নিলাম: ৮ বছরে বিলাসবহুল ১১২ গাড়ির মধ্যে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫টি!
প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিশ্বের নামিদামী ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল ১১২টি গাড়ি। ১১২ একক কন্টেইনার ভর্তি এসব গাড়ি ৮ বছর বছর ধরে পড়ে আছে চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে। ৫ বার ঢাকঢোল পিটিয়ে, টাকা খরচ করে, বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও বিক্রি হচ্ছে না গাড়িগুলো।
সময় মতো নিলাম না দেওয়ার কারণে এসব গাড়ির ইঞ্জিন, ব্যাটারি, চাকাসহ যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। নেই অধিকাংশ গাড়ির চাবিও। সর্বশেষ নিলামে সবগুলো গাড়ির মূল্য উঠেছে প্রায় ১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার।
কিন্তু নিলামে দরদাতা কাস্টমসের সংরক্ষিত মূল্যের ৬০ ভাগ এর নিচে দাম দেওয়ায় এই সব গাড়ি আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে গাড়িগুলো বিক্রি করতে পারবে না কাস্টমস। তাই এখন এসব গাড়ি ধ্বংস করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাস্টমসের অদক্ষতার কারণে সময়মতো গাড়িগুলো নিলাম না দেওয়ায় শুধুমাত্র কাস্টমসের আর্থিক ক্ষতি হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে জায়গা দখল করে রাখায় বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে। যার প্রভাব পড়ে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানিয়েছে, বন্দরের ইয়ার্ডে ১১২ কন্টেইনার ভর্তি হয়ে গাড়িগুলো পড়ে থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৮ বছরে কমপক্ষে বছরে ৩৩ হাজার ৫'শ কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং করতে পারতো। যা দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কমপক্ষে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার আয় হতো একই সাথে বাড়তো বন্দরে হ্যান্ডেলিং কার্যক্রমে গতিশীলতা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো: আবদুল মজিদ বলেন, কোনো পণ্য বারবার নিলামে তোলা হলে ভ্যালু কমে যায়। কাস্টম কর্তৃপক্ষ বিলাসবহুল এসব গাড়ির নিলামের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তখন নিষ্পত্তি করতে পারতেন। সময় ক্ষেপণের কারণে গাড়িগুলোর দাম কমে গেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গাড়িগুলোর নিলাম নিষ্পত্তি করা উচিত। এখন যে দাম পাওয়া গেছে যদি বিক্রি করা না হয় তাহলে পরবর্তীতে গাড়িগুলোর দাম আরো কমে যাবে।
এদিকে কাস্টমসের এই অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ শুল্ক স্টেশনে এরকমভাবে এতগুলো গাড়ি পড়ে থাকাও নজিরবিহীন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর ফলে প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলারের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে দেশের অর্থনীতে এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে। চট্টগ্রাম কাস্টমসকে আরও আধুনিকায়নের আওতায় আনতে হবে এবং কাস্টমসকে এসব বিষয়ে আরো বেশি দক্ষ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার রাখার সক্ষমতা ৪৯ হাজার ১৮ টিইইউ (টুয়েন্টি ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট)। বন্দর বছরে হ্যান্ডেলিং করে ৩ মিলিয়নের অধিক কন্টেইনার। বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বাড়াতে যেখানে নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সেখানে এভাবে বছরের পর বছর কন্টেইনার ফেলে রাখায় বন্দরের প্রোডাক্টিভিটি নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক টিবিএসকে বলেন, বন্দরে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা কন্টেইনার সরানোর জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে প্রতিনিয়ত চিঠি দেওয়া হয়। এসব কন্টেইনার সময়মতো সরানো হলে বন্দরের কার্যক্রম আরো গতিশীল হতো। রাজস্ব আদায় হতো বন্দরের। তাই যত তাড়াতাড়ি গাড়ি গুলোর নিলাম নিষ্পত্তি করে কন্টেইনারগুলো সরানো হবে, তত দ্রুত দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল হবে।
কারনেট ডি পাসেজ সুবিধায় বিভিন্ন দেশ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ১১২ টি গাড়ির মধ্যে ২৬ টি মিতসুবিশি, ২৫টি মার্সিডিজ বেঞ্চ, ২৫টি বিএমডব্লিউ, ৭টি ল্যান্ডরোভার, ৭টি ল্যান্ডক্রুজার, ১টি সিআরভি, ৬টি লেক্সাস, ৫টি ফোর্ড, ৩টি জাগুয়ার, ১টি দাইয়ু ও ১টি হোন্ডাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে।
এসব গাড়ি গুলো ২০১৬ সাল থেকে এ নিয়ে ৫ বার নিলামে তোলা হয় হয়। সর্বশেষ গত ৩ ও ৪ নভেম্বর অনলাইন এবং প্রচলিত দুই ভাবে নিলামে তোলা হয়। কিন্তু পঞ্চমবারে এসেও সফলতা আসেনি। যদিও ১১২ টি গাড়িতে দরপত্র জমা পড়ে ৫৫১ টি। যেখানে একটি গাড়ির রিজার্ভ ভ্যালূ ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা টাকা। কিন্তু দরপত্রে দাম পড়েছে সর্বোচ্চ ৫৩ লাখ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ১১২ টি গাড়িতে দাম উঠেছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। অথচ কাস্টমস নিলামে এসব গাড়ির রিজার্ভ ভ্যালু নির্ধারণ করেছিলো প্রায় ২১ মিলিয়ন ডলার বা ১৮০ কোটি টাকা।
সময়মতো নিলাম না দেওয়ার কারণে ২১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন এসব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পেছেনে দায়ভার কাস্টমসের। সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে গাড়িগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। গাড়িগুলো এখন ধ্বংস করা ছাড়া কোন গতি নেই।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার আল আমিন টিবিএসকে বলেন, ১১২ টি নিলামে যারা দরপত্র জমা দিয়েছে সেগুলো থেকে ৫টির নিলাম অনুমোদনের জন্য গত ২ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে শীঘ্রই তাদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। বাকী গাড়িগুলো পর্যায়ক্রমে নিলামে তোলা হবে।
কোন গাড়িগুলো নিলামে তোলা হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এনবিআরের অনুমোদন পাওয়ার আগে সুপারিশকৃত গাড়ি গুলোর তথ্য প্রদান করা সম্ভব নয়। কারণ সুপারিশকৃত গাড়ির তালিকা থেকে বাদ কিংবা অন্যগাড়ি অন্তর্ভূক্তও হতে পারে।
পঞ্চম বারের মতো নিলাম আয়োজনের পরও মাত্র ৫ টি গাড়ি অনুমোদনের সুপারিশ করা হলো এতে নিলাম ব্যর্থ হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আল আমিন বলেন, আমি এতে ব্যর্থতা দেখিনা। দরদাতারা যে দাম উল্লেখ করেছে তাতে সরকারের অন্তত ১৭ কোটি টাকা হলেও রাজস্ব আয় হবে।
কাস্টম আইন অনুযায়ী বন্দরে পণ্য আসার ৩০ দিনের মধ্যে পণ্য খালাস নিতে হয়। এই সময়ের মধ্যে পণ্য না নিলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানিকারকে নোটিশ দেয়। নোটিশ দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য খালাস না করালে এসব পণ্য নিলামে তোলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিমাসে একবার নিলাম আয়োজন করে কাস্টম। কিন্তু গাড়ি গুলো বন্দরে আসার ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও নিলামে উঠেছে মাত্র ৫ বার।
যে কারণে নিলামে অংশ নেননি নিয়মিত বিড়াররা
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিয়মিত নিলামে অংশ নেয় প্রায় ৮০ জন ব্যবসায়ী। কিন্তু এবারের গাড়ির নিলামে অংশ নেয়নি এসব ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন নিলামের ক্যাটালগে পূর্বে কতবার নিলামে উঠেছিলো তার উল্লেখ থাকে। কিন্তু গাড়ির ক্যাটালগে সেটি উল্লেখ ছিলোনা। এতে ব্যবসায়ীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিপি অনুমোদন ছাড়া নিলামে তোলায় নিলামের নিয়মিত ব্যবসায়ীরা নিলামে দরপত্র জমা দেয়নি।
নিলাম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন এসব গাড়ি নিলামে তুলতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের শ্রমঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। অথচ ৫টি মাত্র গাড়ি নিলামে বিক্রির জন্য সুাপারিশ করা হয়েছে। গাড়ির নিলামে কাস্টমস এক ধরনের লুকোচুরি করেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম নিলাম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আর এন্ড এইচ সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেন বলেন, কাস্টমসের কাছে আমাদের অনুরোধ ছিলো গাড়িগুলোর সিপি অনুমোদন নিয়ে নিলামে তোলা। কিন্তু কাস্টমস সিপি অনুমোদন ছাড়াই নিলামে তুলেছে।
সিপি অনুমোদন ছাড়া যতবারই গাড়ি গুলো নিলামে তোলা হোক না কেন, নিলাম সফল হবে না। তাছাড়া গত ৮ বছর ধরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই গাড়িগুলো বিক্রির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। ফলে কোটি কোটি টাকার গাড়ি এখন বারবার নিলামে তুলেও বিক্রি করা যাচ্ছেনা। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে।
গাড়ি উৎপাদনের ৫ বছর পরবর্তী সময়ে বন্দর থেকে খালাস পেতে সিপির প্রয়োজন হয়। যেহেতু গাড়ি গুলো বন্দরে ৮ বছর ধরে পড়ে ছিলো তাই এসব গাড়ি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিপি ছাড়া খালাস করা সম্ভব হবেনা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিপি পেতে দীর্ঘসূত্রীতার কারণে নিলাম ব্যবসায়ীরা এসব গাড়ি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেনা।
এই বিষয়ে কাস্টমসের উপ কমিশনর আল আমিন বলেন, আশা করছি শীঘ্রই গাড়ি গুলোর সিপি পেয়ে যাব। কারন ইতোমধ্যে সিপির অনুমোদনের জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়কে চিঠি দিয়েছে।
এক দেশের গাড়ি সাময়িক সময়ে ব্যবহারের জন্য দেশে নিয়ে আসার বিশেষ সুবিধাকে বলা হয় কারনেট সুবিধা। বিদেশি বিশেষ ব্যাক্তি, বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত বিভিন্ন দেশের নাগরিক, কুটনৈতিকভাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক কারনেট বা পর্যটন সুবিধায় এসব গাড়ি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী ফেরার সময়ে সে দেশে এসব গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। এই সুবিধার অপব্যবহারের ফলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কড়াকড়ির কারণে গাড়িগুলো খালাস নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।