টিকটক-আসক্ত কিশোরীরা অস্বাভাবিক নড়াচড়া, হঠাৎ রেগে যাওয়ার মতো অদ্ভুত আচরণ করছে
জীবনকে সহজ করে তুলতেই প্রযুক্তির উদ্ভাবন। আমাদের জীবনযাপন ও বিনোদন ব্যবস্থাকে আমূল বদলে দিয়েছে এসব আবিস্কার। অনলাইনে সামাজিক মাধ্যমও এসেছে সে ধারাবাহিকতায়। কিন্তু, এতদিনে সকলেই জানেন সব প্রযুক্তিরই ইতিবাচক-নেতিবাচক ব্যবহার- দুই দিকই থাকে।
নেতিবাচক দিকটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে অল্প বয়সী কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক মাধ্যমে আসক্তি। স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও প্লাটফর্ম টিকটক নিয়ে এমন কথা জানিয়েছেন কয়েকটি দেশের শিশু চিকিৎসকরা।
মহামারিকালে মানুষের ঘরে অবস্থান বেড়েছে, কমেছে সামনাসামনি মেলামেশা। লকডাউনের কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরেরাও ঝোঁকে অনলাইন বিচরণে। তবে সবচেয়ে তীব্র আচরণগত পরিবর্তনের কথা জানা যাচ্ছে টিকটকের মাধ্যমে।
টিকটকে আসক্ত কিশোরীরা অস্বাভাবিক শারীরিক নড়াচড়া এবং আকস্মিকভাবে রেগে যাওয়ার মতো 'অসুস্থ' আচরণ করছে। মহামারির শুরুর পর থেকেই এ ধরনের পরিবর্তনের শিকার বহু কম বয়সী কিশোরী বিভিন্ন দেশের চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়েছে।
তবে চিকিৎসকরা তাদের সমস্যার উৎস ধরতে পারছিলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের শিশু হাসপাতালগুলোর শীর্ষ বিশেষজ্ঞরা এনিয়ে নিজেদের মধ্যে রোগীর অভিজ্ঞতা বিনিময় শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে তারা আবিষ্কার করেন, একই রকম বিকৃতির শিকার অধিকাংশ কিশোরীই টিকটিক ব্যবহারকারী।
এনিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু মেডিকেল জার্নালে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন তারা। যেখানে তারা বলছেন, পরিবর্তনের শিকার কিশোরীরা 'টুরেট সিনড্রোম'- এ আক্রান্ত টিকটক ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিডিও দেখত। এটি হচ্ছে এক ধরনের নার্ভাস সিস্টেম ডিজঅর্ডার বা স্নায়বিক বিকৃতি। এতে আক্রান্তরা নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে। অনিচ্ছাকৃত নড়াচড়া বন্ধ করে সুস্থির থাকাও সম্ভব হয় না তাদের পক্ষে।
টিকটক কন্টেন্ট মেকারদের এই রোগ গভীর প্রভাব ফেলেছে কিশোরীদের অনুকরণপ্রিয় সংবেদনশীল মানসিক অবস্থায়। তারাও এখন রোগটির শিকার হচ্ছে আশঙ্কাজনক সংখ্যায়।
জাতীয়ভাবে এমন রোগীর সংখ্যা এখনও নির্ণয় করা হয়নি যুক্তরাষ্ট্রে। তবে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের পেডিয়াট্রিক মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার সেন্টারের বরাতে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, কিশোরী রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
পেডিয়াট্রিক মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার সেন্টার শিশুদের চলাফেরা ও আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতার চিকিৎসা দিয়ে থাকে। এসব সেন্টার থাকে বিভিন্ন হাসপাতালে।
সিনসিনাটি চিলড্রেনস হসপিটাল মেডিকেল সেন্টারের নিউরোলজিস্ট ডোনাল্ড গিলবার্ট পেডিয়াট্রিক মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার এবং টুরেট সিনড্রোম বিশেষজ্ঞ। ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রতিমাসে তার কাছে গড়ে ১০ জন করে টিনএজ কিশোরী এসেছে, যারা এসব সমস্যার শিকার।
অথচ মহামারির আগের সময়ে প্রতিমাসে গড়ে এমন একজন করে রোগী পেতেন তিনি।
শিশু চিকিৎসকরা আচরণের এই ত্রুটি বা পরিবর্তনকে বলছেন –টিক্স। যুক্তরাষ্ট্রের বড় কয়েকটি চিকিৎসা কেন্দ্র একই রকমভাবে কিশোরী টিক্স রোগী বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে।
যেমন টেক্সাস চিলড্রেনস হসপিটালে ২০২০ সালের মার্চ থেকে প্রতিমাসে গড়ে ৬০ জন করে টিক্স আক্রান্ত কিশোরী আসছে। মহামারির আগে এই সংখ্যা ছিল এক বা দুইটি।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির টুরেট সেন্টারে আসা ১০-২০ শতাংশ কিশোরী প্রবল টিক্স সমস্যায় আক্রান্ত। মহামারির আগের বছর এই সংখ্যা ছিল ২-৩ শতাংশ।
এ তথ্য জানান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টির সাইক্রিয়াট্রি অ্যান্ড বিহেভেরিয়াল সায়েন্সেস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জোসেফ ম্যাকগুয়ার।
চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত শিকাগোর রাশ ইউনিভার্সিটির মেডিকেল সেন্টারে ২০ জন টিক্স আক্রান্ত কিশোরী রোগীকে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। অথচ মহামারির আগে সারা বছরে আসত গড়ে ১০ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন বেশিরভাগ কিশোরী উদ্বেগ ও বিষন্নতায় ভুগছে, মহামারির কারণে যা আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
ডোনাল্ড গিলবার্ট বলেন, এ ধরনের মানসিক চাপের ফলেই রোগীরা আগে যাদের মধ্যে একই ধরনের শারীরিক বিভিন্ন অস্বাভাবিকতা দেখেছে সেগুলোর লক্ষণ তাদের মধ্যেও দেখা দেয়।
তিনি আরো জানান, আগেও আমি অনেক রোগীর মধ্যে খিঁচুনির (ননএপিলেপটিক সিজার) সমস্যা দেখেছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মানসিক চাপে থাকা অবস্থায় আত্মীয় বা পরিচিতজনদের এই ধরনের সমস্যায় ভুগতে দেখেছিল।
টিকটকে টিক্সের মতো আচরণের অজস্র ভিডিও দেখা যায়। গত জানুয়ারিতে এনিয়ে মার্কিন চিকিৎসকদের একটি দল গবেষণা শুরু করেন। তারা দেখতে পান 'টুরেটস' হ্যাশট্যাগ চিহ্নিত ভিডিওগুলো মোট ১২৫ কোটি বার দেখা হয়েছে। এই সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮০ কোটিতে।
অর্থাৎ, ইনফ্লুয়েন্সেয়াররা এটি অন্যদের জন্য মজার বিষয় হিসেবে ছড়িয়ে দিয়ে দর্শক আকর্ষণ করেছেন। দুঃখজনকভাবে বেশিরভাগ দর্শকই ছিল নাবালক। ঘরবন্দী থেকে বিষণ্ণ অবস্থায় এসব ভিডিও দেখে তারাও আক্রান্ত হয় বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে এ গবেষণা।
এব্যাপারে টিকটকের একজন মুখপাত্র ওয়ালস্ট্রিট জার্নালকে বলেন, "সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের কাছে প্রধান গুরুত্বের। এ ধরনের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার ব্যাপারে সঠিক ব্যবস্থা নিতে আমরা শিল্প বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করছি।"
শুধু টিকটকের ওপর দোষ চাপাননি অনেক চিকিৎসক। তারা বলছেন, আগের চেয়ে উচ্চ সংখ্যায় রোগী আসতে থাকলেও, তা এখনই প্রাদুর্ভাবে রূপ নেয়নি।
ডা ম্যাকগুয়ার বলেন, "সামাজিক মাধ্যমে যুক্ত অনেক শিশুর মধ্যে টিক্সের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। তবে এর নিয়মিত দর্শক নয় এমন শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। আমি মনে করি, এর পেছনে উদ্বেগ ও বিষন্নতার মতো মানসিক চাপের মতো বেশকিছু অনুঘটক দায়ী।"
টুরেট সিনড্রোম নিয়ে ভিডিও প্রকাশ করা অনেক টিকটকার এতে আক্রান্ত নয়, বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেক চিকিৎসক।
তারা বলছেন, এমন টিকটকারদের বেশিরভাগই কিশোরী ও তরুণী। কিন্তু, ভিডিওতে তাদের মধ্যে সত্যিকারের স্নায়বিক সমস্যা ও মৌখিক ত্রুটির লক্ষণ দেখা যায়নি। অর্থাৎ, তারা বিষয়টি নিয়ে নেহাত মজা করার জন্যই এসব শারীরিক সমস্যার অভিনয় করে ভিডিও পোস্ট দিয়েছে।
তবে এই চর্চাও তাদের মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তাছাড়া, কিশোরীদের চেয়ে কিশোর বা ছেলে শিশুদের মধ্যে টুরেট সিনড্রোমে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই বেশি। বয়সের সাথে সাথে এটিও বাড়তে থাকে। তবে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি সেরে যায় বলেও জানান তারা।
ডা. গিলবার্ট মনে করেন, টুরেট সিনড্রোমের ভিডিও দেখা অধিকাংশ টিনএজারের মধ্যে এ সমস্যার নানান লক্ষণ স্পষ্টভাবেই দেখা দিয়েছে। যা 'ফাংশনাল নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডারে'র ইঙ্গিত দেয়।
মস্তিস্কের এই সমস্যায় কথাবার্তা ও শারীরিক আচরণের অস্বাভাবিক ত্রুটি দেখা দেয়। শরীরের এসব নড়াচড়া আগের কোনো শারীরিক রোগের সাথে সম্পর্কিত নয়।
এসব ত্রুটি সাড়াতে চিকিৎসকরা 'কগনিটিভ বেহেভেরিয়াল থেরাপি' দিচ্ছেন এবং রোগীদের অন্তত কয়েক সপ্তাহের জন্য টিকটক থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন।
- সূত্র: দ্য ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল