'ব্যাটারির যুদ্ধ': বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে একচেটিয়া দখল চীনের
বৈদ্যুতিক গাড়ি বলতে সাধারণত টেসলার নামই প্রচলিত। ক্যালিফোর্নিয়ার এই কোম্পানিটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করে। সম্প্রতি এর বাজার মূল্য পৌঁছেছে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে। কিন্তু এই মার্কিন সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে চীনের উৎপাদন ক্ষমতার গল্প।
সাংহাইতে অবস্থিত টেসলার কারখানা বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার কারখানার চেয়েও বেশি গাড়ি তৈরি করে। তাছাড়া, এসব গাড়ির বেশ কয়েকটিতেই চীনের তৈরি ব্যাটারি ব্যবহৃত হয়। এমনকি ব্যাটারি রিচার্জের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানও কিছু চীনা সংস্থা খনন ও পরিশোধন করে থাকে।
বিশ্বে বৈদ্যুতিক যানবাহনের ব্যবহার বাড়তে থাকায়, ব্যাটারি সাপ্লাই চেইনে নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চীনা কোম্পানিগুলো। খনিজ নিষ্কাশন ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে ব্যাটারি উৎপাদন পর্যন্ত সবই করা হচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলোতে।
'ব্যাটারির যুদ্ধে' তাই চীন বর্তমানে রয়েছে বেশ শক্ত অবস্থানেই।
গত বছর ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি করে চীন। বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রির ৪০ শতাংশেরও বেশি এটি। এছাড়া, সর্ববৃহৎ চীনা ব্যাটারি প্রস্তুতকারক কোম্পানি সিএটিএল বিশ্বের ব্যাটারি বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
কোবাল্ট স্পেশালিস্ট সরবরাহকারী ডার্টন কমোডিটির অনুমান অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের ব্যাটারি বাজারে প্রয়োজনীয় কোবাল্টের ৮৫ শতাংশ সরবরাহ করে চীনা কোম্পানিগুলো। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির স্থায়িত্ব বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয় কোবাল্ট। ফলে এর চাহিদাও অনেক। এই কোবাল্টের বেশিরভাগ আসে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) থেকে। কঙ্গোর খনিজ খাতের প্রায় ৭০ শতাংশ রয়েছে চীনা কোম্পানিগুলোর অধীনে।
চলতি বছরের আগস্টে, চায়না মলিবডেনাম কোম্পানি (সিএমওসি) তাদের একটি খনিতে তামা ও কোবাল্ট উৎপাদন দ্বিগুণ করতে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা করে। কঙ্গোতে অবস্থিত এই 'টেনকে ফুংগুরুমে' খনি-ক্ষেত্রটি কোম্পানির অধীনে থাকা সবচেয়ে বড় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে একটি। হুয়াউ কোবাল্ট নামক আরেকটি চাইনিজ কর্পোরেট কোম্পানি কঙ্গোতে অন্তত তিনটি তামা-কোবাল্ট খনির মালিক এবং অংশীদার।
সম্প্রতি কিছু গাড়ি এবং ব্যাটারি নির্মাতা তাদের ব্যাটারিতে কোবাল্টের পরিমাণ কমিয়ে নিকেলের ব্যবহার শুরু করেছে। কিন্তু, যেসব চীনা কোম্পানি কঙ্গোতে কোবাল্ট খনির আধিপত্যে রয়েছে, তারাই ইন্দোনেশিয়াতে নিকেল উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। বিশ্বের বৃহত্তম নিকেল মজুদ (৭২ মিলিয়ন টন) রয়েছে দেশটিতে। ফলে, ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে নিকেলের বৃহত্তম উৎপাদক এখন চীন।
