ইপিবি’র আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পোশাক রপ্তানিকারকরা
- রপ্তানিকারকদের নিবন্ধনকালে ১২ ধরণের আর নবায়ন করতে অন্তত ৯ ধরণের ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত মানতে হয়
- বিজিএমইএ বলছে, এর মধ্যে চার ধরণের ডকুমেন্টের কোন প্রয়োজনই নেই
- পাঁচ বছর আগে বাতিল হওয়া গ্রুপ বীমার ডকুমেন্টও জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে
- সমস্যা সমাধানে ইপিবিকে বিজিএমইএ'র চিঠি
- চলতি সপ্তাহে বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত
ব্যবসা সহজ করতে সরকারের নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কিছু সরকারি দপ্তর এর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রপ্তানিকারকদের নিবন্ধন নবায়নের ক্ষেত্রে বেশকিছু ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত আরোপ করে রেখেছে, যাকে 'অপ্রয়োজনীয়' আখ্যা দিয়ে তা ব্যবসায়ের জন্য বাধা হিসেবে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
বর্তমানে ইপিবিতে নিবন্ধন নবায়নকালে অন্তত ৯ ধরনের ডকুমেন্ট দাখিল করার শর্ত রয়েছে। যদিও দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, এর মধ্যে চার ধরনের ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত অপ্রয়োজনীয়।
এর মধ্যে আবার গ্রুপ বীমার হালনাগাদ ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে। অথচ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে রপ্তানি মূল্যের উপর ০.০৩ শতাংশ অর্থ উৎসে জমা দেওয়ার পর ওই বিধান ২০১৬ সাল থেকে আর কার্যকর নয়।
গত ৬ অক্টোবর পোশাক খাতের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) ইপিবির সেবা প্রাপ্তিকে সহজ করার লক্ষ্যে আলোচ্য চার ধরণের ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে।
ইপিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে আগামী সপ্তাহে সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বর্তমানে ইপিবি রপ্তানিকারকদের জিএসপি (জেনারেলাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেস) সনদ ও কান্ট্রি অব অরিজিনের (সিও) সনদ দিয়ে থাকে। আমদানিকারক দেশের চাহিদার কারণে ইপিবি থেকে এসব সনদ নিতে হয় রপ্তানিকারকদের।
এর জন্য রপ্তানিকারকদের ইপিবিতে নিবন্ধিত হতে হয় এবং সময় সময় তা নবায়ন করতে হয়। নিবন্ধন নবায়নের জন্য আবেদনকারীর ছবি, ট্রেড লাইসেন্সের কপি, ইআরসির (এক্সপোর্ট রিয়েলাইজেশন সার্টিফিকেট) সনদের হালনাগাদ কপি, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সের নবায়নের কপি, সংশ্লষ্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যের প্রমাণপত্র, ফায়ার পলিসির (ইন্স্যুরেন্স) নবায়নের কপি, গ্রুপ বিমার নবায়নের কপি এবং অনুমোদিত কারখানা ভবনের লে-আউট প্লান ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কপি দাখিল করতে হয়।
গত বছর সেপ্টেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়ে দেয়, আলোচ্য ডকুমেন্ট জমা না দিলে রপ্তানিকারকদের কোনো ধরণের সেবা দেওয়া হবে না।
এছাড়া নিবন্ধনের সময় আলোচ্য ৯ ধরণের ডকুমেন্টের বাইরেও করদাতা সনাক্তকরণ নম্বর (ই-টিআইএন), ফ্যাক্টরি ইন্স্যুরেন্সের হালনাগাদ কাগজপত্রসহ আরো কিছু ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
ইউরোপে বিদ্যমান শুল্কমুক্ত সুবিধায় বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশের ক্ষেত্রে ইপিবির জিএসপি সনদ এবং এশিয়ার দেশগুলোতে শুল্ক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সিও সনদের প্রয়োজন হয়।
ইপিবিতে পাঠানো বিজিএমইএ'র চিঠিতে অনুমোদিত কারখানা ভবনের লে-আউট প্লান ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন কপি, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ লাইসেন্সের নবায়নের কপি, ফায়ার পলিসির (ইন্স্যুরেন্স) নবায়নের কপি ও গ্রুপ বিমার নবায়নের কপি বাতিলের দাবি জানানো হয়।
এর যুক্তি হিসেবে বলা হয়, এসব নথিপত্র দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিস রয়েছে, যার সঙ্গে ইপিবির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। অন্যদিকে গ্রুপ বীমার প্রয়োজনীয়তা আরও চার বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। সরকার রপ্তানি আয়ের উপর উৎসে ০.০৩ শতাংশ (একশ টাকায় তিন পয়সা) কেটে রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পর গ্রুপ বীমা ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে। অথচ ইপিবি ওই ডকুমেন্টও চাইছে।
বিজিএমইএ'র পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের রপ্তানিকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান যাতে বাধাহীনভাবে রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রাখতে পারে, সেজন্য ইপিবির কার্যক্রমকে আরো সহজ করার স্বার্থে অপ্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট প্রদানের শর্ত বাতিল করা দরকার।
বিজিএমইএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকারের উদ্দেশ্য হলো ব্যবসা সহজ করা, কিন্তু ইপিবির অপ্রয়োজনীয় এত ডকুমেন্টের শর্ত সহজ না করে তা আরো কঠিন করছে। এতে হয়রানি বাড়ে। সারা দুনিয়া ব্যবসাকে সহজ করছে, অথচ এখানে কঠিন করা হচ্ছে।"
"কেবল ইপিবি নয়, সরকারের অন্যান্য দপ্তরেও এ ধরণের অহেতুক শর্ত দিয়ে রাখা হয়েছে, যা ব্যবসাকে সহজ করার বদলে কঠিন করছে।"
তিনি বলেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগ আনতে হলে এসব অপ্রয়োজনীয় হয়রানি বন্ধ করা দরকার।
অবশ্য পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব কারণে কারো সেবা প্রদান এখনো বন্ধ হয়নি।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পোশাক খাতের একজন নেতা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এসব অপ্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের শর্ত থাকার সুযোগে কর্মকর্তাদের 'ম্যানেজ' করতে অনেক রপ্তানিকারককে বাড়তি 'খরচ' করতে হয়।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এসব শর্ত ব্যবসা সহজ করার ক্ষেত্রে বাধা। বর্তমানে এর কোন প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে বিপুল পরিমাণ ডকুমেন্ট দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। সরকার ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো (এনএসডিব্লিও) বাস্তবায়ন করতে চাইছে। তা কার্যকর হলে এর কোন প্রয়োজনই থাকবে না। এজন্য দ্রুত এনএসডব্লিও বাস্তবায়নে মনযোগ দিতে হবে।
ব্যবসা বাণিজ্যের সূচকে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি বহুল আলোচিত। বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে সর্বশেষ মূল্যায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৬৮তম। এর পেছনে নানা ঘাটে ব্যবসা জটিল হওয়ার বিষয়টি ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে।
এ বিষয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো'র (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে সভা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে সভা করা হবে এবং এর প্রয়োজনীয়তা আসলেই আছে কিনা, তা রিভিজিট করা হবে। এর পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।"
তিনি বলেন, "অতীতে যখন এসব ডকুমেন্ট জমা দেওয়ার শর্ত আরোপ করা হয়, তখন হয়তো কোনো জাস্টিফিকেশন ছিলো। ১০ বছর পরে এখনকার বাস্তবতায় হয়তো প্রয়োজন নেই।"