উত্তরা-আগারগাঁও মেট্রোরেলের ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন
রাজধানীর উত্তরা-আগারগাঁও মেট্রোরেলের প্রথম ১১.৭৩ কিলোমিটারের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ। জাপান থেকে আসা সাত সেট মেট্রো ট্রেন নিয়ে চলছে বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষ করে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে জনসাধারণের জন্য মেট্রো রেল পরিচালনা শুরু করতে চায় সরকার।
উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রো রেলের সর্বশেষ অগ্রগতি গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মেট্রো রেলের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, "বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নতুন করে কোন ধরনের এক্সটার্নাল চ্যালেঞ্জ না আসলে আগামী বছরের ডিসেম্বরে মেট্রো ট্রেন পরিচালনা সম্ভব।"
দিয়াবাড়ি ডিপোর মেট্রো রেল প্রদর্শনী ও তথ্য কেন্দ্রে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে মেট্রো এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের বিস্তারিত তুলে ধরেন জাপানের বিভিন্ন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, একটি মাত্র মেট্রো রেল লাইন ঢাকা মহানগরীর যানজট কমাতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে না। এ বিষয়টি বিবেচনায় এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর) প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাইকা।
তিনি আরও বলেন, মেট্রো রেলের কাজ শেষ হলে ঢাকা মহানগরীর চেহারা বদলে যাবে। জাপানের প্রযুক্তি এ নগরবাসীর জীবনধারা বদলে দেবে।
অনুষ্ঠানে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রধান প্রতিনিধি ইউহো হায়াকাওয়া বলেন, বাংলাদেশ এখন স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মডেল।
তিনি বলেন, "বিশ্ব সাপ্লাই চেইনে দেশটি ভালো অবদান রাখবে। দেশটির উন্নত অবকাঠামো এবং ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা প্রয়োজন। বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন ধাপ অর্জনে মেট্রো রেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং শেষে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা উত্তরা-উত্তর স্টেশনে মেট্রো ট্রেন পরিদর্শন করেন। এ সময় জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমন, সাবেক ক্রিকেটার আবদুর রাজ্জাক ও মেহেদি হাসান মিরাজ উপস্থিত ছিলেন।
দিয়াবাড়ির ডিপো থেকে ছেড়ে মেট্রো ট্রেনটি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে উত্তরা-উত্তর স্টেশন অতিক্রম করে। পল্লবী স্টেশন হয়ে ট্রেনটি ২৫ কিলোমিটার গতিতে ফিরতি পথে চলে এসে দাঁড়ায় উত্তর স্টেশনে।
ছয় বগির ট্রেনের একটি বগি খুলে দেয়া হলে তাতে আরোহন করেন ডিএমটিসিএল, জাপানের দূতাবাস, জাইকা ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
এ সময় এমআরটি লাইন-৬ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক (সিপি-০৮) এবিএম আরিফুর রহমান জানান, বগিটিতে ৩৭০ জন যাত্রী আরোহন করতে পারবেন, এর মধ্যে বসতে পারবেন ৪৮ জন। যার অর্থ দাঁড়ায়, অধিকাংশ যাত্রীকেই দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে হবে।
ট্রেনটিতে পর্যাপ্ত জায়গা ফাঁকা রেখে লম্বালম্বি প্লাস্টিকের আসন পাতা রয়েছে। দাঁড়িয়ে যাত্রা করা লোকজনের জন্য তিন সারিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে প্রায় আড়াইশ হাতল।
আরিফুর রহমান জানান, মানুষের উচ্চতা বিবেচনায় হাতলের উচ্চতায় ভিন্নতা রয়েছে। নারী যাত্রীদের জন্য প্রতিটি বগিতে আলাদা সিট রয়েছে। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের হুইল চেয়ার ব্যবহারের জন্যও রয়েছে পৃথক স্থান।
কর্মকর্তারা জানান, মেট্রো ট্রেনের মোটর কার ও ট্রেইলারের বডিতে ব্যবহার করা হয়েছে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এলুমিনিয়াম এলয়। ব্যবহার করা হয়েছে বুলেটপ্রুফ কাঁচ।
ছয় কোচের প্রতি সেটের দুই প্রান্তে থাকবে দুইটি ট্রেইলার কন্ট্রোল। মাঝে থাকবে তিনটি মোটর কার ও একটি ট্রেইলার। প্রতিটি মোটর কারে ডিসি ১৫০০ ভোল্ট ক্ষমতার বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করা হবে।
২২ টন থেকে ২৮ টন ওজনের এসব কারের প্রস্থ ২.৯৫ মিটার।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ সব কোচের প্রতিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে দুইটি এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট।
ট্রেনের প্রতি প্রান্তে চারটি করে দরজা রয়েছে। ট্রেনে প্রাধান্য থাকবে লাল ও সবুজ রংয়ের।
সেকেন্ডের ব্যবধানে এ ট্রেনের গতি ঘন্টায় ৩.৫ কিলোমিটার বাড়ানো যাবে। প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলবে ট্রেন। স্বাভাবিক অবস্থায় মেট্রো ট্রেনের গতি ৩.৫ কিলোমিটার হারে কমবে। আর জরুরী অবস্থায় গতি কমবে ৪.৫ কিলোমিটার হারে। মেট্রো ট্রেনে রিজেনারেটিক বৈদ্যুতিক ব্রেক ব্যবহার করা হচ্ছে।
চালক ছাড়াই রেডিও কমিউনিকেশনের ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে মেট্রো রেল পরিচালনা করা হবে। এজন্য ব্যবহার করা হবে 'SIL4' নামে রেট্রোফিট অটোমেটিক ট্রেন অপারেটিং সিস্টেম।
প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, সম্পূর্ণ চালু হলে মেট্রো রেল পরিচালনায় ১৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে।
ট্রেন পরিচালনায় রেডিওভিত্তিক যোগাযোগের জন্য লং-টার্ম ইভ্যালুয়েশন (এলটিই) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। এতে সিগন্যালিং সিস্টেম পরিচালনা করবে জাপানের নিপ্পন সিগন্যাল কোম্পানি লিমিটেড।
ট্রেনের সম্পূর্ণ স্থাপনায় অপটিক্যাল ফাইবার বেসড নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হচ্ছে। টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা বিকল হলে ট্রেন বন্ধ হয়ে যাবে। ডিপো, স্টেশন, সাব-স্টেশন, প্রবেশদ্বার, ট্রেনসহ সব স্থাপনায় সিসি ক্যামেরা ব্যবহার করা হবে।
নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকছে বিশেষ ব্যবস্থা
মেট্রো রেলের প্রতি সেটের একটি কোচ নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। অন্যান্য কোচে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ভ্রমণ করতে পারবেন। গর্ভবতী মহিলা ও অতিরিক্ত বয়সীদের জন্য প্রতি কোচে থাকবে সংরক্ষিত আসন।
প্রতিবন্ধীদের জন্য কোচের ফ্লোর এবং প্ল্যাটফর্মের মধ্যে উচ্চতার সমতা রাখা হবে। কোচ ও প্ল্যাটফর্মের মাঝে ফাঁকা জায়গা থাকবে ন্যূনতম। ট্রেনের উভয় প্রান্তের কোচে হুইল চেয়ারের জন্য নির্ধারিত স্থান রয়েছে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ট্রেনে রয়েছে অডিও ইনফরমেশন সিস্টেম। আর শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য রয়েছে ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে ও মনিটর।
এমএএন সিদ্দিক বলেন, "এখন পর্যন্ত সাতটি ট্রেন দেশে এসেছে। ১০ থেকে ১২টা ট্রেন আসলেই পরিচালনা করা যাবে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই এ পরিমাণ ট্রেন চলে আসবে। প্রথম অবস্থায় প্রতি সাড়ে তিন মিনিট পরপর ট্রেন পরিচালনা করা হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ভাড়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে পারব।"
ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার পাশাপাশি ট্রেন পরিচালনার খরচ ওঠানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
এ সময় তিনি আরও জানান, মানুষকে মেট্রো রেল সম্পর্কে ধারণা দিতে আগামী জানুয়ারির মধ্যেই মেট্রো রেল প্রদর্শনী ও তথ্য কেন্দ্র উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। সেখানে মেট্রো রেলে কীভাবে চড়তে হবে, কীভাবে ভাড়া দিতে হবে, কীভাবে টিকেট কাটতে হবে এ বিষয়ে ধারণা দেয়া হবে।