে থেকে।
ইংরেজ ডায়েরি লেখক স্যামুয়েল পেপিসের ডায়েরিতে চা-বিষয়ক প্রথম এন্ট্রিটি এসেছে ১৬০০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।
পেপিস সেখানে লিখেছেন, 'চা (Tcha) হলো অসাধারণ একটি চীনা পানীয়, যা সকল চিকিৎসাবিদ কর্তৃক অনুমোদিত।'
এই চা ইংল্যান্ডে বিক্রি শুরু হয় ১৬৩৫ সালে। তখন এর বিনিময়মূল্য নেহাত কম ছিল না। একেক পাউন্ড চায়ের দাম ৬ পাউন্ড থেকে ১০ পাউন্ড পর্যন্ত, যা আজকের দিনের ৬০০ থেকে ১,০০০ পাউন্ডের সমতুল্য!
১৬৬২ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লস যখন পর্তুগিজ রাজকুমারী ক্যাথরিন অব ব্রাগাঞ্জার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন, তখন তাঁর প্রাপ্ত যৌতুকের তালিকায় ছিল এক চেস্ট চা এবং বোম্বে দ্বীপ বার্ষিক ১০ পাউন্ড ইজারায়, অর্থাৎ তখন ইংল্যান্ডে এক পাউন্ড চায়ের দাম যত ছিল।
ক্যাথরিন ছিলেন চায়ের পাগল। পর্তুগিজ রাজদরবারে বসে নিয়মিত চা পান করতেন তিনি। ইংল্যান্ডর পোর্টসমাউথে যেদিন তিনি প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দেন, সেটি ছিল ১৬৬২ সালের মে মাস, অর্থাৎ যে মাসে বিয়ে হয় তাঁর।
অষ্টাদশ শতকে ডাচ ফার্ম জে জে ভুট অ্যান্ড সন্স ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চা সরবরাহের ব্যর্থতার সুযোগে চরম আকারের ফায়দা তুলতে থাকে। ব্রিটেনের অভিজাত সম্প্রদায় এবং কফি হাউসজগুলোর কাছে তারা বছরে আট মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যমানের চা পাচার করতে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ডাচ চা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই পরিণত হয় 'বাজে গুণগতমান ও ব্যবহারের অনুপযোগী' পানীয়তে।
ইতিমধ্যে ইংরেজ কোম্পানিটি চীনের সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরালো করতে শুরু করে। এটা সেই সময়ের কথা, যখন বোম্বেকে ব্রিটিশ ভারতের ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র্র হিসেবে গড়ে তোলার তৎপরতা শুরু হয়েছে। সঠিক সময়ে সঠিক সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তারা চায়ের ব্যবসায়ে অন্য ইউরোপিয়ানদের, বিশেষত পর্তুগিজ ও ডাচদের পেছনে ফেলে দিতে থাকে।
তারপরও অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণে অষ্টাদশ শতকের মধ্যেই ইংরেজদের অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং চীন ব্রিটেনের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে যে পরিমাণ রুপা দাবি করছিল, তার জোগান দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
একদিকে চায়ের পাচার প্রতিহত করা, অন্যদিকে ক্রমে চীনাদের চাহিদা বাড়তে থাকা, এই দুইয়ের সুবাদে ব্রিটিশদের জন্য শিগগিরই বিকল্প কিছু করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। তাই তারা ভারতে আফিম চাষ করতে শুরু করে। বিশেষত বাংলা, পাটনা, বেনারস ও মালবে তারা সবচেয়ে বেশি আফিম চাষ করে এবং সেই আফিম চীনে পাচারের বিনিময়ে নিজেদের প্রিয় পানীয় অর্জন করতে থাকে।
তারপরও ব্রিটিশ চা-চাষিরা চীনা চা ও তাদের কৌশল ভারতে নিয়ে আসার জন্য ছিল যারপরনাই মরিয়া।
১৭৮৮ সালে দ্য রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টস চীনের চারা নিয়ে এসে অন্যত্র বপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে। তারপর ১৮২৪ সালে রবার্ট ব্রুস ও মণিরাম দেওয়ান আসামে চায়ের চারা আবিষ্কার করেন। সেই সুবাদে চায়ের চাষ আসাম ও দার্জিলিংয়ে বিস্তৃত হয়।
ঊনবিংশ শতকে রয়্যাল সোসাইটির এক লেকচারে উল্লেখ করা হয়, ওই সময়ের দিকেই ভারতে চীনা বসতির ছুতার ও জুতো নির্মাতাদের দার্জিলিং ও আসামে পাঠানো হতে থাকে এই বিশ্বাস থেকে যে প্রতিটি চীনা ব্যক্তিই চা চাষ ও উৎপাদনে দক্ষ হয়ে থাকে। অথচ বাস্তবতা হলো, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কস্মিনকালেও চায়ের চারা চোখে দেখেনি!
১৮৩৩ সালে চার্টার অ্যাক্টের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের মনোপলি হারায়। ১৮৩৪ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের অধীনে টি কমিটি স্থাপিত হয়। ওই বছরই জারডিন ম্যাথসন নামক ফার্ম কর্তৃক চার্লস গুডলাফ ও জর্জ গর্ডনকে দেওয়া হয় চীনের উদ্দেশে যাওয়া আফিমবাহী নৌযান তত্ত্বাবধানের দায়ভার। চীনে থাকাকালীন তাদের আরেকটি দায়িত্ব ছিল চায়ের বীজ সংগ্রহ করা এবং চীনাদের কাছ থেকে চা উৎপাদনের যাবতীয় কৌশল শেখা ও অন্যান্য সংস্থান নিয়ে আসা।
তবে দুঃখের বিষয়, এই মিশন খুব একটা সফলতার দেখা পায়নি।
এর এক যুগ পরে ১৮৪৩ সালে এক স্কটিশ হর্টিকালচারিস্ট রবার্ট ফরচুন স্বাধীনভাবে চীনে গমন করেন চা উৎপাদনবিদ্যা শেখার জন্য। তবে তাঁর যাতায়াতের খরচ জোগায় রয়্যাল হর্টিকালচার সোসাইটি, কেননা তারা ১৮৪২ সালে ট্রিটি অব নানকিংয়ের (যার মাধ্যমে প্রথম আফিম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে) পর থেকেই উন্মুখ হয়ে ছিল চীন থেকে গাছগাছালি ও বোটানিসংক্রান্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য।
ব্রিটেনে ফেরার পর ফরচুন ১৮৪৭ সালে প্রকাশ করেন থ্রি ইয়ার্স ওয়ান্ডারিং ইন দ্য নর্দার্ন প্রভিন্সেস অব চায়না শীর্ষক একটি বই। এই বইয়ে রচিত ফরচুনের নব্যলব্ধ জ্ঞানের বহর দেখে মুগ্ধ হন ড. জন ফোর্বস রয়েল। তিনি তাঁর কোম্পানির পক্ষ থেকে ফরচুনকে একজন স্কাউট হিসেবে নিযুক্ত করেন। তাঁর ওপর ন্যাস্ত হয় 'দ্য গ্রেট ব্রিটিশ টি হাইস্ট'-এর দায়িত্ব।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে বার্ষিক ৫০০ পাউন্ড ভাতার বিনিময়ে এ কাজে রাজি হয়ে যান ফরচুন। কারণ, ৫০০ পাউন্ড বার্ষিক ভাতা ছিল তাঁর ইতিপূর্বের উপার্জনের পুরো পাঁচ গুণ! তা ছাড়া তাঁকে আরও একটি সুযোগ দেওয়া হয়েছিল যে চাইলে তিনি অন্য কোনো হর্টিকালচারিস্টের কাছ থেকেও তাঁর সংগ্রহ ছিনিয়ে আনতে পারবেন, যার ফলে পরবর্তী শতকের পর শতক ধরে কোম্পানিই পাবে চা উৎপাদনের একচ্ছত্র ক্ষমতা, আর ফরচুনের জীবনেও অভাবের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকবে না।
১৮৪৮ সালের শরতে এক অনবদ্য এসপিওনাজ মিশনে চীনে প্রবেশ করেন ফরচুন। সঙ্গী হিসেবে ছিল তাঁর চাকর ওয়াং, যাকে সে অভিহিত করত নিছকই 'কুলি' হিসেবে।
চীনে প্রবেশের আগে ফরচুন তাঁর মাথা কামিয়ে ফেলেন এবং একজন মান্দারিনের বেশ ধরেন। তারপর তাঁরা দুজন রওনা দেন ইউয়ি শান পাহাড়ের এক ফ্যাক্টরি অভিমুখে। তাঁরা সাংহাই থেকে হ্যাংজৌ হয়ে ঝেইজাং ও আনহুইয়ের চা-বাগানগুলো ভ্রমণ করেন। সেটি ছিল পুরো তিন মাসের এক ক্লান্তিকর যাত্রা।
চীনা পাহাড়ি এলাকায় চীনের দুই সহস্র বছরের চা উৎপাদনের প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখে ১৮৪৯ সালে ফরচুন সাংহাইয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকে তিনি লন্ডনে তাঁর চাকরিদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
'আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমি প্রচুর পরিমাণে বীজ ও ছোট ছোট চারা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। আমার বিশ্বাস, সেগুলো নিরাপদেই ভারতে পৌঁছে যাবে।'
এ ছাড়া ফরচুন আরও জানান যে চীনাদের ফেরিক ফেরোসায়ানাইড ও জিপসাম সল্ট দেওয়া হয়েছে, যেন তারা সেগুলো রপ্তানির চায়ের ওপর ডক্টরিং করে, ফলে সবুজ চা থেকে আকাক্সিক্ষত রং পাওয়া যায়।
'একদমই বিস্ময়ের কথা নয় যে চীনারা পশ্চিমের স্থানীয়দের এক ববর্র জাতি বলে মনে করে', ফরচুন জানান।
এদিকে ভুলবশত চীনারা ইউরোপকে বিষাক্ত চা সরবরাহ করছিল। ফরচুনই আবিষ্কার করেন যে কালো ও সবুজ চা মূলত একই ধরনের গুল্ম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে উৎপন্ন হয়। তফাৎ শুধু এটুকুই যে কালো চাকে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় ধরে ফারমেন্ট করা হয়।
ফরচুন প্রায় ১৩,০০০টি চারার স্যাম্পল এবং ১০,০০০টি বীজ হাত করেন এবং গ্লাসের বোতলে করে সেগুলো হংকং হয়ে কলকাতায় পাচার করতে সক্ষম হন। এই নতুন চারাগুলোর সাহায্যে ব্রিটিশ চাষিরা ভারতের পূর্বাংশে নিজেদের উৎপাদিত বিশাল চা-শিল্প গড়ে তোলে।
ফরচুনের এরূপ চা চোরাকারবারি এবং তার বদলে ভিক্টোরিয়ান যুগে ব্রিটিশদের চায়ের শিল্প গড়ে ওঠার কথা সারাহ রোজ বিশদে লিখেছেন তাঁর ২০০৯ সালের গ্রন্থ 'ফর অল দ্য টি ইন চায়না' গ্রন্থে।
সেই গ্রন্থ থেকেই জানা যায়, ফরচুন চায়ের চারা ছাড়াও তাঁর আলখাল্লার ভেতর লুকিয়ে আনেন চায়ের বিষাক্ত রঞ্জক, যা ১৮৫১ সালে দ্য গ্রেট এক্সিবিশনে প্রদর্শন করা হয়।
তবে ফরচুনের অ্যাডভেঞ্চারেরও আগেই জার্ডিন ম্যাথসন নিশ্চিত করেন যে আসামের চা হলো এমন একটি পণ্য, যা লন্ডনে রপ্তানি করা সম্ভব।
একাধারে তিনি আসামের চা-বাগানে নিয়মিত চীনা কর্মীদের নিয়ে আসতে থাকেন, আবার চীনেও আফিম পাচারের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। এভাবেই তিনি পরবর্তী সময়ের ভারতীয় ও সিলোনি চা কোম্পানিদের জন্য একটি টেকসই মডেল তৈরি করেন, যা ১৮৪০-এর দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
ভারতীয় চা প্রথম লন্ডনে পৌঁছায় ১৮৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে একটি নিলামে তোলা হয় সেই চা, যার দাম ওঠে প্রতি পাউন্ডে ৫ শিলিং থেকে ৩৪ শিলিং পর্যন্ত। যেসব ভারতীয় চায়ে সর্বাধিক বৈচিত্র্য ছিল, সেগুলোই বিক্রি হয় সর্বোচ্চ মূল্যে, যা ভারতে উৎপাদিত চায়ের ৩৪ গুণ।
১৮৫৩ সালে ফ্রেজারস ম্যাগাজিনে দাবি করা হয় যে 'চীন নয় বরং ভারতবর্ষই হলো চায়ের প্রাকৃতিক জন্মভূমি।' এবং ব্রিটিশরাও সত্যি সত্যিই এমন দাবির সঙ্গে একমত ছিল, যে কারণে ১৮৮৮ সাল নাগাদ ব্রিটেনে ভারতীয় চা রপ্তানি হতে থাকে ৮৬ মিলিয়ন পর্যন্ত, যার বিপরীতে চীনা চা রপ্তানি হয় ৮০ মিলিয়ন পাউন্ড।
চা-বিষয়ক আরেক ইতিহাসবিদ এরিকা র্যাপাপোর্ট তাঁর ২০১৭ সালের গ্রন্থ আ থার্স্ট ফর এম্পায়ার-এ বলেন, ১৮৯০-এর দশকে লন্ডনে ভারতীয় চায়ের ব্যাপক সুনাম করা হতে থাকে এবং চীনা চা পরিণত হয় চীনাদের পশ্চাৎপদতা ও ছলনার প্রতীক হিসেবে। এমনকি সে সময়ে বিপুল পরিমাণ ভেজাল চীনা চা কাস্টমসে জব্দ করে টেমস নদীতে ছুড়ে ফেলা হয়।
ভিক্টোরিয়ান লন্ডনে ভারতীয় চায়ের যেসব গুণকীর্তন করা হতো, তার মধ্যে অন্যতম 'আ পিওর ইন্ডিয়ান টি সাপ্লাই এজেন্সি'র এই বিজ্ঞাপনটি :
INDIAN TEAS ARE PURER. INDIAN TEAS ARE MORE AROMATIC. INDIAN TEAS ARE STRONGER. INDIAN TEAS ARE CHEAPER. INDIAN TEAS ARE MORE WHOLESOME AND ARE BETTER IN EVERY RESPECT THAN CHINESE TEAS.
এদিকে ১৮৮০-এর দশক থেকেই ভারতীয় চা লন্ডনের সীমানা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ডসহ ইউরোপের অন্য অনেক অংশে এবং যুক্তরাষ্ট্রে।
১৮৮১ সালে অক্সফোর্ড স্ট্রিটে বসে দ্য ইন্ডিয়ান টি স্টোর এবং অচিরেই আরও নানা জায়গায় বসতে থাকে একই ধরনের দোকান। দেরাদুন, শিমলা বা রেংগুনের কাঠে তৈরি সুদৃশ্য বাক্সে বিক্রি হতো ভারতের বা সিলনের চা। সব মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের চা-কে এমন চটকদার ও আকর্ষণীয় রূপে লন্ডনে উপস্থাপন করা হয় যে খুব কম মানুষই সেগুলোর প্রতি লোভ সামলাতে পারত।
আর ভারতে ১৮৭৮ সালে চালু হওয়া দার্জিলিং 'হিমালয়ান রেলওয়ে'কে বলা যায় ভারতীয় চায়ের বিকাশের প্রতীকী শেকড়। ভারতীয় চা-কে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ প্রথম ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েশন (১৮৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত) নেয়।
১৯০১ সাল নাগাদ ভারতে চায়ের বিশাল বাজার গড়ে ওঠে এবং ১৯০৩ সালে টি সেস বিল পাস হয়, যার ফলে চা রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপ করা হয়, যা ব্যবহৃত হতে থাকে ভারতে ও বিশ্বব্যাপী ভারতীয় চায়ের প্রচারণার কাজে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় ও ইউরেশিয়ান ভেন্ডররা স্টোভ ও কেটলির সাহায্যে বাংলা, পাঞ্জাব ও অন্যান্য ফ্রন্টিয়ার প্রদেশের ঐতিহাসিক রেলস্টেশনগুলোতে চা বিক্রি শুরু করে।
টি অ্যাসোসিয়েশন এই বলে গর্ব করতে থাকে, 'প্ল্যাটফর্মের চা স্টলে বসে পান করা এক কাপ চা হতে পারে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস রেস্টুরেন্ট কারের চেয়ে ঢের ভালো।'
বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় প্ল্যাটফর্মগুলোতে চা তৈরির রেসিপি প্রদর্শিত হতে থাকে বড় বড় হোর্ডিং ও পোস্টারের মাধ্যমে। এসব স্টেশনের মধ্যে রয়েছে বালিগঞ্জ, দমদম, নৈহাটি, বনগাঁও এবং রনাঘাট।
স্থানীয় ভেন্ডরদের মারফত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের জন্য ফরচুনের চোরাই উপহার পরিণত হয় ভারতের একটি 'হাইব্রিড বেভারেজে'। তারা চায়ের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে দুধ ও চিনি মিশিয়ে এমন সুস্বাদু পানীয় তৈরি করতে থাকে যে তা একবার পান করলে বারবার পান করতে মন চাইবে।
১৯৩০-এর দশকের মধ্যেই ভারত পরিণত হয় একটি চা-খোর রাষ্ট্রে এবং ব্রিটিশ-প্যাকেটজাত চায়ের বিশাল বাজারে। আর একবিংশ শতকের পূর্বেই ভারত পান করতে থাকে পৃথিবীতে উৎপাদিত মোট চায়ের ৭০ শতাংশ।
বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছোট শহরের রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্ট, সবখানেই চা, মাটির ভাঁড় ও চা-ওয়ালা পরিণত হয়েছে সবচেয়ে পরিচিত অনুষঙ্গে।
ইতিহাসবিদ লিজি কলিংহ্যাম যেমনটি লিখেছেন, 'উত্তর ভারতের যেকোনো ট্রেনে উঠলে এখনো প্যাসেঞ্জাররা প্রথম যে জিনিসটি শুনতে পায়, সেটি হলো ক্যারেজের ভেতর থেকে মেটাল কেটলি ও গ্লাস হাতে হেঁটে চলা চা-ওয়ালার হাঁক। তারা সমানে চেঁচাতে থাকে 'চাই, চাই, চাই' বলে।"
এখন ভারতীয়রা যেভাবে সমানে চা পান করে চলে এবং যেভাবে তাদের প্রতিটি আড্ডা, প্রতিটি বৈঠক কিংবা প্রিয়জন ও পরিচিতজনের সঙ্গে প্রতিটি সাক্ষাতের অন্যতম সঙ্গী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চা, তাতে অনেকেরই মনে হতেই পারে যে এই জাতিটি বুঝি সেই মহাভারতের সময় থেকেই চা পান করছে। তারা অধিকাংশই জানেই না এবং জানতে চায়ও না, তাদের হাতে আজ এই চায়ের কাপ তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রয়েছে আসাম ও দার্জিলিংয়ের উপত্যকাগুলোর এবং অবশ্যই চীনের ফুজিয়ান ও জিয়াংজি প্রদেশে ১৭৩ বছর আগে মান্দারিনের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ানো এক স্কটিশের।