তবে, কঙ্গোতে চীনের আধিপত্য বিস্তার বন্ধ করতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছে দেশটির সরকার। দেশটির কোলওয়েজি শহর সফরে রাষ্ট্রপতি ফেলিক্স শিসকেডি বলেন, "মানুষ খালি হাতে কঙ্গোতে আসে এবং বিলিয়নিয়ার হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু আমরা দরিদ্রই রয়ে যাই।" তামা-কোবাল্ট বেল্টের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শহর। ২০০৭ সালে সিকোমাইনের উপর চীনা কনসোর্টিয়ামকে সংখ্যাগরিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ প্রদানকারী ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিসহ দেশটির কিছু বড় খনির চুক্তির পর্যালোচনা ঘোষণা করেছে কোঙ্গোর সরকার।
এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ২ ট্রিলিয়ন ডলার অবকাঠামো প্যাকেজের অংশ হিসাবে বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে ১৭৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এই অর্থ বরাদ্দ সত্ত্বেও দেশটি চীনের তুলনায় পিছিয়ে আছে।
বেঞ্চমার্ক মিনারেল ইন্টেলিজেন্সের সিইও সাইমন মুরস জুন মাসে মার্কিন সিনেটের একটি কমিটিকে সতর্ক করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রতি চার মাসে একটি ব্যাটারি মেগাফ্যাক্টরি তৈরি করছে, সেখানে চীন সপ্তাহে একটি ব্যাটারি মেগাফ্যাক্টরি তৈরি করছে। তিনি আরও বলেন, "একটি নতুন বৈশ্বিক লিথিয়াম-আয়ন অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে। তবে এখানেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে ইউরোপ ও চীন।"
তবে, এসব খনির উৎপাদন চীনের জন্য সুফল বয়ে আনলেও, আসল চিত্র যেন ভিন্ন কথা বলে।
চীনা কনসোর্টিয়ামের মালিকানাধীন সিকোমাইনস নামক একটি খনিতে নিযুক্ত একজন কর্মী বলেন, "চীনারা কঙ্গোর মানুষদের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করে। তারা আমাদের অপমান করতে পছন্দ করে। এমনকি ছোট কোনো দোষের জন্যেও শাস্তি দেওয়া হয়।" চীনা শ্রমিকদের সমপরিমাণ কাজ করেও তাদের তুলনায় কম বেতম পাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন এই খনির শ্রমিকেরা।
"বর্তমানে আমরা ঔপনিবেশিক যুগেই আছি। পার্থক্য হলো, এখন আমরা আছি চীনের অধীনে," বলেন আরেকজন কর্মী।
কঙ্গোতে বেসরকারি খনির ক্ষেত্রগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত করছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংস্থাটির প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মার্ক ডুমেট বলেন, "অনেক চীনা খনির কোম্পানি তাদের কার্যক্রমে পূর্ণ স্বচ্ছতা মেনে চলে না। তবে এই দেশে কোবাল্ট খনির সাথে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাস আরও আগের। চীনের আগেও অনেক দেশ কঙ্গোর সম্পদ শোষণ করেছে।"
"বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারির জন্য খনন বিশ্বে যে প্রভাব ফেলতে চলেছে তা নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন অ্যামনেস্টি। মানব ও পরিবেশগত দিক বিবেচনা না করে কাজ করলে এই নতুন গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনগুলোর ধ্বংসাত্মক রুপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে," যোগ করেন তিনি।
তবে, এ বিষয়ে চীনা খনিজ কোম্পানিগুলো বলছে ভিন্ন কথা। একজন চীনা ম্যানেজার বলেন, "কঙ্গো সরকারের সাথে কাজ করা খুবই হতাশাজনক। সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ এটি।"
এছাড়া, কঙ্গোতে সিএমওসি-এর একজন মুখপাত্র বলেন, "আমরা সমস্ত কর্মচারীদের একটি নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর, এবং যথাযথ কাজের পরিবেশ প্রদানের জন্য নিবেদিত।কর্মীদের অধিকার রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম নীতিমালা এবং স্থানীয় শ্রম আইনগুলো পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আমরা।"
- সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান