আলীকদমে দু’শত দশদিন
চাকুরী বিবরণী অনুসারে বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় আমার প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের সময়কাল ২৯ নভেম্বর ১৯৮২ হতে ২৫ জুন ১৯৮৩ পর্যন্ত অর্থাৎ দু'শ দশদিন। আলী কদম এখন অনেকের কাছেই পরিচিত। বর্তমানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত নয়নাভিরাম দেশের একটি উপজেলার নাম আলীকদম। গাড়ীতে করে সরাসরি এখন বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় যাওয়া যায়। আমি যখন আলীকদমের প্রথম থানা নির্বাহী অফিসার হিসাবে সেখানে বদলি হই, তখন এটি একটি দূর্গম অপরিচিত থানা ছিল। থানাগুলির নামকরণ তখন উপজেলা হয়নি। আলীকদম তখন বান্দরবান জেলার একটি অত্যন্ত দূর্গম ও প্রত্যন্ত থানা ছিল। পরবর্তীতে প্রায় সকল থানাকেই প্রশাসনিক উপজেলা হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে।
আলী কদমে পদায়নের পূর্বে আমি চট্টগ্রাম জেলার তখনকার পটিয়া মহকুমায় অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসক হিসাবে দায়িত্বরত ছিলাম। তখন দেশে মার্শাল'ল চলছিল। মরহুম প্রেসিডেন্ট হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ চট্টগ্রামের পটিয়া মহকুমা এবং বান্দরবানের লামা মহকুমা ব্যতীত দেশের সব মহকুমাকেই জেলায় রুপান্তরিত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালেই দেশের পুরাতন জেলাগুলিসহ অধিক সংখ্যক মহকুমাগুলিকে নিয়ে মোট ৬০টি জেলা সৃষ্টি করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীয়করণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর সেই পদক্ষেপ বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। দেশে তখন এক ভয়াবহ সামরিক শাসনের সূচনা হয়।
১৯৮২ সালে পর্যায়ক্রমে কিছু কিছু থানাকে উন্নীত থানা নামকরণ করে থানা নির্বাহী অফিসার হিসাবে বদলি শুরু হয়। আমিও এরকম বদলির মধ্যে পরে বান্দরবান জেলার আলীকদম থানার প্রথম থানা নির্বাহী অফিসার হিসাবে বদলি হই। আমার পরিবারের সদস্যদেরকে পটিয়া থেকে চট্টগ্রামের লালখাঁন বাজারে আমার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী একটি ছোট টিনসেডের বাসা ভাড়া করে সেখানে রেখে আমি চট্টগ্রাম থেকে ২৮ নভেম্বর ১৯৮২ তারিখে আলীকদমের উদ্দেশ্যে খুব সকালে বাসে রওনা হই। আমার মেয়েটার বয়স তখন বড়জোর ৫ বছর হবে আর ছেলেটা কোলে, বয়স ১ বৎসরও হয়নি। বাসে সারাক্ষণ ওদের কথাই চিন্তা হতে থাকে। চট্টগ্রাম থেকে লামা যেতে কক্সবাজারের রাস্তা পরিবর্তন করতে হয়। লামা যেতে হয় মেরামত করা পুরাতন ভাঙ্গা জিপে, যাকে চান্দের গাড়ী বলা হয়। সেই চান্দের গাড়ীতে করে লামা পৌঁছতে রাত প্রায় ৮ টার বেশি হয়ে যায়। লামা পৌঁছে লামার মহকুমা প্রশাসকের দপ্তরে যাই। সেখানে মহকুমা প্রশাসক এবং তাঁর সহকর্মীদের কয়েকজনকে পাই। পরদিন ২৯ নভেম্বর ১৯৮২ তারিখে আলীকদম উন্নীত থানা হিসাবে উদ্বোধন হবে। তাই আমাকে ২৮ তারিখ পৌঁছতেই হবে। লামার মহকুমা প্রশাসক আমাদেরকে আলীকদম যাওয়ার বিষয়ে একটি ব্রিফিং দেন। মহকুমা প্রশাসকের ব্রিফিংটি শুনে তখনই বুঝতে পারি আলীকদম পৌঁছতে অনেক কষ্ট হবে।
