সার্বিক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা
দেশের ব্যবসায়ীরা যখন কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, সেই মুহূর্তেই একের পর এক দেখা দিচ্ছে নতুন সব সংকট। পুরোদমে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাঁচামাল পণ্য—জ্বালানি থেকে তুলা, নিত্যপ্রয়োজনীয় ধাতুর—মূল্য এখন আকাশচুম্বী।
পণ্য প্রস্তুতে সব ধরনের খরচ (ইনপুট প্রাইস) বৃদ্ধি পাওয়ায়, বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচও। সেইসঙ্গে পরিবহন খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় টান পড়েছে ব্যবসায়ীদের মুনাফাতেও।
করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে আসায় কারখানাগুলোতে ফের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এ কারণে গোটা বিশ্বেই এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
তবে প্রায় সব ধরনের কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায়, বাংলাদেশের শিল্পগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়।
এ বছরের শুরুর দিকে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, বৈশ্বিক (কাঁচামাল বা কমোডিটি) পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে এবং বছরের বাকি সময়ও বাড়তিই থাকবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার কারণে জিনিসপত্রের দাম সে সময়ই মহামারি-পূর্বকালের চেয়ে বেশি ছিল, যা এখন সে পূর্বাভাসকে সত্যি করে আরও চড়ছে।
অর্ধবার্ষিক কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক-এ, বৈশ্বিক দাতা সংস্থাটি পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, জ্বালানির দাম ২০২০ সালের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ বাড়বে। প্রতি ব্যারেল তেলের গড় দাম হবে ৫৬ ডলার। নিত্যপ্রয়োজনীয় ধাতুর দাম বাড়বে ৩০ শতাংশ। কৃষি পণ্যের দাম বাড়বে ১৪ শতাংশ।
এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল নতুন ভেরিয়েন্টগুলো এসে টিকাদান কর্মসূচির প্রতি সৃষ্ট ভরসাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে। এই ভেরিয়েন্টগুলো রোগমুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সময় বাডিয়েছে এবং মহামারিকেও প্রলম্বিত করেছে। সরবরাহ চক্র ব্যাহত হয়েছে আরও বেশি। মূল্যবৃদ্ধি অতীতের অধিকাংশ পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে গেছে।
করোনার নতুন ধরনগুলো টিকাদান থেকে অর্জিত আত্মবিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করার আগে, পুনরুদ্ধারের ধীরগতি এবং বিশ্বব্যাপী মহামারিকে দীর্ঘায়িত করার আগে বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া হয়েছিল। সেসময় সরবরাহ চক্র আরও ব্যাহত হয়েছিল এবং মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী মিছিল অতীতের বেশিরভাগ পূর্বাভাসকে অস্বীকার করেছিল।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে শিল্পের বিকাশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের মধ্যে শিল্পজাত কাঁচামাল এবং তেল ও গ্যাসের মতো প্রাথমিক জ্বালানি উৎসগুলো সবচেয়ে অস্থিতিশীলতার মধ্যে রয়েছে।
জুন মাসে ডাউ জোন্স কমোডিটি ইনডেক্স প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। তারপর থেকে কিছু পণ্যের সূচক ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, আবার কিছু পণ্যের সূচক নিচের দিকে নেমেছে।
সেপ্টেম্বরে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৮০ ডলার ছাড়িয়েছে। গত তিন বছরে এই প্রথম প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ৮০ ডলার ছাড়াল।
চাহিদা পুনরুদ্ধারের সাথে সাথে তামার দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেপ্টেম্বরে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারিতে ব্যবহৃত লিথিয়ামের দাম বেড়েছে ২১ শতাংশ।
গত সপ্তাহে দ্য ইকোনমিস্ট এক বিশ্লেষণে বলেছে, এমন এক সময় আকস্মিকভাবে কাঁচামালের চাহিদার বেড়ে গেল, যখন উৎপাদক ও পরিবহন অবকাঠামো কোনোটাই কোভিড-১৯-এর ধাক্কা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
দ্য ইকোনমিস্টের মতে, অসম প্রকৃতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কারণেই পণ্যবাজারে এই 'চরম-বিশৃঙ্খলা' দেখা দিয়েছে। মহামারির আঘাত থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে চীন। কিন্তু, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির পুনরুদ্ধারকে এখন নড়বড়ে মনে হচ্ছে। আমেরিকার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যখন পুরো দমে চলছে, তখন ডেল্টা ভেরিয়েন্টের প্রকোপে ও সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে ইউরোপের পুনরুদ্ধারের গতি ধীর হয়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষুদ্র অর্থনীতিই এখনও গতি পায়নি।
কাঁচামাল পণ্য বাজারে বিশৃঙ্খলা বড়-ছোট নির্বিশেষে সবার জন্যই নতুন আঘাত হয়ে এসেছে। যেকোনো ধাক্কা সামলানোর জন্য যতই শক্তিশালী হোক না কেন, স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম ৮০ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়া ইউরোপের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়।
আর বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য এ ধরনের যেকোনো ধাক্কাই অনেক বেশি কঠিন। ব্রাজিলিয়ান কফির দাম ২২ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি উপেক্ষা করে গেলেও তেল ও গ্যাসের দামে বড় উল্লম্ফন বাংলাদেশের শিল্প ও ভোক্তাদের উভয়পক্ষকে হতাশ করার জন্য যথেষ্ট।
তেলের দাম বেড়ে যাওয়া মানে ভর্তুকিতে খরচ বেড়ে যাওয়া। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন একচেটিয়া পেট্রোলিয়াম এই ভর্তুকির বোঝা ভোক্তাদের ওপর গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকার যেহেতু ধীরে ধীরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসে পরিষ্কার জ্বালানির দিকে যাচ্ছে, তাই ফার্নেস অয়েলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশের দুটি প্রধান জ্বালানি উৎস এলএনজি ও এলপিজি উপাদানের দাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, মহামারি কবলির ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট আমদানির ৭ শতাংশ ছিল পেট্রোলিয়াম পণ্য। লোহা, ইস্পাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ধাতু ছিল মোট আমদানির ৫ শতাংশের কিছু বেশি। তবে কারখানার কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে কাঁচামাল ও মূলধনী পণ্যের চাহিদাও।
এই বছরের জুলাই-আগস্টে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় লোহা, ইস্পাত ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ধাতুর আমদানি ৬৯ শতাংশ বেড়েছে। মহামারির কারণে এসব পণ্যের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল। পেট্রোলিয়াম পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৬ শতাংশ। প্লাস্টিক ও রাবার পণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৭ শতাংশ। মোট আমদানির ৩ শতাংশ প্লাস্টিক ও রাবার পণ্য।
কাজেই বিশ্ববাজারে যেকোনো অস্থিতিশীলতাই বাংলাদেশের শিল্পের জন্য উদ্বেগের বিষয়। কেননা বাংলাদেশের শিল্পগুলো স্থানীয় ও রপ্তানি উভয় বাজারের জন্যই প্রধানত আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (সিসিসিআই) এর একজন পরিচালক ও কেএসআরএম- এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, "হঠাৎ করে সব ধরনের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। অস্বাভাবিকতার জন্য কিছু অনুমান করতে না পারায়, আগাম কোন কাঁচামাল কেনার সময় আমরা আতঙ্কের মধ্যে থাকি।"
একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ইস্পাত উৎপাদনের কাঁচামাল বা স্ক্র্যাপ লোহার মূল্য প্রতিটনে ৭০০ ডলার পর্যন্ত বেড়ে যায়, যা পরে আবার ১৫০ ডলারে নেমে আসে।
"দীর্ঘসময় এমন অস্থিরতা ধরে চললে ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে, তখন তারা ভোগ চাহিদা কমাবেন, যার প্রভাব পুরো শিল্পের ওপর পড়বে। একারণে শিল্পোদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আমরা একটি টেকসই পরিবেশ চাই," যোগ করেন তিনি।
প্রধানত সরকারিভাবে অবকাঠামো নির্মাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ওপর ভর করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মহামারির অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ইস্পাত শিল্প, এ বাস্তবতায় লৌহ আকরিকের দরপতন সমগ্র শিল্পের জন্যই সুসংবাদ।
এব্যাপারে জানতে চাইলে এইচএম স্টিল অ্যান্ড গোল্ডেন ইস্পাত- এর পরিচালক মোহাম্মদ সারোয়ার আলম অবশ্য ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, "বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্প স্ক্র্যাপ নির্ভর হওয়ায়, লৌহ আকরিকের দরপতনের সুবিধাভোগী হবে না। তার ওপর ইস্পাত উৎপাদনের আরেক দরকারি কাঁচামাল- কয়লার মূল্য গত বছরের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এই দরবৃদ্ধি কয়লা সম্পর্কিত অন্যান্য পণ্য যেমন- সিলিকন ম্যাঙ্গানিজের ওপর প্রভাব ফেলেছে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও স্পঞ্জ আয়রনের মূল্য টনপ্রতি ৮০ ডলার বেড়েছে।"
অন্যদিকে, লিথিয়ামের দরবৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈদ্যুতিক ব্যাটারি চালিত অটোমোবাইল শিল্প গড়ে তোলার চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
ইতোমধ্যেই সরকারের দেওয়া নীতি-সহায়তা ও কর রেয়াতের প্রতিশ্রুতিতে উৎসাহিত হয়ে বেসরকারি খাতের কিছু উদ্যোক্তা দেশে ইলেকট্রিক যান সংযোজন ও ব্যাটারি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন। পরিকল্পনার এই প্রাথমিক পর্যায়েই লিথিয়ামের মূল্যবৃদ্ধি তাদের জন্য খারাপ সংবাদ।
দেশে বৈদ্যুতিক যান (ইভি) উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় একটি অটোমোবাইল কোম্পানি- বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (বেইল)। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি প্যাকে ধারনকৃত বিদ্যুৎশক্তিতে চলবে তাদের উৎপাদিত গাড়ি। চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপন করছে কোম্পানিটি, তারা লিথিয়ামের বৈশ্বিক মূল্যের প্রতিও সতর্ক নজর রাখছে।
বেইল- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসুদ কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "ক্রেতাদের জন্য গ্রহণযোগ্য দাম নির্ধারণের জন্য আমরা বিশ্ববাজারে দামের প্রতি লক্ষ্য রাখছি এবং মূল্যে অস্থিরতার মূল কারণ চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।"
একইভাবে, তামার দরবৃদ্ধি বাংলাদেশের কেবল শিল্পে আকস্মিক আঘাত হেনেছে। তারা এখন তামা আমদানিতে ভর্তুকিও দিচ্ছে। তবুও তামার তৈরি পণ্য যেমন- ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মার, কপার ওয়্যার, কপার স্ট্রিপ, কপার রড, কপার পাইপ, কপার বাস বার ও কপার টিউবের মূল্য দিন দিন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বলেও জানান শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
এব্যাপারে জানতে চাইলে তামা-নির্ভর পণ্য প্রস্তুতকারক একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি- কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড- এর কোম্পানি সচিব এস কে মিরাজ আলী বলেন, "বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায়, তার প্রভাব স্থানীয় বাজারেও পড়েছে। মূলত একারণেই দেশের বাজারে কপার আইটেমের দাম বাড়ছে।"
এব্যাপারে কপার পণ্য রপ্তানিতে পুরষ্কার জয়ী প্রতিষ্ঠান- মেরিন সেফটি সিস্টেম- এর চেয়ারম্যান গাজি মুকাররম আলী চৌধুরী বলেন, "তামার দাম বেশ অস্থিতিশীল অবস্থানে রয়েছে। একবছর আগেও টনপ্রতি দাম ছিল ৬ হাজার ডলার, যা এখন প্রায় ১০ হাজার ডলারে বিক্রি হচ্ছে। গত শুক্রবার দর ছিল ৮ হাজার ৩০০ ডলার, যা সোমবারেই ৯ হাজার ২০০ ডলারে পৌঁছায়। চীন নিত্যব্যবহার্য এ ধাতুর অন্যতম বৃহৎ সরবরাহকারী, কিন্তু সেখানে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সরবরাহ মূল্যও বেড়েছে।"
এদিকে ভবিষ্যতের মিশ্র জ্বালানি কৌশলে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন জ্বালানির পরিমাণ বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রমাণিত মজুদ শেষ হওয়ার পথে, তেমন উল্লেখযোগ্য নতুন গ্যাসক্ষেত্রও আবিষ্কৃত হচ্ছে না। এ বাস্তবতায় সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এলএনজি ও এলপিজি গ্যাসের আমদানি উৎসাহিত করেছে।
তবে কাঁচামাল ও ধাতু বাজারের নৈরাজ্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের যেকোন দেশের বিনিয়োগকারীদের জন্যই উদ্বেগের কারণ হলেও, পরিছন্ন জ্বালানি ও ব্যাটারি উৎপাদনে ব্যবহৃত উপাদানের আকাশছোঁয়া দরবৃদ্ধি, বাংলাদেশের মতো তীব্র জ্বালানি চাহিদার দেশে পরিছন্ন ও দূষণকারী জ্বালানির মধ্যে সেরা উপায়টি গ্রহণ করার নতুন প্রচেষ্টাগুলোকে বিপত্তির মুখে ফেলবে।