মাথার চুলের শূন্যস্থান পূরণ করছেন তারা
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের কাজ করছেন কয়েকজন নারী। খুব মনোযোগ দিয়ে একটি একটি করে চুল বসাচ্ছেন নেটের উপর। দীর্ঘ সময় ধরে একই দৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোযোগ আর দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ভাবনা থেকে এক সময় তৈরি হচ্ছে মনোরম টুপি।
তবে এ টুপি সাধারণ কোনো টুপি নয়! বিশ্বের বিত্তবানদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের হেয়ার ক্যাপ বা চুল টুপি। যাদের চুল নেই, এই টুপি পরেই তারা মাথার চুলের শূন্যতা পূরণ করেন।
মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলায় এখন চোখে পড়ছে এমন দৃশ্য। গ্রামগুলোতে অবস্থিত ছোট ছোট কারখানাগুলোতে হাজারো নারীর হাতের স্পর্শে তৈরি হচ্ছে বিশ্বমানের হেয়ার ক্যাপ।
একই ধরনের দৃশ্যের দেখা মেলে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর ও মান্দা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। মহাদেবপুর উপজেলার এনায়েতপুর ইউনিয়নের চকহরিবল্লভ আদর্শ গ্রামের কারখানায় ৩০ জন নারী গত দুইমাস থেকে কাজ করছেন।
প্রতিটি টেবিলে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো আছে প্লাস্টিকের ডামি মাথা। আর ডামি মাথার ওপর একটি নেট বা জাল। এ জালের ফাঁকে ফাঁকে সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে আটকানো হচ্ছে একেকটি চুল। তাদের মাথার ওপর ঝুলছে এনার্জি লাইট। প্রতিটি টেবিলে দুইজন করে দুইপাশে চারজন কারিগর কাজ করছেন মনোযোগ দিয়ে। ডামি পুরো মাথায় সূক্ষ্মভাবে চুল আটকানো সম্ভব হলেই ক্যাপ তৈরির কাজ শেষ।
মেহেরেপুররে মুজিবনগর উপজেলার ৪০টির উপরে গড়ে উঠেছে পরচুলা বা হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা। এসব কারখানার কাজ করেন দুই হাজারের বেশি শ্রমিক। তাদের মধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ শ্রমিকই নারী। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এসব নারীরা হাতের কাজের মাধ্যমে তাদের সংসারে স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে।
চীনের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে এগুলো আমদানি করে। সেখানে আরও প্রসেসিং ও ব্যান্ডিংয়ের পর আন্তর্জাতিক বাজারে এগুলো বিক্রি করে চীনা কোম্পানিগুলো।
চার বছর আগে কোরিয়ান এক নারী এসেছিলেন মেহেরপুরের খ্রিষ্টান পল্লী বল্লভপুর গ্রামে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে এসে তিনি এখানকার নারীদের চুলের টুপি তৈরির কাজ শেখান। কিছুদিন পর তিনি নিজ দেশে ফিরে গেলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
এর প্রায় তিন বছর পরে চীনের বায়াররা এদেশে চুলের ব্যবসার জন্য আসেন। ঢাকার বরেন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির সাথে যুক্ত হয়ে বল্লভপুর গ্রামের দিলিপ মল্লিকের সাথে চুক্তি করেন। কোরিয়ান ওই নারীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া শ্রমিকদের নিয়ে কারখানার কার্যক্রম শুরু করেন দিলিপ মন্ডল।
অল্প সময়েরই তার সফলতায় এলাকায় ৪০টি কারখানা গড়ে উঠে। ক্যাপ তৈরির জন্য শ্রমিকরা ক্যাপের আকারভেদে মজুরি পান। ছোট ক্যাপের জন্য ৪০০ টাকা, বড় ক্যাপগুলোর জন্য এক হাজার থেকে এগারোশ' টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। এক থেকে দেড় দিন সময় লাগে একেকটি ক্যাপ তৈরিতে।
ফেরিওয়ালারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সংগ্রহ করেন নারীদের মাথা থেকে ঝরে যাওয়া চুল। এক পর্যায়ে ঢাকার উত্তরায় বরেন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানির কারখানায় পাঠানো হয় সংগৃহীত চুল। সেখানে চুল বাছাই ও ওয়াশ করে চীনে পাঠানো হয়। নেট তৈরি এবং চুল প্রসেসিংয়ের পুরো কাজটিই হয় চীনের নিয়ন্ত্রণে। কারখানাগুলোতে শুধু বুননের কাজ চলে।
নির্দিষ্ট একটি ভবনে খুব সাধারণ কিছু উপকরণ দিয়েই চলে কারখানা কাজ। দিলিপ মন্ডলের মতো বেশ কিছু উদ্যোক্তা কারখানা তৈরি করেছেন। এখানে চীনা কোম্পানির প্রশিক্ষকরা নারীদের প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের পর হেয়ার ক্যাপ তৈরি ও এর উন্নয়নের কাজ করেন নারী শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চীনা কোম্পানী তাদের নীতি অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তবে এটি বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সরকারিভাবে এ শিল্পের জন্য প্রশিক্ষণ পাওয়া গেলে দক্ষ জনবল গড়ে উঠবে। দক্ষ জনবল যত বাড়বে, বায়ারদের ততো বেশি আকৃষ্ট করা যাবে।
অনেকটাই নীরবে বেড়ে উঠা এই শিল্পে সরকারি সহায়তা পাওয়া গেলে নারীদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হবে।
নওগাঁর মহাদেবপুর ও মান্দা উপজেলার কয়েকটি গ্রামেও গড়ে উঠেছে পরচুলা বা হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় কাজ করছেন এলাকার দরিদ্র নারী, স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। ক্যাপ তৈরি করে প্রতি মাসে তিন থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করেন তারা।
৪ বাই ৪ সাইজের প্রতিটি ক্যাপের মজুরি ৪০০ টাকা, ৫ বাই ৫ সাইজের মজুরি ৬০০ টাকা এবং ৪ বাই ১৩ সাইজের ক্যাপের মজুরি ১৩০০ টাকা। প্রকারভেদে প্রতিটি ক্যাপে ২০ গ্রাম থেকে ৫০ গ্রাম পর্যন্ত চুল লাগে। ক্যাপ তৈরিতে আরও লাগে মাথার ড্যামি, চুল, নেট, সুঁচ, সুতা, চক ও পিন।
এসব ক্যাপের উপকরণ স্থানীয় মহাজনরা ঢাকা থেকে নিয়ে এসে গ্রামের নারীদের দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরি করিয়ে আবার ঢাকায় পাঠান। সেখান থেকে রপ্তানি হয় চীন, জাপান, ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এ পরচুলাকে কেন্দ্র করে মহাদেবপুরের এনায়েতপুর, চকহরিবল্লভ আদর্শগ্রাম, শীবপুর, চকগোবিন্দপুর, গণনপুর, মান্দা উপজেলার সাটইল, সাতবাড়িয়া, চৌবাড়িয়া ও হোসেনপুর, মসিদপুরসহ কয়েকটি গ্রামে হেয়ার ক্যাপ তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে।
পরচুলা দিয়ে হেয়ার ক্যাপ তৈরির আগে দুইদিন সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
মান্দা উপজেলার তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের সাটইল গ্রাম মধ্যপাড়ার কারখানার দলের অধিনায়ক রোশিদা বেগম বলেন, 'আমার অধীনে ২০ জন ক্যাপ তৈরির কাজ করে। এরমধ্যে ছয়জনই ছাত্রী। তারা পড়াশুনার পাশাপাশি এ কাজ করে। আর গৃহবধুরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করে।'
মহাদেবপুর উপজেলা সদরের বাসিন্দা তরুন উদ্যোক্তা আজাহার ইসলাম সুজন (২৭)। তিনি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ছোট ব্যবসা করতেন। এক বন্ধুর পরামর্শে মান্দার হেয়ার ক্যাপের মহাজন জামিল হোসেনের সঙ্গে কথা বলেন। গত চারমাস থেকে এ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
আজাহার ইসলাম সুজন বলেন, 'হতদরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এসব কারখানা থেকে মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা আয় হয়। আর মহাজনরা এসব ক্যাপ ঢাকায় পাঠায়। পরে ক্যাপগুলো চীন, জাপান, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে।'
নওগাঁর মান্দার সাতবাড়িয়া গ্রামের হেয়ার ক্যাপ এর মহাজন জামিল হোসেন জানান, জেলায় তার মতো সাতজন ব্যবসায়ী আছে। ঢাকা থেকে বড় মহাজনদের কাছ থেকে পরচুলা সহ হেয়ার ক্যাপ তৈরির উপকরণ নিয়ে এসে উদ্যোক্তদের দেওয়া হয়। উদ্যোক্তারা বিভিন্ন গ্রামে তাদের কারিগরদের দিয়ে ক্যাপ তৈরি মহাজনদের কাছে পাঠান।
মাস শেষে কে কতোটি ক্যাপ তৈরি করে তার ওপর ভিত্তি করে মজুরি দেওয়া হয়। তবে ঢাকার মহাজনরা দেশের বাইরে কতো টাকা করে এসব ক্যাপ বিক্রি করেন এ সম্পর্কে তাদের কিছু জানানো হয় না।