আমরা ২/৩ জন নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখে শীতের রাতে লামা থেকে আলীকদমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। পায়ে হাঁটার রাস্তা, শীতের রাত, পাহাড়ে প্রচন্ড শীত। দূর্গম পাহাড়ের ভিতর দিয়ে রওনা হলাম। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে উঁচুনীচু রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে রাত প্রায় ১১টার দিকে পাহাড় পার হয়ে মাতামুহরী নদীর তীরে পৌঁছালাম। ভাগ্য তবুও ভাল, সেদিন ছিল জ্যোৎস্না। জোৎস্নায় প্লাবিত নদীর পাড়। নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে আলীকদম যাবে আরও ২/৩ জন লোকের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এদের মধ্যে একজন আলী কদম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার পরিচয় জানার পর তিনি তাদের মধ্যে একজনকে বললেন, "আমাদের উন্নীত থানার বড় স্যার, স্যারকে ঘাড়ে তুলে নে"। যেই কথা সেই কাজ। একজন আমাকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে হাটতে থাকলেন। তারপর তার ঘাড়ে চড়েই মাতামুহরী নদী পার হলাম। নদীতে তখন পানি তেমন ছিল না, হাটু পানি। আলীকদম পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় ১টা হয়ে যায়। আলীকদম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আমাকে ফরেস্টের একটি ডাক-বাংলোয় নিয়ে গেলেন। জঙ্গলের মাঝে ছোট এক রুমের একটি কাঠের ডাক-বাংলো। তাতে একটা মাত্র চৌকি। বাংলোর নিচ দিয়ে খোলা। কাঠের সিড়ি দিয়ে ডাক-বাংলোটিতে উঠতে হয়। সারারাত ধরেই বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা আমার খোঁজ পেয়ে সেখানে আসতে থাকলো। পরদিন যে থানাটি উন্নীত হবে আমরা সকলে সেই প্রশাসনিক থানা অফিস অর্থাৎ আলীকদম থানা সার্কেল অফিসারের অফিসে গেলাম। একটা লম্বা টিনের ঘর উপরে নীচে সবদিকেই টিন। ছোট ছোট ৪/৫ টা কক্ষ। এর একটা কক্ষে থানা সার্কেল অফিসার বসেন, যাতে ছোট একটা টেবিল এবং ২/৩ টা চেয়ার। অন্য কক্ষগুলিতে কোন চেয়ার বা টেবিল কিছুই নেই। সেখানে পৌঁছে জানতে পারলাম আলীকদমে একটি ক্যান্টনমেন্ট রয়েছে এবং সেই ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসার একজন লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। তিনিই আলীকদম উন্নীত থানা উদ্বোধন করবেন। উনার নাম জানলাম লেঃ কর্ণেল হাওলাদার। কমান্ডিং অফিসার সকাল ১০টার কিছুক্ষণ আগে আসলেন। হেঁটে হেঁটে সব দেখে আলীকদমকে উন্নীত থানা হিসেবে ২৯ নভেম্বর ১৯৮২ উদ্বোধন করলেন। উদ্বোধনের পর সেদিন সন্ধ্যা ৭ টায় ক্যান্টনমেন্টে যাবার জন্য বলে গেলেন।
সন্ধায় আলীকদম ক্যান্টনমেন্টে গেলাম। গেইটে প্রহরারত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সিপাহীদের একজন আমাদেরকে আলীকদম ক্যান্টনমেন্টের গেইটের বাইরে একটি বাঁশের তৈরি গোলঘরে বসতে বললেন। আমরা সেখানে এক ঘণ্টার মত অপেক্ষা করার পর কমান্ডিং অফিসার লেঃ কঃ হাওলাদার, সাথে আরও দুইজন সেনাবাহিনী কর্মকর্তাসহ আসলেন। এদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন এবং একজন নায়েক সুবেদার পর্যায়ের কর্মকর্তা ছিলেন। কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে আসা ক্যাপ্টেনকে উন্নীত থানা প্রশাসনের লিয়াজোঁ অফিসার হিসাবে দায়িত্ব দিলেন এবং উন্নীত থানা প্রশাসনের উপর একটি সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করলেন। তিনি জানালেন প্রতিদিনই সন্ধ্যা ৭ টায় আলীকদম ক্যান্টনমেন্টের ঐ গোল বাঁশের ঘরটিতে আমাদেরকে উপস্থিত থাকতে হবে। কমান্ডিং অফিসার ৫ ডিসেম্বর ১৯৮২ তারিখে সন্ধ্যার মিটিং এ আমাকে জানালেন যে, আমাকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসকের ডাকা সভায় আগামীকাল ৬ ডিসেম্বর ১৯৮২ তারিখে যেতে হবে। সেই নির্দেশ পেয়ে ৬ ডিসেম্বর ১৯৮২ তারিখ খুব ভোরে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের দপ্তরের উদ্দেশ্যে আলীকদম থেকে রওয়ানা দিলাম। আমি একা, সঙ্গে কেউ নেই। মাতামুহরী নদী পেরিয়ে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে লামা পৌঁছলাম।
পরবর্তীতে এই ভাবে ঘন ঘন জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সভার ডাক পড়তে থাকলো এবং প্রত্যেক সভায় যোগদান করতে হতো। লামাতে এসে চাঁন্দের গাড়ীতে চড়ে কক্সবাজারের রাস্তায় পৌঁছে সেখান থেকে বান্দরবানের বাসে করে বান্দরবান পৌঁছতাম। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক এক সভায় জানালেন জোনাল মার্শাল-ল-এডমিনিস্ট্রেটর মেজর জেনারেল মান্নাফ আগামীকাল আলী কদম যাবেন। তারিখটি সঠিকভাবে এখন মনে নেই। তবে আলীকদমে যোগদানের সপ্তাহ দু'একের মধ্যেই হবে অর্থাৎ ১৯৮২ সালের ডিসেম্বর মাসে। জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সেদিন বেশ কয়েকটি সভা থাকায় সভাগুলি শেষ করতে করতে বিকাল হয়ে যায়। বান্দারবান থেকে লামা পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় ৯টা হয়ে যায়।
তারপর পাহাড়ের ভিতর দিয়ে জঙ্গঁলের রাস্তা ধরে হেঁটে মাতামুহুরী নদীর পাড়ে পৌঁছাবার আগেই প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। চারিদিকে ঘুট ঘুটে অন্ধকার। স্বাভাবিক সময়ে মাতামুহুরী নদীতে তেমন পানি থাকে না, নদী থাকে শান্ত। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টি হলে পাহাড়ী ঢলে নদী হয়ে যায় প্রচন্ড খরস্রোতা। একদিকে জীব-জন্তু ও সাপের ভয়, অন্যদিকে শান্তি বাহিনীর ভয়। এই অবস্থায় ভয় ও আতঙ্কে বুক কাঁপছে। সেই সময়ে হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে থেকে একটা কাল কুচকুচে লোক বয়স আনুমানিক ২৪/২৫ হবে, সুঠাম দেহ আমার পাশে এসে দাঁড়াল এবং জানাল সেও আলীকদম যাবে। আমাকে বলল "আপনি যদি আমার উপরে চড়ে ঘাড়ে এবং গলায় ধরে রাখতে পারেন তাহলে আপনাকেও পার করে দিতে পারব। তবে যদি ছেড়ে দেন অথবা ছুটে যান নির্ঘাত মৃত্যু।" আমি ভাবলাম আমাকেতো আজ রাতেই আলীকদম পৌঁছতে হবে। কারণ আগামীকাল জোনাল মার্শাল-ল-এডমিনিস্ট্রেটর আলীকদম যাবেন। তাই লোকটির কথামত তার ঘাড়ে চেপে ধরে নদী পার হবার সিদ্ধান্ত নিলাম। লোকটির ঘাড়ে চেপে গলায় ধরে প্রচন্ড খরস্রোতা মাতামুহুরী নদী পার হবার জন্য রওনা দিলাম। এইভাবে নদীর অপর পাড়ে আসার পর কিছুদূর যাবার পরই হঠাৎ অনুভব করলাম লোকটি আমার পাশে নেই। একদিকে অন্ধকারের মধ্যে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে, আবার অন্যদিকে লোকটি হঠাৎ অন্ধকারে মিশে গেছে। পায়ে পাহাড়ী বড় বড় জোকের কামড় অনুভব করছি। ভয়ে সমস্ত শরীর কাঁপছে, গা ছম ছম করছে। এমনিতেই আলীকদমের রাস্তা তখন ভাল করে চিনি না। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে রাত প্রায় ১টা হবে, আমি আমার অবস্থানস্থল ফরেস্টের ডাক-বাংলোয় গিয়ে পৌঁছলাম। লোকটির ঘাড়ে চেপে সেদিনের মাতামুহরী নদী পার হবার ঘটনাটি আমার কাছে আজও ভৌতিক মনে হয়।
পরদিন জোনাল মার্শাল'ল এডমিনিস্ট্রেটর মেজর জেনারেল মান্নাফ হেলিকপ্টারে করে আলীকদম পৌঁছলেন। পৌঁছেই তিনি উন্নীত আলীকদম থানা ক্যাম্পাসে প্রশাসনিক অফিসসমূহ ভিজিট করলেন। সেখানে আগে থেকেই আলীকদম ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কঃ হাওলাদার এবং সেনাবাহিনীর অন্যান্য কর্মকর্তাসহ উন্নীত থানা প্রশাসনে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। জেডএমএলএ মেজর জেনারেল মান্নাফ প্রথমে থানা নির্বাহী অফিসারের কক্ষে ঢুকলেন এবং এরপর একে একে অন্যান্য কক্ষে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখে অফিস সমূহ ভালভাবে চালু না হওয়ায় প্রচন্ড অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। তিনি আলীকদম ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসারকে নানারকম দিক নির্দেশনা দিলেন। এছাড়াও উন্নীত আলীকদম থানা প্রশাসনের কাজে আরও গতিবৃদ্ধির নির্দেশনা দিয়ে হেলিকপ্টারে করে আলীকদম ছাড়লেন।
কমান্ডিং অফিসারের ইচ্ছায় আমার থাকার স্থানটি পরিবর্তন করে ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি ইউনিয়ন কাউন্সিলের অফিসের ৩টি কক্ষের ১টিতে চলে আসি। তখন আলীকদমে বিদ্যুৎ ছিল না। শুধু ক্যান্টনমেন্টে জেনারেটরে চালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ছিল। কমান্ডিং অফিসার লেঃ কঃ হাওলাদার ক্যান্টমেন্টে জেনারেটর চালিত বৈদ্যুতিক লাইনের একটি সংযোগ ইউনিয়ন কাউন্সিলের যে কক্ষে আমি থাকি তাতে দেবার জন্য নির্দেশনা দেন। এভাবে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত জেনারেটরে চালিত বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আওতায় আমার কক্ষটিও আসে।
আমার কাজকর্মের মধ্যে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম তদারকির বিষয়টি থাকায় মাঝে মাঝে আলীকদমের প্রত্যন্ত এলাকায় উন্নয়ন কাজকর্ম তদারকি করতে যেতাম। আমার সঙ্গে আলীকদম ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানও যেতেন। আলীকদম তখন এতই অনুন্নত ছিল যে কিছুদূর ভেতরে পাহাড়ী এলাকায় গেলেই প্রায় উলঙ্গ পাহাড়ী মানুষের দেখা পাওয়া যেত। একদিনের ঘটনা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানসহ পাহাড়ের পর পাহাড় হেঁটে পার হয়ে একটি রাস্তার কাজ দেখতে যাই। একটি পাহাড়ের মোড় নিতেই ১৮/১৯ বৎসরের এক যুবতী মেয়ে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় হঠাৎ আমাদের সামনে পড়ে। সে তখন পাহাড়ের নীচে ঢালু জায়গা থেকে কলসিতে ঝর্ণার পানি নিয়ে ফিরছিল। আমাদেরকে অকস্মাৎ দেখে ভয় পেয়ে ঝড়সড় হয়ে যায়। আমার সঙ্গে থাকা চেয়ারম্যান তখন তাকে বুঝিয়ে পরিবেশটা সহজ করে।
পরিশেষে আলীকদমে অবস্থানকালের আরও একটি ঘটনার কথা বলে "আলীকদমে দু'শ দশদিন" আমার এ লেখাটি শেষ করছি। সেদিন ছিল বান্দরবান জেলা প্রশাসকের অফিসে বান্দরবান জেলার উন্নীত থানাগুলির থানা নির্বাহী অফিসারদের সমন্বয় সভা। যতদূর মনে পড়ে ১৯৮২ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে এ সভাটি ছিল। সভা শেষ হতে হতে রাত প্রায় ৮টা বেজে যায়। রাত হয়ে যাওয়ায় জেলা প্রশাসক মহোদয় সেদিন আমাকে বান্দরবানে থেকে যেতে বলেন। সেদিন আমি আলীকদম না গিয়ে বান্দরবানের ডাকবাংলায় থেকে যাই। পরদিন বান্দরবান থেকে আলীকদম পৌঁছেই জানতে পারি গতকাল রাতে আলীকদমে আমার থাকার অবস্থান ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে আমার কক্ষে শান্তি বাহিনীর লোকেরা আক্রমণ করেছিল। ইউনিয়ন কাউন্সিলর অফিসের সামনেই একটি বড় মাঠ, মাঠটি পার হয়ে কিছু দূরেই আলিকদম বাজার। আমাকে না পেয়ে শান্তিবাহিনীর লোকেরা আলিকদম বাজারে গিয়ে দুইজন বাঙ্গালী দোকানদারকে গুলি করে হত্যা করে পাহাড়ের পিছনে অপর পাশের পাহাড়ের অভ্যন্তরে চলে যায়।
আলীকদমে এ ধরনের কষ্টকর কাজ করতে করতে আমি ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোমরের ব্যথা প্রচন্ড রকমভাবে বেড়ে যায়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারছিলাম না। ছুটি নিয়ে ঢাকায় তখনকার পিজি হাসপাতাল যার বর্তমান নাম বিএসএমএএমইউ এ ভর্তি হই। চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হলে তখনকার সংস্থাপন মন্ত্রাণালয়ে রিপোর্ট করি। পরবর্তীতে ঢাকার সাভার থানা থেকে উপজেলায় উন্নীত হলে, আমাকে সাভারের প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসাবে পদায়ন করা হয়।
- লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব।