ঢাকার যাত্রী ছাউনিগুলো যেন বাড়তি সমস্যা!
গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে আহাদ পুলিশ বক্সের পাশের বাস স্টান্ডে অপেক্ষারত ছিলেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ সৈয়দ আলী হাসান। বাসের অপেক্ষায় অন্য যাত্রীদের সঙ্গে রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল তার। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পরে ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে বসে পড়েন আলী হাসান। প্রখর রোদের মধ্যে বসতে পাড়ায় কিছুটা ক্লান্তি কম লাগলেও চেখে মুখে ছিল ক্ষোভ আর বিরক্তি ভাব। যদিও বাস স্টপেজের পাশেই রয়েছে একটি যাত্রী ছাউনি কিন্তু এর পুরোটাই দখলে রয়েছে বাস কাউন্টার আর দোকানে, এমনকি ফুটপাতের বড় একটা অংশেও দখল করে আছে বাস কাউন্টার ও বিভিন্ন খাবারের দোকান।
শুধু গুলিস্তানের এ যাত্রী ছাউনিই নয় রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ যাত্রী ছাউনি দখল করেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ দোকান কিংবা বাসের কাউন্টার কিংবা ভবঘুরেদের আবাসস্থল। আর মেরামত এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই নষ্ট হয়ে ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। তাই আলী হাসানের মতো সাধারণ যাত্রীদের নিয়মিত ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
সৈয়দ আলী হাসান টিবিএসকে বলেন, রাস্তায় বের হলে সবসময়ই ভয়ে থাকতে হয়। বাস থেকে নামতে কিংবা বাসে উঠতে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। যেমন, বাসগুলো নির্দিষ্ট স্টপেজগুলোতে যাত্রীদের উঠানামার জন্য থামায় না, তেমনি স্টপেজগুলোতেও রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। যেখানে যাত্রীদের বসার ব্যবস্থা থাকার কথা সেখানে বাস কাউন্টার আর খাবার দোকানদারদের দখলে। রাস্তার মাঝখানে গিয়েই বাসে উঠতে হয়।
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় দেড় শতাধিক যাত্রী ছাউনি রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে সিটি করপোশনের রয়েছে প্রায় ১০০টির মতো এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা যাত্রী ছাউনি রয়েছে ৫০টিরও বেশি। কিন্তু এগুলোর অধিকাংশই ব্যবহার করতে পারছে না সাধারণ যাত্রীরা। আর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ব্যবহার অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিতেই যাত্রীদের বসার মতো অবস্থা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ডিএমপির বাস স্টপেজ সংলগ্ন যাত্রী ছাউনিগুলোর অধিকাংশের বসার চেয়ারগুলোর বিভিন্ন অংশ, উপরের ছাউনি খুলে নিয়ে গেছে। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনি পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড় কিংবা মলমূত্র ত্যাগের স্থানে। এগুলো সবসময় অপরিচ্ছন্ন থাকায় স্থান করে নিয়েছে পাগল ও ভবঘুরেরা। কোনো কোনো যাত্রী ছাউনিতে রাতে বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। আবার অনেকগুলো দখল করে কেউ কেউ বসিয়েছেন দোকান।
যেখানে যাত্রীদের অবস্থান নেওয়ার কথা সেখানে আসতে যাত্রীরাই ভয় পাচ্ছেন কিংবা এ অব্যবস্থাপনার কারনে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এসব যাত্রী ছাউনি থেকে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালী, বনানী, বিমানবন্দর সড়ক, মিরপুর সড়কসহ বেশকিছু সড়কে দেখা গেছে যাত্রী ছাউনিতে যাত্রীরা বসছে না। অধিকাংশই মেরামতের প্রয়োজন। সেখানে হকার, ভবঘুরে মানুষ থাকছে নিয়মিত। এসব যাত্রী ছাউনির সামনে বাস স্টপেজ থাকলেও, সেখানে বাস থামে না।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাংলামোটর, শাহবাগ, আজিমপুর, গুলিস্তান, মৌচাক, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, মালিবাগসহ বেশ কয়েকটি স্থানের যাত্রী ছাউনিগুলো হয় দখল করে বাসের কাউন্টার, দোকান তৈরি করেছে না হয় যাত্রীদের ব্যবহার উপোযোগী নেই দখল করে আছে ভবঘুরেরা।
দুই বছর আগে রাজধানীতে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি ও গণপরিহনের নৈরাজ্য ঠেকাতে রাস্তার পাশে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় স্থানে ছাউনি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের অধীনে যাত্রী ছাউনি প্রকল্পটির ১৯ টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছিল। যদিও এ সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার কথা ছিল।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের চাহিদা মোতাবেক ঢাকা দক্ষিণকে ৭০টি ও উত্তরকে ৬০টি বাস স্টপেজ ও যাত্রী ছাউনি নির্মাণের জন্য তালিকা দেওয়া হয়। এ তালিকা অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুটি প্রকল্পের আওতায় মাত্র ৪০ টির নির্মাণকাজ শেষ করেছে এবং উত্তর সিটি করপোরেশন তৈরি করেছে মাত্র ৯ টি।
এগুলোর মধ্যে কেইস প্রকল্পের আওতায় উত্তর সিটিতে ৯ টি এবং ঢাকা দক্ষিণতে ১০ টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। এসব যাত্রী ছাউনির পাশে উন্নত ফুটপাত, বিশুদ্ধ খাবার পানি, ওয়াইফাই, টি-স্টল ও মোবাইল ফোন চার্জের ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও এমন কোনও কিছু দেখা যায়নি কোনো যাত্রী ছাউনিতে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি রয়েছে বাস কাউন্টার, দোকানের দখলে আর অধিকাংশই ব্যবহার অনুপোযোগী।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন শীর্ষক মেগা প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে বাকি ৩০ টি যাত্রী ছাউনি, এগুলোর বর্তমান চিত্রও এমন।
কেইস প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা কেইস প্রকল্পের আওতায় দুই সিটি এলাকায় ১৯টি করে যাত্রী ছাউনির নির্মাণকাজ শেষ করেছি। তবে এগুলোর এখন মেরামত প্রয়োজন। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মেগা প্রকল্পের আওতায় নতুন আরও ৩৩টি যাত্রী ছাউনি করা হবে। এরই সাথে ১৬ টি বাস-বে নির্মাণ করা হবে। এগুলো করতে ব্যয় হবে প্রায় ৬.৫ কেটি টাকা।"
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর), ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল মো. ফরহাদ টিবিএসকে বলেন, কেইস প্রকল্পের আওতায় নির্মিত যাত্রী ছাউনিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় আছে, এগুলো মেরামতের জন্য কার্যাদেশ প্রদানের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উত্তর সিটি করপোরেশনে নতুন করে আরও ৫০টি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হবে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে যাত্রীদের নয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের আর ভবঘুরেদের সুবিধা হয় উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সাধারণ সম্পাদক নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "জলবায়ু প্রকল্পের টাকা দিয়ে যাত্রী ছাউনি বানানোর এমন উদাহরণ মনেহয় বাংলাদেশেই প্রথম। তবে সেটাও যদি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত করা হয় আর যাত্রীদের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তবেই সাধারণ মানুষ সুফল পাবে। এজন্য সিটি করপোরেশনকে পরিকল্পিতভাবে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ ও এর সঠিক ব্যবস্থাপনা হাত নিতে হবে।"