প্রায় ১৪ বছর ধরে বন্যপ্রাণী রেখেই চলেছে সাতক্ষীরার অবৈধ চিড়িয়াখানা
সাতক্ষীরা শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে খড়িবিলা গ্রামে ৫৬ একর জমির উপর গড়ে তোলা হয় সুবিশাল মোজাফফর গার্ডেন অ্যান্ড রিসোর্ট। স্থানীয়দের কাছে এটি মন্টুমিয়ার বাগানবাড়ি নামেই বেশি পরিচিত।
এখানেই ২০০৮ সাল থেকে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয় লাইসেন্সবিহীন চিড়িয়াখানা। রাখা হয়েছিল মহাবিপন্নসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৪৯টি বন্যপ্রাণী। তবে গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর যৌথ অভিযান চালিয়ে প্রাণীগুলো জব্দ করা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এতগুলো বছর কীভাবে প্রশাসনের নাকের ডগায় চলেছে অবৈধ এই চিড়িয়াখানাটি?
যার সোজাসাপ্টা উত্তর দেন মোজাফফর গার্ডেন অ্যান্ড রিসোর্টের ব্যবস্থাপক পারভেজ মাহমুদ।
তিনি দাবি করেন, অবৈধভাবে নয়, সবাই জানতেন এখানে বন্যপ্রাণী রয়েছে। ২০০৮ সালে বন্যপ্রাণী নিয়ে আসার পর, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছি। তবে লাইসেন্স পাইনি। সেকারণে ২০০৯ সালে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট অভিযান পরিচালনা করে প্রাণীগুলোকে জব্দ করে। তবে জব্দের পর কর্মকর্তারা সেগুলো নিয়ে যাননি বরং আমাদের জিম্মায় রেখে যান। তারা জানিয়েছিলেন, লাইসেন্স পেলে প্রাণীগুলো আবারও চিড়িয়াখানার জিম্মায় দেওয়া হবে।
পারভেজ মাহমুদ জানান, "২০১০ সালে বন বিভাগের কাছে বন্যপ্রাণী রাখা ও চিড়িয়াখানাটির জন্য লাইসেন্স পেতে আবেদন করি। তবে কোন লাইসেন্স বন বিভাগ দেয়নি। অবশেষে প্রাণীগুলোকে হস্তান্তরের জন্য ২০১১ সালে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের নিকট আবেদন করা হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই প্রাণীগুলো আমাদের চিড়িয়াখানাতেই ছিল। এগুলো ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান সংগ্রহ করা। তবে একসাথে নয়, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জোগাড় করা হয়েছিল।"
এ বিষয়ে সাতক্ষীরার বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
গত বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী সাতক্ষীরার মোজাফফর গার্ডেন অ্যান্ড রিসোর্টে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, খুলনার বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং বনবিভাগ খুলনা অঞ্চলের একটি দল।
প্রাণীগুলো জব্দ করে ঢাকা ও খুলনায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রাণীগুলোর সিংহভাগের প্রাকৃতিক আবাস সুন্দরবন-কেন্দ্রিক। তাই তাদের খুলনা বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেসকিউ সেন্টারে রেখে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকিগুলো ঢাকায় নেওয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ছাড়ার উপযোগী হলেই তাদের অবমুক্ত করা হবে।
উদ্ধার করা বন্য প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে: চারটি গুইসাপ, দুইটি অজগর, একটি মদনটাক, একটি হুতুম প্যাঁচা, তিনটি বানর, একটি দাগি রাজহাঁস, একটি খয়রা চখাচখি, ১৭টি পাতি সরালি, একটি লোনা পানির কুমির, তিনটি চিত্রা হরিণ, একটি ম্যাকাও বানর, দুইটি ময়ূর, একটি শিয়াল, একটি পালাসি ঈগল, তিনটি তিলাঘুঘু, একটি ধুপনী বক, একটি ভুবনচিল, একটি বাজপাখি, একটি উল্লুক, একটি লালচে হনুমান এবং দুটি শজারুসহ মোট ৪৯টি বন্যপ্রাণী।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) লাল তালিকায় রয়েছে মদনটাক, দাগি রাজহাঁস, খয়রা চখাচখি, শজারু, উল্লুক, লোনা পানির কুমির ও পালাসি ঈগল। অথচ প্রশাসনের গোচরে, মহাবিপন্ন এই প্রাণীগুলোই এতদিন ধরে ছিল মোজাফফর গার্ডেন অ্যান্ড রিসোর্টের মিনি চিড়িয়াখানায়।
তবে বন বিভাগের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করছেন রিসোর্টের মালিক জেএম খায়রুল মোজাফফর মন্টু।
তিনি বলেন,"এখানে অবৈধ জীবজন্তু রয়েছে প্রশাসনের প্রতিটি মানুষ জানে। আমি তাদের জানিয়েছি, তারা যেন সেগুলো নিয়ে যায়, তারা নেয়নি। সাতক্ষীরায় যখন যে ডিসি এসেছে তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, বন্যপ্রাণীগুলোর পেছনে প্রতিদিন অনেক টাকা খরচ। তাদের অনুরোধ করেছি, অবৈধ জীবজন্তু যেন নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে ছেড়ে দেয়। তারা সেটি করেননি।
তাই হঠাৎ অভিযান করে বন্যপ্রাণী আটক করা হয়েছে, তাদের এটা বলা ঠিক হয়নি।"
প্রশাসন ও বন বিভাগের সবাই জানতেন এখানে অবৈধ জীবজন্ত রয়েছে। অবৈধ জীবজন্তু থাকার কারণে এতদিন আমি রিসোর্টের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও পাইনি।
খুলনার বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক রাজু আহমেদ বলেন, "২০০৯ সালে অবৈধ উপায়ে রাখা বন্যপ্রাণীগুলো সেভ ওয়াইল্ড লাইভ জিম্মায় নিয়েছিল। তবে বন বিভাগের নিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা না থাকায় তখন সেগুলো নিয়ে আসা যায়নি। জব্দ করে তাদের জিম্মায় রাখা হয়েছিল। ওই সময়ে আমি এখানে ছিলাম না, সেকারণে বিস্তারিত জানা নেই।"
রিসোর্টে অভিযান পরিচালনাকারী দলের প্রধান বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আস সাদিক জানান, "যখন থেকে বন্যপ্রাণী সেখানে সংরক্ষণ করা হয়েছিল, ওই সময়ে বন্যপ্রাণী আইন ছিল না। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন হয়েছে ২০১২ সালে। তবে তার আগেই ২০০৯ সালে প্রাণীগুলো জিম্মায় নিয়ে তাদের হেফাজতে দেয় বন বিভাগ। এ আইনে মিনি চিড়িয়াখানায় বন্যপ্রাণী রাখার কোন বৈধতা নেই। তবে আইনটি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। সারাদেশের যেখানে যেখানে চিড়িয়াখানা তৈরী করে বন্যপ্রাণী রাখা রয়েছে সেখানে অভিযান পরিচালনা করা হবে। সকল বন্যপ্রাণী জিম্মায় নিয়ে ধীরে ধীরে অবমুক্ত করা হবে। চলমান সেই অভিযানের অংশ হিসেবেই মোজাফফর গার্ডেনের মিনি চিড়িয়াখানায় অভিযান পরিচালনা করে বন্যপ্রাণীগুলো নিয়ে আসা হয়েছে।"
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী রাখার দায়ে তাদের মামলা দেওয়া হতো। তবে ২০০৯ সালে সেভ ওয়াইল্ড লাইভ প্রাণীগুলো তাদের জিম্মায় রাখার কাগজপত্র দেখানোর ফলে, রিসোর্টটি মামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। একইসাথে তারা মুচলেকা দিয়ে ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে।