যে নদীর পানি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়!
কখনো লাল, কখনো নীল, কখনোবা খয়েরি, কালো আবার কখনো দুধের মতো সাদা। একেক সময় একেক রং ধারণ করে নদীর পানি। না, রূপকথার কোন জাদুকরি নদীর কথা বলা হচ্ছে না। শুনতে অবাক লাগলেও, এমনই এক নদী আছে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলায়। নদীটির নাম বানার নদী। যে জলধারার পানি দিয়ে হতো কৃষিকাজ, খাওয়ানো হতো গবাদিপশুকে, সেই পানিই এখন এলাকাবাসীর কাছে রীতিমত আতঙ্ক। কেন নদীর পানির এমন পরিবর্তন তার অনুসন্ধান চালিয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
সরেজমিনে গত ১৬ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবাড়ি ইউনিয়নে গিয়ে চমকে উঠতে হলো। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বানার ব্রিজের নিচে টকটকে লাল পানি। এ যেন রক্তের বন্যা! নদীর পার ঘেঁষে যতদূর হাটা যায়, পানির রংয়ের কোন পরিবর্তন নেই।
পরদিন (১৭ অক্টোবর) দুপুরে আবার বানার নদীতে হাজির হয়ে দেখা যায়, পানি খয়েরি রংয়ের। পার ঘেঁষে করা হয় নদীকে অনুসরণ। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর দেখা যায়, বানার নদীটি গিয়ে মিশেছে উপজেলার আরেক নদী খিরুতে। এই খিরু নদীর প্রবাহ আবার গিয়ে মেশে শীতলক্ষ্যা নদীতে।
নদীর পানির রংয়ের পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে কথা হয় স্থানীয়দের সাথে। আমিরাবাড়ি ইউনিয়নে নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল বারেক জানান, পানির এই আচরণ তারা লক্ষ্য করছেন দীর্ঘদিন ধরে। এমনও দিন যায়, সকালে এক ধরনের রং, বিকালে আরেক ধরন। নদীজুড়ে পানির এই অবস্থা দেখে আতঙ্কিত তারা। কোথা থেকে এই ধরনের পানি আসে জানেন না তিনি।
রঙ্গিন পানির উৎস খুঁজতে এরপরের যাত্রা উজানের দিকে। প্রায় সাত কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখা মেলে একটি খালের। আমিরাবাড়ি ইউনিয়নের মুক্ষপুর এলাকায় এই খালটি 'চৌহার খাল' নামে পরিচিত। দেখা যায়, খালটি যেখানে নদীতে মিশেছে তার উজানের নদীর পানির রং স্বাভাবিক। খাল ধরে এগিয়ে গেলে পানি পৌঁছাবে গুজিয়াম-আমিরাবাড়ি সড়কের একটি কালভার্টের নিচে। সেখানে দেখা যায়, একটি পাইপলাইনের মাথা থেকে অবিরাম বের হচ্ছে ধোঁয়াওঠা গরম রঙ্গিন পানি। চৌহার খাল হয়ে মিশে যাচ্ছে বানার নদীতে। এরপর এই সুরঙ্গ পৌঁছেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ড্রেসডেন টেক্সটাইলস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির সীমানার পাশে।
ড্রেসডেন টেক্সটাইলস লিমিটেড কোম্পানির সহকারী সাধারণ ব্যবস্থাপক (এজিএম) নুরে আলম খোকন কোম্পানির ফটকে এসে দেখা করেন। তার কাছে পানির প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এরপর এই প্রতিবেদক তাদের তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) সচল কিনা দেখতে চাইলে তাকে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়। একপর্যায়ে প্রশ্নের মুখে নুরে আলম স্বীকার করেন, এখনো কোম্পানিটিতে ইটিপি স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি। অর্থাৎ কারখানার দূষিত পানি সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। তিনি সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দ্রুতই ইটিপি স্থাপন করা হবে।
রং পরিবর্তনের সাথে সাথে আশপাশের মানুষের কাছে নদীটি এখন আতঙ্কের কারণ। বিষাক্ত এই পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিকাজ। মারা যাচ্ছে প্রাণী।
স্থানীয় কৃষক চান মিয়া বলেন, আগে নদীর পাশে রবিশস্যসহ নানা রকম ফসলের আবাদ করতেন তারা। নদীর পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে এখন উৎপাদন কমেছে। বিশেষ করে ধানের চারার আবাদ করা হতো নদীর পাশের জমিতে। এখন করা যাচ্ছে না।
কামাল হোসেন নামে স্থানীয় এক যুবকের সাথে কথা হলে তিনি জানান, কিছুদিন আগে এখানে নেমে পানি খাওয়ার কারণে তার ৬টি হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। এরপর থেকে হাস-মুরগিকে নদীর পার থেকে দূরে রাখেন তিনি। আগে নদীর পানি গরু, ছাগলকে খাওয়াতেন; এখন দূর থেকেই পানি আনেন।
এদিকে এলাকাবাসী বলছে, এই নদীর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। একসময় এখানে অনেক জেলে দেশীয় প্রজাপতি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন সে মাছ বিলুপ্তির পথে।
আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়ামপাড়া কাঁঠালীবন্ধ গ্রামের আবদুল করিম বলেন, "এক দশক আগেও বর্ষাকালে বানার, সুতিয়াসহ আশপাশের খাল-বিলগুলোতে কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এখন নদীতে পুঁটি, চিংড়ি, টাকিসহ মাত্র কয়েক জাতের মাছ পাওয়া যায়। বর্ষা শেষে শীতকালে নদীতে 'বাওয়া' নামতো, দল বেঁধে অনেক লোক একসঙ্গে মাছ ধরতো। সেই দৃশ্য মনে হয় না আর দেখা যাবে।"
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎসবিজ্ঞান অনুষদের একোয়াকালচার বিভাগের গবেষক অধ্যাপক ড. মো মাহফুজুল হকের সাথে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তিনি জানান, মাছের বেঁচে থাকার জন্য প্রতি লিটারে অক্সিজেন দরকার ৬.৫ থেকে ৭ মিলিগ্রাম। অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে আয়রন ও নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে যায়। তাছাড়া এসব রাসায়নিক বর্জ্যে থাকে ফরমালডিহাইড ও ক্লোরিন যা মাছের ফুলকাকে পুড়িয়ে ফেলে। আর পানিতে যদি রং মিশ্রিত থাকে তাহলে পানির উপরিভাগে আস্তর পড়ে। এতে করে সূর্যের আলো নদীর তলদেশে পৌঁছায় না। ফলে নদীতে কমতে থাকে মাছ। প্রজননেও সংকট দেখা দেয়। হয় না বংশবৃদ্ধি। আর সিসাসহ ভারী ধাতু পানিতে থাকার কারণে তা মাছের কোষে প্রবেশ করে। সেই মাছ খাওয়া মানুষের শরীরের জন্য চরম ক্ষতিকর।
তিনি বলেন, "এ ধরনের দূষণ একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ। এটি বন্ধ করতেই হবে। কারণ একটি নদীর সাথে জীববৈচিত্র্যের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।"
বিষয়টি ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের নজরে আনা হলে পরিচালক ফরিদ আহমদ বলেন, "এর আগে ড্রেসডেন টেক্সটাইলস লিমিটেডকে নোটিশ দেয়া হয়েছিলো। আমার জানামতে, প্রতিষ্ঠানের পানি নিষ্কাশন বন্ধ রয়েছে। তবে যেহেতু তারা আমাদের নিষেধ অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়া হবে।"
জেলা নদী রক্ষা কমিটির সদস্য এ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, "পরিবেশ অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা না মেনে স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায়, কিসের জোরে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, তার জবাব সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে। যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তাহলে আন্দোলন নামবো আমরা।"