রোশানি বেগম: ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন টিপুর দরবারের এই নর্তকী
১৭৯৯ সাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতান। টিপুর বংশকে নিশ্চিহ্ন করতে তার দরবারের সমস্ত নারীকে মহীশুর রাজ্য থেকে নিয়ে যাওয়া হয় মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির ভেলোরে।
ব্রিটিশদের হাতে আটক হওয়া কয়েকশ নারীদের একজন ছিলেন রোশানি বেগম। টিপুর দরবারের এক নর্তকী।
রোশানির আসল নাম পুম কুসুর। জন্ম এখনকার অন্ধ্র প্রদেশের আদোনিতে। অল্পবয়সে নর্তকী হিসেবে যোগ দেন টিপুর রাজসভায়। সঙ্গে ছিলেন তার বোন। টিপু তখন রাজপুত্র। নিজ গুণে টিপুর সুনজরে পড়েন তিনি।
রোশানি বেগম টিপুর স্ত্রী হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাননি। কিন্তু টিপুর প্রথম পুত্রসন্তান শাহজাদা ফতেহ হায়দারের জন্ম তারই গর্ভে। সেই সুবাদে দরবারে তিনি উচ্চ মর্যাদা পেতেন।
রোশানি বেগমের ছেলের ১৮০১ সালের এক ছবি থেকে ধারণা করা হয়, তিনি ১৭৭০-এর দশকে টিপুর দরবারে আসেন।
১৮০২ সালে প্রায় সাড়ে পাঁচশ নারীর সঙ্গে রোশানি বেগমকে মহীশুর থেকে ভেলোর দুর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই বন্দি ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গৃহবন্দি থাকার সময়ও রোশানি বেগম তার নাচ চালিয়ে যান।
১৮০৪ সালে রোশানি গুজিব নামে এক মেয়েকে দত্তক নেন। মেয়েকেও নাচ শেখান তিনি। বাইরে থেকে নতুন অনেক মেয়েও ওই সময় ভেলোরের দুর্গে আসতে শুরু করে। দেখতে দেখতে ১৮০২ সালের সেই ৫৫০ জনের দলের সংখ্যা ১৮০৬ সালে হয়ে ওঠে ৭৯০।
এভাবে ভেলোর দুর্গে নারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকার ঘটনা জানানো হয় তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির শাসক উইলিয়াম বেন্টিঙ্ককে। ১৮০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুর্গের নারীদের ভরণপোষণের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি।
বেন্টিঙ্ক এই কৌশল নেন রোশানির দলের সদস্যসংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু রোশানির কাছে এই সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত অপমান।
ভেলোর বিদ্রোহ
১৮০৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে, বেন্টিঙ্কের বরাদ্দ কমানোর নির্দেশের পরপরই, ভেলোরে টিপুর চার মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি বিয়েতেই রোশানি বেগমের তত্ত্বাবধানে ব্যাপক নাচ-গানের আয়োজন করা হয়।
এসব নাচ-গানের পরিকল্পনা করেছিলেন রোশানিসহ টিপুর দরবারের অন্যান্য গায়িকা-নর্তকীরা। এই আয়োজনের মাধ্যমে ভেলোর দুর্গে কর্মরত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সৈন্যদের সামনে ব্রিটিশদের বর্বরতার ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়।
এই নৃত্য প্রদর্শন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ ভারতীয় সৈনিকদের দেশপ্রেমে আঘাত করে। নাচের মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ভারতীয় হয়েও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উর্দি ও শিরস্ত্রাণ পরাটা তাদের জন্য অপমানজনক। এমন সময় আসবে, যেদিন বিদেশিদের বশ্যতা স্বীকারের ফল হিসেবে সৈনিকরা দেশের খাবার-পানি কিছুই পাবে না। ভারতীয় কোনো মেয়ে তাদের বিয়ে করতে চাইবে না।
রোশানি বেগমদের এই নৃত্যের গভীর প্রভাব পড়ে দেশীয় সৈন্যদের ওপর। ফলে ১৮০৬ সালে ৯ জুলাই, ভেলোর দুর্গে একটি নৃত্যানুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, দেশীয় সৈনিকদের মাদ্রাজ ইনফ্যান্ট্রি সহসা বিদ্রোহ ঘোষণা করে কোম্পানির বিরুদ্ধে। ১২৯ জনকে হত্যা করে দুর্গের ওপর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকা নামিয়ে আবার মহীশূরের পতাকা উড়িয়ে দেয় তারা। এবং রোশনি বেগমের ছেলে ফতেহ হায়দারকে নিজেদের রাজা বলে ঘোষণা করে।
এই বিদ্রোহ সামালাতে কোম্পানির পক্ষ থেকে ভেলোরে বড় সেনাদল পাঠানো হয়। সাড়ে তিনশো বিদ্রোহী সিপাহিকে হত্যা করে ফের ভেলোর দুর্গের দখল নেয় ব্রিটিশরা।
ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা ভেলোর দুর্গের এই বিদ্রোহকে স্রেফ সামরিক বিদ্রোহ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ভালোমতো বিচার-বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, রোশানি বেগমের মতো টিপুর দরবারের নারীরা নিজেদের প্রভাব ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও ব্রিটিশ শাসকদের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
- সূত্র: স্ক্রল ডটইন